আবার সে এসেছে ফিরিয়া। সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু গল্পের সেই বিখ্যাত লাইন মনে পড়ছে; বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক খবর শোনাতে গিয়ে। খবর তত্ত্বের। এবং এক্সপেরিমেন্টের। কসমোলজি বা বিশ্বতত্ত্বের এই দুই মস্ত সমস্যার সমাধান আজও মেলেনি। ১৯৩০-এর দশকে দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী বলেন, কোনও কোনও স্পাইরাল গ্যালাক্সি বনবন করে এমন বেগে ঘুরছে যে, তাদের নক্ষত্রগুলো ছিটকে দিগ্বিদিকে পালানোর কথা। কই, তেমন তো ঘটছে না। নক্ষত্রগুলো তো দিব্যি আঁটসাঁট বাঁধা আছে গ্যালাক্সিতেই। বাঁধা থাকতে লাগে মহাকর্ষ। আর, পদার্থ বিনে মহাকর্ষ হয় না। অথচ, স্পাইরাল গ্যালাক্সির যা পদার্থের পরিমাণ, তাতে এই পরিমাণ মহাকর্ষ হয় না। সুতরাং, এমন কিছু অচেনা পদার্থ নিশ্চয়ই আছে, যা জোগাচ্ছে ওই মহাকর্ষ। অচেনা, তাই বিজ্ঞানের পরিভাষায় ওই পদার্থ হল ‘ডার্ক ম্যাটার’। সে ম্যাটার যে কী, তা প্রায় একশো বছরেও জানতে পারল না বিজ্ঞান। জানার শতেক চেষ্টা সত্ত্বেও।
কসমোলজির দ্বিতীয় মস্ত সমস্যার উদ্ভব ১৯৯০-এর দশকে। বিগ ব্যাং বা এক মহাবিস্ফোরণে ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম। তার পর থেকে বিশ্ব ওই বিস্ফোরণের রেশ হিসেবে প্রসারিত হয়ে চলেছে। অথচ, ব্রহ্মাণ্ডে এত পদার্থ। তার মহাকর্ষের টানে সেই প্রসারণে লাগাম পড়ার কথা। কতটা লাগাম পড়ল, প্রসারণ হার কতটা কমে এল, তা মাপতে গিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের চক্ষু ছানাবড়া। ওঁরা দেখলেন ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ হার তো কমছেই না, উল্টে তা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, অচেনা কোনও এনার্জির ধাক্কায়। অচেনা, তাই নাম হল ডার্ক এনার্জি। ওই এনার্জি যে কী, তা জানা যায়নি।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলে গিয়েছেন, পদার্থ মানে এনার্জি। এনার্জি মানে পদার্থ। একই মুদ্রার এ পিঠ ও পিঠ। হিসেব কষে দেখা গিয়েছে, ব্রহ্মাণ্ডের মোট পদার্থ বা এনার্জির ৯৬ শতাংশই হল ওই ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জি। এখনও পর্যন্ত অজানা। চেনা পদার্থ বলতে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন (এবং আরও কিছু কণা) মাত্র বাকি ৪ শতাংশ।
অচেনা ওই ৯৬ শতাংশ বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে খুব। ওটা কি কোনও ফোর্স বা বলের কারসাজি? এমন বল, যা অচেনা? ১৯৮৬ সালে বিজ্ঞান জগতে উঁকি দিয়েছিল অমন ফোর্স। উঁকি দিয়ে, আবার মিলিয়েও গিয়েছিল বিজ্ঞানীদের আপত্তির কারণে। যেমন-তেমন বিজ্ঞানী নয়, এক-এক জন নোবেল প্রাইজ় পানেওয়ালা বিজ্ঞানী। যেমন— রিচার্ড ফাইনম্যান, শেলডন গ্লাসো, মারে গেল-মান। ৩৫ বছর আগে পরিত্যক্ত ওই আইডিয়া আবার ফেরত এসেছে। ফেরত এসেছে অচেনা সেই বলের ধারণা। তাই পাগলা দাশুর কাহিনি মনে পড়ে গেল।
বল চার রকম। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক, (যার ক্রিয়ায় পাখার ব্লেড ঘোরে বা খাবার হজম হয়), উইক (যা তেজস্ক্রিয়তার মূলে), স্ট্রং (যার প্রভাবে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন আর নিউট্রন ঠাসাঠাসি করে থাকে) এবং গ্র্যাভিটি (যার ক্রিয়ায় গাছের আপেল মাটিতে পড়ে বা চাঁদ পৃথিবীর চার দিকে ঘোরে)। এর বাইরে আর কোনও রকম বলের হদিস এত দিন পাননি বিজ্ঞানীরা।
সে জন্য আমেরিকায় পারদু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ইফ্রাইম ফিশবাখ যে পরীক্ষা করলেন, তার ফলাফলে বিস্মিত হলেন। দেখলেন যা, তা দেখলে অবাক হতেন গালিলেও গালিলেই নিজেই। ইটালির এই বিজ্ঞানী পিসা শহরের হেলানো মিনার থেকে নাকি ফেলেছিলেন পাখির পালক এবং লোহার বল। সে দুটো নাকি এক সঙ্গেই মাটিতে পড়েছিল। অভিকর্ষের তত্ত্ব প্রমাণে কাজে লেগেছিল ওই পরীক্ষা। নাহ্, একই পরীক্ষা করেননি ফিশবাখ। তাঁর পরীক্ষা জটিল, তা বোঝাও কঠিন। তবে সোজা কথায়, তাঁর পরীক্ষা যেন দেখাল, উঁচু থেকে এক সঙ্গে ফেললে লোহার বল আগে মাটিতে পড়বে। চার রকমের বাইরে পাঁচ নম্বর বলের ক্রিয়া ছাড়া এটা সম্ভব নয়। বিস্মিত ফিশবাখ পরীক্ষার সবিস্তার বর্ণনা দিয়ে জার্নালে ছাপলেন পেপার। ৮ জানুয়ারি, ১৯৮৬। নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রথম পাতায় ছাপল খবর। শিরোনাম “হিন্টস অব ফিফথ ফোর্স ইন ইউনিভার্স চ্যালেঞ্জ গালিলেও’স ফাইন্ডিংস”। লেখক বিজ্ঞান সাংবাদিক জন নোবল উইলফোর্ড।
নোবেলজয়ী গেল-মানের জীবনী (স্ট্রেঞ্জ বিউটি: মারে গেল-মান অ্যান্ড দ্য রেভলিউশন ইন টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফিনিক্স) লিখেছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের আর এক বিজ্ঞান সাংবাদিক জর্জ জনসন। বইয়ের মুখবন্ধে তিনি বর্ণনা করেছেন গেল-মানের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ। বিজ্ঞানের এক কনফারেন্সে দেখা। এবং আলাপ। জনসনও নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক শুনে গেল-মানের তাচ্ছিল্য প্রকাশ। কারণ? ওই কাগজেই তো ‘উইলফোর্ড লোকটা’ ছাইভস্ম লিখেছে! জনসন বুঝলেন ফিফথ ফোর্স রিপোর্টে বেজায় চটেছেন বিজ্ঞানী।
সে যা-ই বলুন গেল-মান, পঞ্চম বলের ধারণা কিন্তু বিজ্ঞানীদের মনে ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এ ব্যাপারে সঙ্গত করছে। হাঙ্গেরির নিউক্লিয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী অ্যাটিলা ক্রাসৎজনাহোরকি বেরিলিয়াম মৌলের বিশেষ এক পরমাণু নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। পরমাণুটি তেজস্ক্রিয়। মানে, তার নিউক্লিয়াস ভেঙে কণা বার হয়। নিউক্লিয়াস থেকে চিমটি কেটে কিছুটা এনার্জি নিয়ে ক্রাসৎজনাহোরকি তেজস্ক্রিয় হিলিয়াম মৌলের পরমাণু নিয়েও পরীক্ষা করেছেন। দু’ক্ষেত্রেই পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে কণা বেরোচ্ছে। সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা, সে কণা বিচিত্র। তার ভর ইলেকট্রনের প্রায় ৩৩ গুণ। এমন কণা বিজ্ঞানীরা চেনেন না। সে কণা আবার ভাঙছে। তৈরি হচ্ছে ইলেকট্রন এবং পজ়িট্রন (যে কণার সব ধর্ম ইলেকট্রনের মতো, কেবল ইলেকট্রিক চার্জ ইলেকট্রনের উল্টো) কণা।
কণা ভেঙে ও রকম ইলেকট্রন-পজ়িট্রন তৈরি হলে, নবজাত দুই কণা মোটামুটি একই দিকে ছুটে যায়। দুই ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। বেরিলিয়াম পরমাণু নিয়ে পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ইলেকট্রন এবং পজ়িট্রন যে দুই সরলরেখায় ছুটেছে, তাদের মধ্যে কোণ ছিল ১৩৫ ডিগ্রি। হিলিয়াম পরমাণুর ক্ষেত্রে কোণের পরিমাণ ১১৫ ডিগ্রি। ক্রাসৎজনাহোরকির দৃঢ় বিশ্বাস, অদ্যাবধি অচেনা কোনও বলের প্রভাবে ও রকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে।
এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল শুনে প্রথমে সব কিছু সত্যি বলে বিশ্বাস করেননি ক্যালিফর্নিয়া ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী জনাথন ফেং। ভেবেছেন পরীক্ষায় ত্রুটি ছিল। অমন তো কতই হয়। পরে জার্নালে পেপার পড়ে তাঁর ধারণা পাল্টায়। সতীর্থদের পেপারের লিঙ্ক পাঠিয়ে পড়তে বলে তিনি জুড়ে দেন এক শব্দের ছোট্ট কমেন্ট— ‘ওয়াও!’
বিজ্ঞানে এই ‘ওয়াও’ মন্তব্য আর এক ঘটনা মনে পড়ায়। ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির রেডিয়ো টেলিস্কোপে কাজ করছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরি এমান। ভিন্গ্রহে প্রাণী খোঁজার (সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রকল্পে। ১৯৭৭ সালের ১৫ অগস্ট তিনি এমন সঙ্কেত পান, যা তাঁর মনে হয় দূরে কোনও বুদ্ধিমান প্রাণীর পাঠানো। সঙ্কেতের কম্পিউটার প্রিন্ট আউটের পাশে এমান লাল কালিতে লেখেন ‘ওয়াও’! সেই থেকে ওই সঙ্কেত ‘ওয়াও সিগন্যাল’ নামে পরিচিত। ওই এক বারই এসেছিল ওই সঙ্কেত। এমান তো বটেই, আর কোনও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর কখনও পাননি অমন সঙ্কেত। সেই থেকে ধন্দে বিজ্ঞানীরা। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ দাবি করেন যে, পৃথিবীতে কোনও উৎস থেকে মহাকাশে পাঠানোর সঙ্কেত কোনও বস্তুপিণ্ডে প্রতিফলিত হয়ে এমানের রেডিয়ো টেলিস্কোপে ধরা পড়েছিল। সে তত্ত্বও ধোপে টেকেনি। মোদ্দা কথা, ‘ওয়াও সিগন্যাল’ জ্যোতির্বিভাগে একটা প্রহেলিকা হিসেবেই টিকে আছে।
পঞ্চম বলের ভাগ্যেও কি তেমনই লেখা আছে? উত্তর দেবে ইটালির ফ্রাসকাতি শহর। ওখানে চলেছে পজ়িট্রন অ্যানিহিলেশন ইনটু ডার্ক ম্যাটার এক্সপেরিমেন্ট (পিএডিএমই) প্রকল্প। গবেষকরা নতুন করে পরীক্ষা করবেন বেরিলিয়াম এবং হিলিয়াম পরমাণু নিয়ে। ফলাফল জানা যাবে আগামী বসন্তে।
তত দিন প্রতীক্ষা। দাশুর জন্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy