—প্রতীকী চিত্র।
বইমেলা এখন বাঙালির একটি পার্বণ। প্রকাশক লেখক সম্পাদক অপেক্ষা করে থাকেন বাৎসরিক এই পার্বণের জন্য, পাঠক তো বটেই। তবে সময়ের সঙ্গে অন্য পার্বণও যেমন পাল্টেছে, এই মেলার চরিত্রও পাল্টেছে, হয়তো একটু বেশিই। পাল্টে গিয়েছে প্রকাশনার চরিত্রও। অনেক নতুন ছেলেমেয়ে সামান্য পুঁজি সঞ্চয় করে এসেছেন প্রকাশনায়। এঁরা নিজেদের সাধ্য ও পছন্দমতো বই প্রকাশ করছেন। এক সময় নতুন লেখকেরা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে ছিলেন অসহায়। কয়েক দশক আগে অবধি এত প্রকাশনা ছিল না, যাঁরা ছিলেন তাঁরা অনেকেই নতুন লেখকদের কাছ থেকে কত মুনাফা আদায় করা যায় তাতেই ছিলেন বেশি মনোযোগী।
পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে এই শতকের প্রথম দশক পার করে। বিশেষত ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’ (পিওডি) বাজারে আসার পর থেকে। গত শতকের শেষে কম্পিউটার এসে যাওয়ার পর থেকে লেখা কম্পোজ় করা সহজ হয়ে যায়। আগে অনেকটা জায়গা লাগত, লেটার-প্রেসের সময় টাইপ-সেটিং করে রাখতে হত। তার পর প্রুফ সংশোধন হয়ে এলে আবার সেই টাইপ-সেটিংয়ে গিয়ে ঠিক করা হত। এই কম্পোজ় যেখানে হত, বাড়ির একতলার ঘর, এমনকি উঠোন, তার উপর দিক কাপড় দিয়ে ঢাকা হত, যাতে জল না পড়ে। ছাপাখানার ভুল তো ছিলই। কম্পোজ়িটরের টাইপ-সেটিং কম পড়লে বা হারিয়ে গেলে সংশোধন ছাড়াই চলে যেত বই।
কম্পিউটার হওয়ায় আয়াসহীন ভাবে সংশোধন বার বার করা যায়, বিষয়টা সহজ হয়ে আসে। আগে ছোট ঘরে বেশ কয়েকটা যন্ত্র বসিয়ে চলত কম্পোজ় করা। লেটার-প্রেসে টাইপ-সেটিংয়ের যুগে প্রায় সব বই-ই অন্তত এগারোশো কপি ছাপা হত। এই এগারোশো কপিকে ধরা হত একটি সংস্করণ। তবে কবিতার বই সেই অবস্থাতেও সাড়ে তিনশো-চারশোর বেশি ছাপা হত না। বাংলা কবিতার জগতে দু’টি প্রখ্যাত বই হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ্য আর ফিরে এসো চাকা-র প্রকাশকের কাছে শুনেছি, প্রথম সংস্করণ সাড়ে তিনশো কপি ছাপা হয়েছিল। অবশ্য পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত কোনও কবির এগারোশো কপিও একটি সংস্করণে ছাপা হয়েছে, জানি।
লেখক-কবিরা যখন বিভ্রান্ত, বাংলা প্রকাশনাও ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছে, নতুন কেউ প্রকাশনায় সে ভাবে আগ্রহীও হচ্ছেন না, এই অবস্থায় প্রিন্ট অন ডিমান্ড যেন প্রকাশনার জগতে এক ধরনের সুরাহা এনে দিল। এক বদ্ধ জলাশয় যেন খুঁজে পেল নিষ্ক্রমণের পথ। এই পদ্ধতিতে চল্লিশ-পঞ্চাশ কপি বা তারও কম বই ছাপানো যায়। অর্থাৎ লগ্নি কম, অল্প ঝুঁকি। অনেক তরুণ তাঁদের বিচার-বিবেচনা মতো নতুন বইয়ে টাকা লাগালেন। হয়তো পঞ্চাশ-একশো কপির জন্যই। তার পর বইয়ের চাহিদা অনুযায়ী প্রিন্ট করাতে লাগলেন। এতে প্রকাশক, প্রিন্টার বা বাঁধাই দফতর, কাউকেই স্টক বহন করার দায় নিতে হল না।
প্রকাশনার জগতে এল দিক বদল। যাঁদের ছোট পত্রিকা আছে, যাঁদের অনেকেই কিছু বাছাই প্রকাশনা করতেন, বইমেলায় লিটল ম্যাগাজ়িন প্যাভিলিয়নে বসতেন সম্ভার নিয়ে, এই পিওডি ব্যবস্থার ফলে তাঁদের অনেককেই দেখা গেল বই প্রকাশের সংখ্যা বাড়িয়েছেন। আগে মেলায় একশো স্কোয়ার ফুট স্টলই ছিল সবচেয়ে ছোট, গত বছর থেকে দেখা গেল মেলা আয়োজকরা লিটল ম্যাগাজ়িন টেবিল ও একশো স্কোয়ার ফুটের মাঝামাঝি পঞ্চাশ স্কোয়ার ফুটের স্টল করেছেন। চাহিদা কিছু কম নয়।
বদলটা জরুরি ছিল। এই ধর্মান্ধতার যুগে প্রকাশনার সংখ্যা বৃদ্ধি মানে বইচর্চা বৃদ্ধি কিছুটা অন্তত সুস্থতার পরিবেশ বজায় রাখে। এ ছাড়া বিপণন পরিষেবাও নানা ভাবে বেড়েছে। আগে কলেজ স্ট্রিট বা মেলা ছাড়া বই পাওয়া যেত না। এখন ইন্টারনেটের যুগে ঘরে বসে অনলাইনেই বই পাওয়া যায়। কলেজ স্ট্রিটেও তৈরি হয়েছে অনেক ছোট ছোট বই বিপণি।
যে কোনও পদ্ধতিই স্থিতাবস্থায় অনন্তকাল থাকতে পারে না। পরিবর্তন বা বিবর্তন এক অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সেই অর্থে প্রকাশনা জগতের এই পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়ও। এর একটা অর্থনৈতিক দিকও আছে। অন্যান্য কর্মসংস্থানের অভাবে অন্তত প্রকাশনা তাদের অস্তিত্বকে সম্মানজনক ভাবে বজায় রাখার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু এর একটা অন্য দিকও হয়েছে। এই যে এত বই বেরোচ্ছে, তার মধ্যে যেগুলো মাত্র চল্লিশ-পঞ্চাশ কপি ছাপা হচ্ছে, এর ভবিষ্যৎ কী? প্রকাশনার বইয়ের পরিসংখ্যান, লেখকের বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু তার প্রচার থাকছে কয়েক জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাংলা বই প্রকাশনায় সম্পাদনার চল নেই, যা বহু ইংরেজি প্রকাশনায় রয়েছে। হয়তো বাণিজ্যের পরিসর বাংলা বইয়ে সেই সুযোগ দেয় না। কিন্তু লেখকের খরচে বই ছাপানোয় লেখার মান কতটা বিচার্য হয়, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ফলে অনেক বইয়ের ভিড়ে প্রকৃত ভাল সাহিত্য হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।
দিল্লিতে এক সর্বভারতীয় প্রকাশনার কর্ণধার জানিয়েছিলেন, প্রায় চোদ্দো-পনেরো বছর লেগেছিল ‘ব্রেক-ইভন’এ পৌঁছতে। তাঁর অন্য ব্যবসাও ছিল যা তাঁকে এতগুলো বছর সহায়তা দিয়েছে। প্রকাশনায় আসা বাঙালি যুবকদের কি সেই পরিমাণ স্থৈর্য রয়েছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy