Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Children

শৈশব কেবল যুদ্ধেই বিপন্ন নয়

শিশুরা আর স্বপ্ন দেখে না। সেই ইজারা অভিভাবকেরাই নিয়ে বসে আছেন। নিজেদের নষ্ট, ভ্রষ্ট স্বপ্ন সন্তানের মনে গেঁথে দেন।

—প্রতীকী ছবি।

অরবিন্দ সামন্ত
শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫২
Share: Save:

খবরে নিয়মিত পড়ছি যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজ়া ভূখণ্ডে বিপন্ন শিশু ও সন্ত্রস্ত শৈশবের কথা। কিন্তু আমাদের আপাত শান্তিকল্যাণময় ভূখণ্ডেও কি শিশুরা নিরাপদ? যৌথ বা খণ্ডিত, উভয় পরিবারেই নানা অনুচ্চারিত অনুশাসন আর ভ্রুকুটি-শাসনে শিশু আজ সন্ত্রস্ত। অতি সতর্ক তার পদচারণা, কথাবার্তাও বড়দের মতোই সুচিন্তিত, কাজ সুনিয়ন্ত্রিত। ঘরে ঘরে এ ধরনের বয়স্ক শিশুর প্রাদুর্ভাব। হত্যাধ্বস্ত বিশ্বের বাইরেও যে শৈশবকে নিঃশব্দে হনন করেছি আমরা, অভিভাবকের দল তা বুঝি কি?

শিশুরা আর স্বপ্ন দেখে না। সেই ইজারা অভিভাবকেরাই নিয়ে বসে আছেন। নিজেদের নষ্ট, ভ্রষ্ট স্বপ্ন সন্তানের মনে গেঁথে দেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্রই শিশুটি গিনিপিগে রূপান্তরিত! মানসিক ও শারীরিক পরীক্ষার চাপের মধ্যে বড় হয়। সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশ ক্ষুণ্ণ হয়। মানসিক যন্ত্রণা শরীরের পরিবর্তন ঘটায়। ক্ষুধা ব্যাহত হয়, সহজেই ক্লান্ত হয়, আবেগ প্রকাশে মুশকিলে পড়ে, সামাজিক ভাবে সঙ্কুচিত হতে থাকে।

ব্রেন সার্কিট আর টেস্টোস্টেরন সিস্টেম শৈশবেই গঠিত হয়। এই স্নায়ু-জৈবিক ব্যবস্থাগুলি কর্মক্ষমতায় সাহায্য করে, আর শৈশব থেকেই বেঁচে থাকতে তা জরুরি। মানসিক চাপ অনুভব করলে শিশুর শরীর হরমোন নিঃসরণের মাধ্যমে সেই চাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এই চাপ অবিরাম এবং দীর্ঘায়িত হলে ভবিষ্যতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকি বাড়ে। শিশুদের মস্তিষ্কের সার্কিট দুর্বল, তাই শৈশবে নিরন্তর চাপ মস্তিষ্কের জন্য জরুরি সংযোগের বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে। গবেষণা বলছে, ক্ষতিকর চাপ ছোটদের মস্তিষ্কের সার্কিট গঠন ও বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে। দেখা গিয়েছে, যে শিশুরা দীর্ঘ কাল চরম মানসিক চাপ ভোগ করেছে তাদের মস্তিষ্ক ছোটই রয়ে গিয়েছে। স্বল্পমেয়াদি স্মৃতির পরীক্ষাতেও তারা সমস্যায় পড়ে।

অভিভাবকীয় সন্ত্রাস শুধুমাত্র শিশুর বাবা-মায়ের অপূর্ণ স্বপ্ন বহনের ক্লান্তির মাধ্যমেই আসে না। তাঁদের অসহিষ্ণুতা, দাম্পত্য বিরোধ থেকেও আসে। ফলে, শিশুর আচরণের পরিবর্তন হয়, আবেগের প্রকাশ ও সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তারা শেখে যে, রেগে গেলে তুমুল ঝগড়া, গায়ে প্রচণ্ড আঘাত এবং কুৎসিত দোষারোপ করতে হয়। ইউনিসেফ বলছে, যে শিশুরা গার্হস্থ হিংসা দেখে বড় হয়, ভবিষ্যতে তাদের মেলামেশায় সমস্যা হয়, অপরাধমূলক কাজে প্ররোচিত হয়, হিংসার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজে। বেড়ে ওঠে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, বিষণ্ণ মানুষ হিসাবে। লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব সাইকায়াট্রিস্টস-এর মতে, যে পরিবারে গার্হস্থ হিংসা আছে, সেখানে উদ্বিগ্ন শিশুরা পেটব্যথার অভিযোগ করতে পারে, ঘুম অনিয়মিত হয়, বিছানা ভেজাতে শুরু করতে পারে।

মনোবিদরা বলছেন, বাচ্চার বিশ্বজগৎ তার বাবা-মাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। বাবা-মায়ের সম্পর্ক স্থিতিশীল না হলে সন্তানের জন্য কোনও কিছুই বিশ্বস্ত ও স্থিতিশীল থাকে না। সন্তানের নিরাপত্তার অনুভূতিটাই মরে যায়। গবেষণা বলছে, প্রায় এক বছর বয়স থেকেই শিশু তার পরিবারের অশান্তির আবহ বুঝতে শেখে। বাবা-মা ঝগড়া মিটমাটের কপট অভিনয় করলেও শিশু মিথ্যাচারটি ধরে ফেলে। অনেক শিশু বাবা-মায়ের ঝগড়া থামাতে নিজেই উদ্যোগী হয় স্রেফ আতঙ্কিত হয়ে, ভালবেসে নয়।

যে শিশু মন খারাপ করে থাকে, বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে বড় হয়, তার পক্ষে স্বাভাবিক কাজও কঠিন হতে পারে। অথচ, এই অভিভাবকরাও শিশুদের প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতায় সহপাঠীদের সঙ্গে লড়িয়ে দেন। প্রতিযোগিতার বাড়তি চাপ সে নিতে পারে কি না, সেই ভাবনা ভাবাই হচ্ছে না। সমীক্ষা জানাচ্ছে, কলকাতায় ৩০% পুরুষ আর ১৭% মহিলা শিক্ষকের বিশ্বাস— শৃঙ্খলা শেখাতে শারীরিক শাস্তি প্রয়োজন। স্কুলশেষে বাড়ি। গৃহশিক্ষক কিংবা কোচিং ক্লাস শেষ হতে হতেই সন্ধে গড়িয়ে যায়। তার পর হোম টাস্ক। সারা দিনের নিশ্ছিদ্র নিরবসর। স্কুল, বাড়ি কোনওটাই বিনোদন-নির্ভর নয়। খেলাধুলা করবে কী, বেচারা তো সোজা দাঁড়াতেই পারে না। পিঠ ব্যথায় কাতরায়। শিশু অস্থিবিদ্যার চিকিৎসকরা বলেন, শিশু সামর্থ্যের চেয়ে বেশি ওজনের বোঝা বয়ে বেড়ায়। স্কুলব্যাগের বোঝা। শিক্ষাব্যবস্থাও শিশুবান্ধব নয়।

আর যারা শৈশব থেকেই সংসারসীমান্তের বাইরে গিয়ে পেটের চিন্তায় দিন গুজরান করে, তাদের কী হাল? দক্ষিণ কলকাতার কিছু পরিবারে, চায়ের স্টলে, গ্যারাজে, দোকানে ১২০ জন অভিবাসী শিশুশ্রমিকের উপর সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, অধিকাংশই শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার। দেশের মেট্রো শহরগুলিতে পথশিশু বাড়ছে। তারা দুর্ব্যবহার, শোষণের শিকার। লিঙ্গ পার্থক্যের গবেষণাগুলিতে দেখা গিয়েছে যে, মেয়েরা শৈশবে ছেলেদের তুলনায় বেশি অবহেলা, নির্যাতনের শিকার।

ঘরে বাইরে সর্বত্র শিশুরা আজ আক্রান্ত, বিপন্ন, সন্ত্রস্ত— শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়। বড়দের স্বপ্নপূরণের দায় মাথায় নিয়ে তারা এতই দিশেহারা যে সেই কষ্ট আর দুর্ভাবনাও যেন আমরা কম করে না ভাবি। শৈশব বিষয়ে বড়দেরই আজ আত্মসমীক্ষণ জরুরি।

অন্য বিষয়গুলি:

Children Domestic Violence Society Relationship
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy