—ফাইল চিত্র।
মহিলা কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শেষ। শীতের বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। এক ঝাঁক মেয়ে খেলার মাঠ ছাড়ল, ‘আসছি ম্যাম, আসছি দিদি’, অনুমতি নিয়ে। মাঠের কোণে ব্যাগগুলো জমা। মেয়েগুলি হুল্লোড় করছে, আর ব্যাগ থেকে বার করে ট্র্যাকপ্যান্টের উপর পরে নিচ্ছে বোরখা। মেডালগুলো সন্তর্পণে ঢুকিয়ে রাখছে ব্যাগের একদম ভিতরে। লক্ষ করছে, খেলাধুলা করেছে যে তার কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে কি না। তার পর দল বেঁধে রওনা হচ্ছে পার্ক সার্কাসের দিকে।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় কিন্তু। কয়েক বছর ধরে, বিশেষত কোভিডের পরে সংখ্যালঘু ছাত্রীদের খেলাধুলায় যোগদান করার ইচ্ছে-উৎসাহ বেড়েছে অনেকটাই। মধ্য কলকাতার মহিলা কলেজের সঙ্গে যুক্ত, তার সংলগ্ন ছাত্রী-আবাস আছে, সেখানেও আয়োজিত হয় নানান খেলাধুলা। জেলা থেকে আসা সংখ্যালঘু ছাত্রীরা, সবার সঙ্গে উৎসাহিত হয়ে যোগদান করে সেখানে। আবার ‘ডে স্কলার’, মানে বাড়ি থেকে আসা ছাত্রীদের সঙ্গেও তারা যোগদান করে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়। যোগদান করা ছাত্রীদের মধ্যে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংখ্যালঘু ভাগ নয়, শহর-গ্রাম ভাগও লক্ষণীয়। আবাসিক ছাত্রীরা যোগদান করেছে অনেক বেশি, বাড়ি থেকে যাতায়াত করা ছাত্রীদের তুলনায়।
এই তথ্য বা ছবি কি সর্বজনীন? ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সোশ্যাল সায়েন্সেস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ়-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র উত্তর ২৪ পরগনার একটি মেয়েদের স্কুলে ১০০ জন সংখ্যালঘু ছাত্রীর উপরে করা সমীক্ষা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। ৯৬% সংখ্যালঘু ছাত্রী খেলাধুলায় যোগ দিতে উৎসাহী। ৮৮% খেলাধুলা করার চেষ্টা করে। কিন্তু ৮৩% এটাও বলে যে পারিবারিক বা সামাজিক ভাবে তাদের খেলতে বাধা দেওয়া হয়।
ইন্টারভিউ পদ্ধতির মাধ্যমেও খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ‘অর্জুন’ পুরস্কার বিজয়ী কবাডি খেলোয়ার বিশ্বজিৎ পালিত এখন কোচিং-এ ব্যস্ত। তাঁরও একই মতামত, সংখ্যালঘু মেয়েদের উৎসাহ, পরিশ্রম চোখে পড়ার মতো। তেমনই উঠে আসছে গ্রামের মেয়েরা। এর সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে? যে কারণের কথা ভাবতে ভাল লাগে, তা এই কমবয়সি মেয়েগুলির ডানা মেলে উড়তে পারার গল্প। জেলা থেকে যখন আসে, তখন ওড়না মুড়ি দেওয়া গুটিপোকা। তার পর সত্যিই ডানা মেলে ওড়ে প্রজাপতি। প্রথমে, নাম বা কোন জেলা থেকে এসেছে, প্রশ্ন করলে উত্তর শুনতে পাওয়া যায় না। এ দিকে তার কয়েক মাস পরেই, স্পোর্টস ক্যাপ্টেন কে হতে চায়, এই তালিকায় নাম থাকে তার। ব্যাডমিন্টনের নেট টাঙানো, বন্ধুদের নিয়ে ব্যাডমিন্টন র্যাকেট চাইতে আসা, আবার দিনের শেষে গুনে গুনে ফেরত দেওয়া, জিমে সময়মতো উৎসাহ নিয়ে এসে পৌঁছনো।
তবে, এই বদলের পিছনে সময়ের অবদান আছে অবশ্যই। ত্রিশ বছর আগে সরকারি কলেজেই পড়ার সময় খেলাধুলার পরিসর এতখানি ছিল না। কমনরুমে টেবিল টেনিস, ক্যারম বোর্ড; শীতকালে ব্যাডমিন্টন, তাও গুটিকয়েক ছাত্রীর মধ্যেই সেই উৎসাহ ছিল সীমাবদ্ধ। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনেকটাই সরকারি উৎসাহে। রাজ্যস্তরে ক্রীড়াপ্রকল্পে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আছ ‘খেলাশ্রী’। কেন্দ্রীয়স্তরে আছে ‘খেল ইন্ডিয়া’। এক জন ছাত্র বা ছাত্রী রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় সফল হতে পারলেই খুলে যাচ্ছে অসংখ্য সুযোগ।
পাল্টেছে তথ্য জানতে পারার পদ্ধতিও। ওয়েবসাইটে রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতার নিয়মিত আমন্ত্রণ এসে পৌঁছচ্ছে কলেজে, মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে স্টেডিয়ামে। এরা কিন্তু কেউই তথাকথিত ‘স্পোর্টস কোটা’র ছাত্রী নয়। প্রথম বার প্রতিযোগিতায় গিয়ে তারা অবাক হচ্ছে, ভয়ও পাচ্ছে। আবার নিজেরাই দল বেঁধে এসে বলছে, নিয়মিত খো-খো খেলার কোচের ব্যবস্থা করে দিন ম্যাম, পরের বার দারুণ টিম নিয়ে যাব।
লড়তে পারার এই আত্মবিশ্বাসই আসল বদল। এখন যে ছাত্রছাত্রীদের আমরা দেখি, নিজেদের সন্তানের অভিজ্ঞতা থেকেও হয়তো আমরা বুঝতে পারি, ওদের চার পাশ অনেক বেশি জটিল, অনেক করুণ। যে আশ্রয়, যে নিশ্চিন্ততা আমরা শৈশবে পেয়েছি, বাজার-মানসিকতা থেকে যত দূরে থাকতে পেরেছি, যে সহিষ্ণুতার আবহাওয়ায় বেড়েছি, তার কিছুই ওরা পায়নি। উপর্যুপরি তারা অতিমারির মতো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে। তাই ওরা কিছুটা অন্যমনস্ক, বেখেয়ালি, আমাদের চোখে কিছুটা কম দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন। আমরা এখনও গতে বাঁধা চিন্তা করতে ভালবাসি, মার্কশিটের নম্বর দিয়ে বিচার করতে ভালবাসি। এ দিকে অনেক নতুন সম্ভাবনা, নতুন পথ খুলে যাচ্ছে চার পাশে। ছাত্রছাত্রীদের, সন্তানকে নতুন পথে চলার সাহস দেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই। ‘মেয়েটি ভুল ইংরেজি লেখে, কী যে হবে!’ ‘পড়াশোনায় মন নেই, শুধু খেলতে চায়।’ ‘লাস্ট সিমেস্টারে ব্যাক পেয়েছে, এ দিকে গান নিয়ে ব্যস্ত।’ এর বদলে বলতে পারি, ইংরেজি জানো না, পরে শিখে নিয়ো। কিন্তু দেশ বা রাজ্যস্তরের কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কোনও অসুবিধা হবে না তোমার। শুধু খেলা বা গান নিয়েও তুমি অনেক দূর যেতে পারো, গতানুগতিক পড়াশোনার বাইরেও।
তবেই আর মেডালটা ব্যাগে ঢুকিয়ে না নিয়ে এক গাল হেসে ওরা সবাইকে দেখাতে পারবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy