রুশ বাহিনীকে যে ভাবে ইউক্রেনের সেনারা প্রতিহত করতে সফল হয়েছে, তা সম্ভবত পুতিন ও তাঁর পরামর্শদাতাদের যথেষ্ট বিস্মিত করেছে। ফাইল চিত্র।
গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারিতে যখন রাশিয়ার ট্যাঙ্ক ইউক্রেন সীমান্ত পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল, তখন হয়তো রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ভেবেছিলেন, এই যুদ্ধ ভাল করে শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। সেই ইউক্রেনের যুদ্ধ এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে বৃহত্তম সংঘর্ষ হয়ে উঠেছে। রুশ বাহিনীকে যে ভাবে ইউক্রেনের সেনারা প্রতিহত করতে সফল হয়েছে, তা সম্ভবত পুতিন ও তাঁর পরামর্শদাতাদের যথেষ্ট বিস্মিত করেছে, এমনকি হতচকিত করে থাকতে পারে, এমনই মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। পুতিন সম্ভবত তাঁর হিসাব কষেছিলেন ২০১৪ সালে অনায়াসে ক্রাইমিয়া দখলের অভিজ্ঞতা থেকে। সে বার রাশিয়ার সৈন্যদের খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। ইউক্রেনে কিন্তু তার পুনরাবৃত্তি হল না। বস্তুত এই যুদ্ধ আর কেবল রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে চলছে বললে ভুল হবে। এই লড়াই এখন এক দিকে রাশিয়া, আর অন্য দিকে ইউক্রেনকে সামনে রেখে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমি দুনিয়ার মধ্যে যুদ্ধের আকার ধারণ করেছে। যুদ্ধ এখন তার দ্বিতীয় বছরে গড়িয়েছে, কিন্তু দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির এই তীব্র বিধ্বংসী লড়াই কবে থামবে, তার ইঙ্গিত এখনও পাওয়া যায়নি। বরং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজে ইউক্রেন গেলেন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির পাশে দাঁড়ালেন। তিনি জ়েলেনস্কিকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন, কারণ সম্প্রতি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ জোগানোর ব্যাপারে সমর্থন কিছুটা শিথিল হয়েছে আমেরিকায়। এটা বাড়তে থাকলে নেটোর অন্য সদস্যরাও তাড়াতাড়ি যুদ্ধ মেটাতে চাপ তৈরি করতে পারে।
জ়েলেনস্কি আমেরিকা এবং ইউরোপ গিয়ে দূরপাল্লার মিসাইল, এফ-১৬ ফাইটার জেট বিমান এবং উন্নত ট্যাঙ্ক ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের জন্যে দরবার করে এলেন। যদিও আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় মিত্রশক্তি ইউক্রেনকে ক্রমাগত আধুনিক অস্ত্রসম্ভার সরবরাহ করে চলেছে, তবু লক্ষ্মণরেখা পার করার ব্যাপারে সকলেই অতি-সতর্ক, পাছে সরাসরি নেটোর সঙ্গে সংঘাত বেধে যায়! তবু আশঙ্কা রয়েছে, আর কত দিন এ ভাবে তারা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে।
লক্ষণীয়, যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ার নিরিখে ইউরোপ ও উন্নত দেশগুলি, এবং বিশ্বের বাকি দেশগুলি, যেন দুই বিপরীত মেরুতে সরে গিয়েছে। জাপান এবং জার্মানির মতো দেশগুলো তাদের বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শান্তিকামী অবস্থান ছেড়ে এখন অতি-সক্রিয় প্রতিরক্ষা নীতি গ্রহণ করেছে, এবং যে যার নিজের সুরক্ষা ক্রমাগত মজবুত করে চলেছে। আবার ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মতো যে দেশগুলো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সামরিক প্রশ্নে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে চলছিল, এই যুদ্ধ তাদের ‘নেটো’ সামরিক জোটের সদস্য পদের জন্য আবেদন করতে বাধ্য করেছে। এমনকি অস্ট্রিয়া ও সুইৎজ়ারল্যান্ডের মতো নিরপেক্ষ দেশগুলোর উপরও চাপ বাড়ছে, যাতে তারা অবস্থান বদলে রাশিয়া-বিরোধী শিবিরে শামিল হয়।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, রাশিয়াকে একঘরে করার জন্য আমেরিকার শত চেষ্টা সত্ত্বেও বিশ্বের গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলো তাতে সায় দেয়নি। এই দেশগুলি রাশিয়ার নিন্দা করতে, বা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উপর বাধানিষেধ জারি করতে রাজি হয়নি। আমেরিকার নেতৃত্ব চাইছিল এই যুদ্ধকে রাশিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক আক্রমণ, এবং গণতন্ত্রের উপর আঘাত হিসেবে দেখাতে। কিন্তু সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, লাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার অধিকাংশ জনবহুল ও গরিব দেশগুলো আমেরিকার সঙ্গে সুর মেলাতে রাজি হয়নি। বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশ রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে ইচ্ছুক নয়।
ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি, খাদ্য প্রভৃতি জরুরি সামগ্রীর জোগানের সঙ্কট ইউরোপ এবং ধনী দেশগুলোকেও ছুঁয়েছে, তবে তার চাপ অনেক বেশি পড়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর। তা সত্ত্বেও রাশিয়ার প্রতি সমর্থন দুর্বল হয়নি। এই দেশগুলোতে যুদ্ধের দু’বছর আগে থেকেই লকডাউনের জেরে ওষুধ ও বিভিন্ন অত্যাবশ্যক পণ্যের ‘সাপ্লাই চেন’ ব্যাহত হয়েছিল, তাই জোগানের সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। বর্তমান যুদ্ধ সেই সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, যে ভাবে ধনী দেশগুলো কোভিড ভ্যাকসিনের জোগান নিজেদের কব্জায় করে নিয়েছিল, তা দেখেই হয়তো গরিব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো উৎসাহে রাশ টেনেছে। রাশিয়ার স্বৈরতন্ত্রের হাত থেকে গণতন্ত্র বাঁচানোর যে আহ্বান করেছে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলি, তার প্রতি এই দেশগুলি সেই জন্যই নিরুত্তাপ। এশিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলি কিছু দিন আগেই ওষুধ ও ভ্যাকসিনের অভাবে অতিমারির মোকাবিলায় কতখানি বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, তা এখনও স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, অনেক দেশই রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সমর্থক নয়। কারণ, তাদের চোখে এই রুশ আগ্রাসন যে কোনও দেশের সীমান্ত সুরক্ষা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে আশঙ্কাজনক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তারা রাশিয়াকে কোণঠাসা করার জন্যে আমেরিকার চালের শরিক হবে। বিশেষ করে যখন তারা অনেকেই সস্তায় জ্বালানি, গম, সার-সহ নানা অত্যাবশ্যক পণ্য পায় রাশিয়ার কাছ থেকে। অনেকের এ-ও মনে আছে যে, রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মতি না থাকা সত্ত্বেও আমেরিকা কী ভাবে ইরাকে সরকার বদল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কুড়ি বছর আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালিয়েছে আমেরিকা, খুব সম্প্রতি সেখান থেকে সৈন্য সরিয়েছে। তা হলে আমেরিকার আচরণ রাশিয়ার থেকে ভিন্ন কী অর্থে?
আজ যে প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে তা হল, কবে শেষ হবে ইউক্রেন যুদ্ধ? এর কোনও স্পষ্ট উত্তর এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। আমেরিকা আর রাশিয়া, দুটো দেশেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২৪ সালে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, তার আগে হয়তো এই প্রাণক্ষয়ী, অর্থক্ষয়ী সংঘাত শেষ হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy