Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Child Marriage

অপুষ্ট শরীরে মাতৃত্বের দায়

সরকারি তথ্য অনুসারে, কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্পের সাহায্যে পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহ ২৩ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশে নামানো গিয়েছে।

একমাত্র শিক্ষা আর যথোপযুক্ত সরকারি উদ্যোগই পারে বাল্যবিবাহ-মুক্ত বাংলা গড়তে।

একমাত্র শিক্ষা আর যথোপযুক্ত সরকারি উদ্যোগই পারে বাল্যবিবাহ-মুক্ত বাংলা গড়তে। প্রতীকী ছবি।

সন্দীপন নন্দী
শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২২ ০৫:০২
Share: Save:

গত বছরও মায়ের বাড়ির উঠোনে চালের গুঁড়ো জলে গুলে আলপনা এঁকে লক্ষ্মীকে ঘরে তুলেছিল দুফালি। এ বছর কোজাগরী রাতে দশতলার লেবার রুমে নিজের মেয়ের জন্য রাত জাগছে। কোথায় চালের গোলা? কোথায় ধানের শিষ? অপুষ্ট, অপরিণত শরীর নিয়ে সন্তানের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে দুফালি। স্কুল-ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরার বছরখানেকও হয়নি, সেই মেয়ের সিজ়ার হল মাঝরাতে। মায়ের বাড়ি থেকে পালানোর দিন ফেলে এসেছিল একটা অসমাপ্ত কাঁথা। সেটা ছিল দুফালির স্কুলের ‘প্রজেক্ট ওয়ার্ক’। কিন্তু মেয়েদের জীবনটাই এখন এক অপরিকল্পিত প্রকল্প। ফোনে মেয়ের মা আক্ষেপ করলেন, কন্যাশ্রীর টাকায় ফুটো ছাদটা সারাই করবেন ভেবেছিলেন। সব স্বপ্ন জল ধুয়ে খেয়েছে বাড়ির ছোট মেয়ে। মহিলার স্বর বিমর্ষ লাগে।

গ্রাম-শহরের সদ্যপ্রসূতিদের নিয়ে সমীক্ষা চলছিল জেলা স্বাস্থ্য দফতরে। দুফালির মতো মেয়েদের জীবন আখ্যান ছেঁকে দরকারি তথ্য লেখা হয় ঢাউশ সরকারি খাতায়। জানা যায়, স্ত্রী ষোলো বছর, স্বামী সতেরো। সন্তান চার মাস। ফোনের ও-পারে হাতুড়ি পেটার শব্দ আসে। পুণে থেকে নাবালক শ্রমিক পিতা কথা বলে— গলার স্বরই তার বয়সের প্রমাণপত্র। বলল, ছেলে ভাল আছে। রোজ ভিডিয়ো কলে সন্তানের মুখ দেখে বাপ।

পরের ফোন ধরল ষোলো বছরের এক মা। অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল, সন্তানের বার্থ সার্টিফিকেট পেতে হন্যে হয়ে ঘুরছে। এ সব কেসে নাকি তা-ই হয়। পয়সা দিয়েও কাজ হয়নি। সিরিয়াল নম্বর বাইশ। সন্তানের বাবা ফোন ধরল স্কুল থেকে। ছাত্রদের চিৎকার, ঘণ্টাধ্বনি কানে আসে। কী হয়েছে, ছেলে না মেয়ে? চকিতে উত্তর আসে, ছেলে।

আর যখন জন্মায় মেয়ে? সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে দু’মিনিট গড়িয়ে যায় পরিবারের। থেমে থেমে বলে, বেটি হয়েছে। বর কী করে? ফার্স্ট ইয়ার। কেউ সম্পূর্ণ বেকার। কেউ বলে, নিখোঁজ। কোনও মা দৃঢ় গলায় জানায়, “বাচ্চা রেখে কলেজ যাই। বিশ্বাস না হলে দেখে যান।” আশা জাগে। এ ভাবেই অপরিণত বয়সের দাম্পত্যের খবর লেখা হয় রেজিস্টারে। পুতুলখেলা বিয়েগুলোই সত্যি হয়ে যায়। এরা কেউ ফোনে আসে ধারালো তরোয়াল নিয়ে, কেউ আসে ভোঁতা বল্লম নিয়ে। তবু আসে নাবালিকা মায়ের দল। রাত জেগে নোটস মুখস্থ করার পরিবর্তে সন্তানের মুখে বেবি ফুড তুলে ধরে কাটে তাদের বিনিদ্র রজনী।

এই মেয়েদের অনেকেরই আবার বাইরের ফোন ধরা মানা। তাই শিশু আর মায়ের হালহকিকতের ধারাভাষ্য শোনায় পুরুষকণ্ঠরা। পিতৃতন্ত্রের দলিল হয়ে থাকে, পাঁচ মিনিটের কথোপকথন। কথার মাঝেই এক টিন-এজ মা বরের থেকে ফোন কেড়ে স্পষ্ট জানায়, বাচ্চা হওয়ার আগে তার ওজন ছিল ৪৫ কেজি, এখন ৩২। হিমোগ্লোবিন কমের দিকে। ফোন কেটে দেয় স্বামী। বাকিটা আর শোনা হয় না। মেয়েরা নিজের শরীর নিয়ে অভিযোগ জানালে তা বকলমে স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির অবহেলাই প্রমাণ করে। ফলে ক’দিন আগের নিবিড় প্রেমটাই হয়তো প্রহার হয়ে যায় এমন অভিযোগ দাখিলের পর।

সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্যের হিসাব করতে করতে খাতাও লজ্জায় গুটিয়ে যায়। ছ’জন মা আর সন্তানের বয়স জুড়েও শতবর্ষ হল না। এটাই পঁচাত্তর বছর পেরোনো এক দেশের বাস্তব পরিস্থিতি। ২০১১-র জনগণনায় দেখা গিয়েছিল, ১০-১৯ বছরের মেয়েদের মধ্যে বিবাহিতাদের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১০ লক্ষ। তাদের মধ্যে ৩৮ লক্ষ মেয়ে দুফালির মতো বয়ঃসন্ধি পেরোনোর আগেই সন্তান প্রসব করেছিল। হাজার হাজার দুফালি আজও কলম ছেড়ে কোল পেতে আছে। দ্বীপখন্ডা, শিরসী, পাঞ্জুল গ্রামের চার জন মেয়ে দেড় বছরে দ্বিতীয় বার আঁতুড় ঘরে ঢুকতে বাধ্য হয়েছে। প্রত্যেকের প্রথম সন্তান ছিল মেয়ে। জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষার একটি বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, নাবালিকা মায়েদের মধ্যে যারা অক্ষরপরিচয়হীন, তাদের ৫০ শতাংশ বয়ঃসন্ধির আগেই মা হয়েছে। আর শিক্ষিতদের ৩৭ শতাংশ। শিক্ষিত মায়েদের সন্তানরা টিকাও পেয়েছে বেশি হারে (প্রায় ৬৭ শতাংশ)। মেয়েদের ক্ষমতায়নের জন্য ন্যূনতম মাধ্যমিক পাশ করাটা কত জরুরি, এই সমীক্ষা তার ইঙ্গিত দেয়। জাতীয় স্তরের এই সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে: যে মেয়েরা স্কুলে যায়, তারা নিজেদের শরীর সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এবং নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে সক্ষম। একমাত্র শিক্ষা আর যথোপযুক্ত সরকারি উদ্যোগই পারে বাল্যবিবাহ-মুক্ত বাংলা গড়তে।

সরকারি তথ্য অনুসারে, কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্পের সাহায্যে পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহ ২৩ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশে নামানো গিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, প্রকৃত তথ্য কোনও দিন আলো দেখে কি? দুফালিদের ‘ডেটাবেস’ সত্যকে যত প্রকাশ করে, ততই গোপন করে। যার অন্যতম কারণ, বাড়ির অভিভাবকদের তথ্য গোপন করার প্রবণতা। কখনওসখনও মেয়েটি নিজে ফোন পায় হাতে। যেমন সে দিন ফোন তুলেছিল চকচন্দনের চড়কি টুডু। কী হয়েছে, ছেলে না মেয়ে? কাঁদতে কাঁদতে চড়কি বলেছিল, মেয়ে। তার পর একটু থেমে, “মরে গেছে বাবু।”

ফোন কেটে যায়। রেজিস্টারে আরও একটি তথ্য লেখা হয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Child Marriage West Bengal Women Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy