এক বছরেরও বেশি সময় ধরে হয়ে চলা কোভিড-১৯ ‘প্যানডেমিক’-এর পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলছে ‘ইনফোডেমিক’, যা ভীষণ ভাবেই বিভ্রান্ত করে চলেছে আমাদের। এই ভ্রান্ত তথ্যের দায় কে নেবে? প্রখ্যাত চিকিৎসক ফাহিম ইউনুস জানাচ্ছেন যে, এই দায়িত্ব সরকারেরই।
সত্যিই তাই। না-হলে ঠিক-ভুল বোঝা যাবে কী ভাবে? আইভারমেক্টিন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, ফ্লাভিপিরাভির খাব, না খাব না? বিশেষত যেখানে সরকারি এবং আইসিএমআর নির্দেশিকাতে এ সব নানাবিধ জিনিস খাওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে! হু-র কথা জানলেও ‘হু সলিডারিটি ট্রায়াল’ কী, তা আমাদের বেশির ভাগেরই জানা নেই। সংবাদপত্র, টিভি, ফেসবুক থেকে ফ্রি-তে পাওয়া ডাক্তারবাবুদের পরামর্শই আজ আমাদের ভরসা। আর জনপ্রিয় হওয়ার তাগিদে সরকারি নির্দেশাবলিকে নিজের নামে, নিজের সংগঠনের নামে চালিয়ে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ’এ ‘ছাড়ছেন’ অনেকেই। এত সব পরামর্শে বিভ্রান্ত চিকিৎসকরাও। আমার ঘনিষ্ঠ ডাক্তারবন্ধুরা শুধুমাত্র যে প্রভূত পরিমাণে এই সব প্রেসক্রাইব করছেন তা-ই নয়, নিজেরাও যথেচ্ছ খেয়ে চলেছেন।
এক অনলাইন পোর্টালে দেওয়া এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে মুম্বইয়ের বিশিষ্ট পালমোনোলজিস্ট ডা. ল্যান্সলট পিন্টো স্পষ্ট করে জানাচ্ছেন, রেমডেসিভিয়ার জীবন বাঁচাতে পারে না। আরও অনেক সচেতন চিকিৎসক-গবেষকের মতো তিনিও জানাচ্ছেন যে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কোনও ওষুধের নিদান দেওয়া যায় না। তার জন্য দরকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। কিন্তু এ সবেরও থেকে অনেক বেশি ‘ক্যাচি’ হল নামীদামি ওষুধের প্রেসক্রিপশন, যাতে উদ্বিগ্ন রোগীদের বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে দ্রুত শান্ত করা যায়। সর্বোপরি, এত সব ট্রায়াল-রিপোর্ট মানতে গেলে ওষুধ কোম্পানির মুনাফাও বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক অংশগ্রহণকারী নিয়ে হওয়া একাধিক ‘লার্জ স্কেল র্যানডমাইজ়ড কন্ট্রোলড ট্রায়াল’-এ স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, রেমডেসিভিয়ার, যা আজ দুর্লভ হয়ে ব্ল্যাক হচ্ছে (এবং যা ঠেকাতে আদালতের নির্দেশে সরকারি নির্দেশনামা তৈরি করতে হচ্ছে) তা কোভিড-১৯ থেকে মৃত্যুর সম্ভাবনা কমায় না, এবং কোনও ভাবেই মৃদু বা মাঝারি উপসর্গযুক্ত রোগকে আরও খারাপ হওয়া থেকে আটকাতে পারে না।
তবে, এ সবও দেশের বিস্তীর্ণ গ্রামীণ মানুষের কাছে এখনও দূর অস্ত্! নিজের সীমিত অভিজ্ঞতা দিয়ে (গ্রাম, মফস্সল ও শহরকেন্দ্রিক হেলথকেয়ার প্র্যাক্টিস বিষয়ে), বিভিন্ন গ্রাউন্ড রিপোর্ট পড়ার পরে, এবং মধ্যবিত্ত নন এমন মানুষদের সঙ্গে কথাবার্তায় যা জেনেছি তা হল— তাঁদের প্রথম দিন থেকেই ‘ওরাল স্টেরয়েড’ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘ভিটামিন-অ্যান্টিবায়োটিক ককটেল’-সহ। বহু প্রান্তিক অঞ্চলে এবং প্রান্তিক মানুষের মধ্যে চিকিৎসা করা ডাক্তারবাবুরা জানেন যে, তাঁদের সর্বরোগহর সম্পদ হল ওই ওরাল স্টেরয়েডটি। এবং জ্বর থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক-প্যারাসিটামল কম্বিনেশন-সমেত সস্তার ওই ওরাল স্টেরয়েডই তাঁদের ভরসা। তাঁরা খেয়াল করছেন না যে, এই রোগে অক্সিজেন যখন দেওয়া হচ্ছে, কেবলমাত্র তখনই ওরাল বা ইন্ট্রাভেনাস স্টেরয়েড (মানে ‘সিস্টেমিক স্টেরয়েড’) ফলপ্রসূ হবে। অন্যথায় তা ক্ষতিকারকও হয়ে উঠতে পারে। সচেতন চিকিৎসক-গবেষকেরা সেই প্রথম থেকেই জানাচ্ছেন, ৮৫ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ নিজে থেকেই সেরে যায়।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বের নানা রকম প্রবক্তারা, রাজনৈতিক মাথারা একের পর এক মিথ্যা যুক্তি দিয়ে এবং পপুলিস্ট কৌশলে কোভিডের ব্যাপক মৃত্যুহার আর ভয়াবহতাকে অস্বীকার করে, ভ্যাকসিন নিতে নিরুৎসাহিত করে, করোনাকে ‘সামান্য ফ্লু’ বলে তাচ্ছিল্য করে বৈপ্লবিক ফ্যান্টাসির ফানুস ওড়াচ্ছেন, যা জাতীয় বিপর্যয় কী ও কেন, সে সম্পর্কে ন্যূনতম সিরিয়াস ভাবনার পরিসরটিকেও নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। আর এ সবের মধ্যে দিয়েই আজ আবারও একটা সর্বনাশা লকডাউনের মধ্যে আমরা। বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায় ভুগছেন অগণিত মানুষ। ‘সাইটোকাইন-স্টর্ম’ হলে, প্রায়শই সম্ভব হচ্ছে না তা সামাল দেওয়া।
অক্সিজেন স্যাচিয়োরেশন ৯২%-র কম হলে হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করা উচিত। যাঁরা শ্বাসকষ্টের পুরনো রোগী (সিওপিডি ইত্যাদি, যাঁদের স্বাভাবিক সময়ে অক্সিজেন স্যাচিয়োরেশন থাকে ৯৩-৯৫%), তাঁদের জন্য এই কাট-অফ আর একটু কম, অক্সিজেন ৮৯% বা তার কম হলে তাঁদেরও চেষ্টা করা উচিত ভর্তি হওয়ার। যদি শ্বাসকষ্ট, নীলাভ ঠোঁট বা মুখ, কথা বলার সময় শ্বাস নিতে সমস্যা, কাশির সময় মুখ থেকে রক্ত পড়া, বুকে চাপ অনুভব করা (কাশি বাদে অন্য সময়েও), ঘুম ঘুম ভাব, খাদ্য, পানীয় গ্রহণ ও চলাফেরায় সমস্যা অথবা স্বাভাবিক অবস্থার যে কোনও বড়সড় পরিবর্তন দেখা যায়, তা হলেও হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করা উচিত।
আর সবাই অবশ্যই মাস্ক পরুন, টিকা নিন, সচেতন থাকুন। এবং এই প্যানডেমিক ও ইনফোডেমিক থেকে বেঁচে থাকুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy