Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
দলের ঊর্ধ্বে উঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো মানুষ কোথায়
Protest Against Injustice

উল্টে গেলেও পাল্টায় না

কামদুনি গ্রামের প্রথম মেয়ে গ্র্যাজুয়েটের ধর্ষণ ও খুনের বিচার চেয়ে তারই দুই আবাল্য বান্ধবী এবং শৈশবের এক মাস্টারমশাই আজও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন সাহস পাই।

Protest.

অতীত: ২০১৩ সালে কামদুনির ঘটনার প্রতিবাদে কলকাতার রাজপথে মিছিল। নিজস্ব চিত্র।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:২০
Share: Save:

সোজার পাশাপাশি উল্টো বোনাও শিখতে হবে”, উল বোনা শেখানোর ক্লাসে দিদিমণিরা কিছু ক্ষণ পর পরই বলতেন। খুব ধন্ধ লাগত কথাটা শুনে— উল্টো বোনা মানে কি কাঁটা উল্টে যায়, না কি উল? এত উল্টে যাওয়া এক সঙ্গে কী ভাবে সম্ভব, প্রশ্ন জাগত মনে। এখন আর জাগে না। এখন বরং মনে হয় যে, এমন একটা দুনিয়ায় এমন এক ব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি, যেটা ‘রমাকান্ত কামার’ নামটার মতো একটা প্যালিনড্রোম— উল্টে দিলেও পাল্টায় না একবিন্দু। কোথাও কিছু বদলাবে না আর। বদলানো সম্ভব নয়, কারণ আমরা নিজেরা নিজেদের পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, ‘যা বলতে চাই সেটা ঠিক নয় অন্যেরা বললে’।

উপরের পঙ্‌ক্তিটি যাঁর রচনা, সেই শঙ্খ ঘোষ কামদুনি কাণ্ডের পর একটি মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন, যেখানে দলমতনির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ হেঁটেছিলেন। হেঁটেছিলেন তাঁরা, অন্তর্দাহ এবং অন্তর্দংশন যাঁদের কুরে কুরে খাচ্ছিল, এক সদ্য-তরুণীকে ধর্ষণের পর ছিঁড়ে ফেলে খুন করা হয়েছে শুনে। তার কিছু দিন আগেই ঘটে গিয়েছে পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ড— সুজ়েট জর্ডান কামদুনির মেয়েটির জন্য বিচার চেয়ে পথে নেমেছেন। কয়েক বছর আগে নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের প্রতিবাদে যাঁরা পথে নেমেছিলেন, তাঁদের অনেককেই কামদুনির জন্যেও রাস্তায় দেখে একটা প্রতীতী জন্মেছিল যে, ‘অন্যায় যেখানে, প্রতিবাদ সেখানে’ কথাটা কেবল আপ্তবাক্য নয়।

সেই মিছিলের পর এগারো বছর পেরিয়ে গেল প্রায়, কামদুনির পিশাচরা শাস্তি পায়নি আজও। মানুষের স্মৃতি ফিকে হয়ে গেছে অনেকটাই, মরচে পড়ে গেছে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের তড়িৎ-গতিতে বিচার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতেও। উপরন্তু মামলাটি বারাসত থেকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে (কামদুনি গ্রামের অধিবাসীরা স্রেফ দারিদ্রের কারণেই পয়সা খরচ করে নিয়মিত কলকাতা আসতে পারবেন না, তা জানা সত্ত্বেও), এবং কেন কে জানে, একের পর এক সরকারি উকিল সরে দাঁড়িয়েছেন মামলাটি থেকে। এর মধ্যেও যখন দেখি যে, কামদুনি গ্রামের প্রথম মেয়ে গ্র্যাজুয়েটের ধর্ষণ ও খুনের বিচার চেয়ে তারই দুই আবাল্য বান্ধবী এবং শৈশবের এক মাস্টারমশাই আজও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন সাহস পাই।

মৌসুমী কয়াল ও টুম্পা কয়াল, এবং তাঁদের শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি একটি সাংবাদিক সম্মেলনে জানালেন যে, বিগত কয়েক বছরে যত বার তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, তত বারই গ্রামের সাধারণ মানুষেরা এগিয়ে এসেছেন নিজেদের বুকের পাঁজর দিয়ে তৈরি নিরাপত্তার বর্ম নিয়ে। নির্যাতিতার ভাইদের দিকে ইঙ্গিত করে অনেকেই যখন বলে যাচ্ছেন যে, সরকারি চাকরি নিয়েছেন মানেই ওঁরা বিকিয়ে গিয়েছেন, তখন প্রদীপবাবু দাপটের সঙ্গে সস্তা সমীকরণের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে দাবি করলেন যে, ক্ষতিপূরণ নিলেই কেউ প্রতিবাদের অধিকার হারায় না। যাঁদের দু’বেলা অন্নের সংস্থান হয় না, নৃশংসতম কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যদি তাঁদের সরকারি চাকরি দেওয়া হয়ে থাকে, তবু তাঁদের সেই নারকীয়তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার, প্রতিবাদ করার অধিকার চলে যায় না।

কথা হল, বিচার কি শুধু ওঁরাই চাইবেন? খুন হয়ে যাওয়া মেয়েটির পরিবার, তাঁর শৈশবের বন্ধুরা কিংবা এক জন শিক্ষক, দু’এক জন সহৃদয় উকিলেরই দায় কামদুনির মেয়েটিকে বিচার দেওয়া? বৃহত্তর জনসমাজ চুপ করে থাকবে, যখন কিনা হাথরস কিংবা উন্নাও নয় কেবল, হাঁসখালি থেকে বালুরঘাট হয়ে তিলজলায় সাত বছরের নাবালিকা খুন হয়ে যাচ্ছে আমাদেরই চোখের সামনে? ওই খুনিগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব ফাঁসির দড়ি থেকে ঝুলতে দেখার বাসনা হয়তো কোটি লোকের; কিন্তু সেই দাবি নিয়ে রাস্তায় নামবেন ক’জন? আজ কে এমন আছেন, যাঁর ডাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অসংখ্য মানুষ, কেবল মানুষ বলেই পথে নামবেন? তেমন একটি প্রতিবাদ মিছিল আজ আবার হলে মিডিয়ার বিপুল মনোযোগ পাবে কি?

বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাম্প্রতিক ‘খবর’গুলোর দিকে তাকালে এই প্রশ্নের আশাব্যঞ্জক উত্তর মেলে না। হতাশ হয়ে লক্ষ করতে হয়, কত তরল এবং তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকার সর্বাঙ্গীণ প্রতিযোগিতা চলতে পারে! প্রথমে একটি জয়েনিং লেটার নিয়ে শুরু হল অলীক কুনাট্যরঙ্গ। চাকরিতে যোগদানের চিঠি যে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার ‘চিরকুট’ নয়, তা বোঝার জন্য রকেট বিজ্ঞানী হতে হয় না। পাশাপাশি, আগের আমলে পার্টির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পরিবারের কারও কারও যে সুপারিশ বা বিনা সুপারিশেই চাকরি হয়ে যেত, সেটাও অনস্বীকার্য। এই প্রতিবেদকের পাড়াতেই স্থানীয় এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার স্ত্রীর সুবিধা করে দিতে গিয়ে এক একনিষ্ঠ পার্টি-কর্মীকে সারা জীবন বিনা মাইনেয় চাকরি করে যেতে হয়েছে প্রাইমারি স্কুলে। ত্রিশ বছরের উপর।

কামদুনির নিহত মেয়েটির খুনের বিচার চেয়ে লড়াই করার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, বানতলার নৃশংস ধর্ষণ এবং হত্যার কথা ভুলে যেতে হবে? তেমনই এই আমলের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার মানে এটা হতে পারে না যে, আগের জমানার স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে মুখ খোলা যাবে না। মুখ খুললেই অবশ্য একটি বুলেট ছুটে আসে— ‘পারলে প্রমাণ করুন’। কে প্রমাণ করবে? যখন দু’জন শিক্ষিত নেতা পরস্পরের পুত্র-কন্যা-জামাতা-পুত্রবধূর সুবন্দোবস্ত করে দেন, তখন সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীর সেই কথাটাই সত্য হয়ে ওঠে যে, আমি আর আপনি দুর্নীতি করলে, দুর্নীতিটা দুর্নীতি বলে মনেই হবে না। আজ যে বিপুল দুর্নীতির উপরের ঢাকনাটা খুলে গেছে, তার কারণ পারস্পরিক প্রতিদান নয়, টাকা দুর্নীতির মাধ্যম হয়ে উঠেছে— ব্লকে ব্লকে স্বল্পশিক্ষিত নেতাদের বাড়বাড়ন্তের কারণে।

মধ্যগগনে থাকা পার্টির দেওয়া সুবিধা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এক নেতা সে রকমই কিছু বলেছিলেন। তাঁর মতের সঙ্গে কেউ একমত হতে পারেন, না-ও পারেন। কিন্তু, দলের প্রতি তাঁর অতীত অবদানের কথা কেউ ভোলেন কোন সাহসে? সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে যে বাড়িটায় ওই নেতা এবং আরও কয়েক জন কমরেড লুকিয়ে থাকতেন মাসের পর মাস, সেই বাড়িটা আমার চেনা। সে সময়ের ইতিহাসও জানা। যে কোনও দিন খুন হয়ে যেতে পারতেন ওঁরা সবাই। ‘স্ট্রাগল’ কাকে বলে, সে কথা যাঁরা জানলেন না, দামি গাড়ি চড়ে আর বিলাসবহুল বাড়িতে থেকে তাঁদের স্পর্ধা হয় কী করে অতীতকে অস্বীকার করার?

জাঙ্গিপাড়ার মাস্টারমশাই তথা রাজনৈতিক কর্মী রবীন্দ্র সিংহরায়ের কথা মনে পড়ে, যিনি বর্ষাসজল নয়ানজুলিতে নেমে চাষিদের হাতে হাত মিলিয়ে পাট পচাতেন। মৃত্যুর আগে তিনি নাকি বলেছিলেন, “চার দিকে মানুষ পচছে।” রবীন্দ্রবাবুর মতো মানুষদের মৃত্যুকালীন আক্ষেপকে মিথ্যা প্রমাণ করতে হলে আজ আমাদের ব্যক্তিগত মতামতের ঊর্ধ্বে উঠে টিভির ওই সাজানো জলসার থেকে মুখ ফিরিয়ে কামদুনির জন্য পথে নামতে হবে আবার। কবি ডাক না দিলেও।

অন্য বিষয়গুলি:

kamduni Crime
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy