স্ববিরোধী: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ, হলদিয়া, ৭ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই
পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে ‘বহিরাগত’ শব্দটির ব্যবহার অনেক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, বাইরে থেকে প্রচারের নামে হানাদার বাহিনী আসছে। এরা বহিরাগত, যারা বাংলার সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ভাষা বোঝে না। এরা বাইরের শাসন, আধিপত্য, এবং নিয়ন্ত্রণ বাংলার উপর চাপাতে উদ্যত। দক্ষিণপন্থী বিরোধীরা বলেন, যাঁদের বহিরাগত আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা বাংলার সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করেন। তাঁরা ভারতীয়; এবং বাংলা ভারতেরই অন্তর্গত। তাঁদের রাজ্যপালের বক্তব্য, বহিরাগত ধারণা অথবা বহিরাগত ধারণার এহেন প্রয়োগ সংবিধান-বিরোধী। ভারতীয় হিসেবে যে যেখানে গিয়ে প্রচার করতে চায় করতে পারে। ভারত সব ভারতীয়ের। অতএব কিসের বহিরাগত? কেন বাইরের রাজনৈতিক প্রচারকদের বহিরাগত বলা হবে?
এক দিকে বাংলার পরিচিতি সম্পর্কে জনবাদী ধারণা, অন্য দিকে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং অবাধ গতিবিধির অধিকারের দাবি— এই দুইয়ের সংঘর্ষ ‘বহিরাগত’ শব্দটিতে নতুন দ্যোতনা এনেছে। বর্গিরা ছিল বহিরাগত, মোগল বাদশা আকবর ছিলেন বহিরাগত, যাঁর বিরুদ্ধে বারো ভুঁইয়ার লড়াই, হানাদারদের বিরুদ্ধে তিতুিমরের বাঁশের কেল্লা। আবার বারংবার বাংলায় ঘুরে যাওয়া গাঁধীজিও ছিলেন বহিরাগত। একই শব্দের নানা তাৎপর্য, প্রেক্ষাপট বিশেষে যার দ্যোতনা।
অথচ, ভুলে যাওয়ার উপায় নেই যে, দেশ জুড়ে পুঁজির সাবলীল সচলতা আছে। সেই মাত্রায় শ্রমের সাবলীল গতিশীলতা নেই। মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিক, বিহারি শ্রমিক, বাঙালি শ্রমিক— শ্রমজীবী মানুষ রাজস্থানে, মধ্যপ্রদেশে, গুজরাতে, মহারাষ্ট্রে অন্তহীন বৈষম্যের শিকার। কোথাও প্রাণ দিতে হয়েছে, কারণ, তাঁরা বহিরাগত। বহিরাগত শ্রমিক।
আবার, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ভূমিপুত্রের অগ্রাধিকার থাকবে, এই দেশে এটা প্রচলিত হয়ে গিয়েছে। সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের নামে যাঁরা অষ্টপ্রহর পুজো করেন, তাঁরা অনেকেই ভূমিপুত্রের অগ্রাধিকার মেনে নেন। বহিরাগতদের পিছনে ঠেলে দিতে, সারা জীবন দেশেই বসবাসকারী মানুষদের বহিরাগত আখ্যা দিয়ে বন্দিশিবিরে নির্বাসিত করতে দ্বিধা করেন না তাঁরা।
‘বহিরাগত’ শব্দটির সংজ্ঞা তবে কী? উত্তর খুঁজতে গিয়ে চোখের সামনে যা ঘটছে, তার দিকে বরং নজর ঘোরানো যাক। আমি দিল্লি মহানগরীর সীমানায় সমবেত হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কৃষকের কথা বলছি। তাঁরা মহানগরীতে ঢুকতে পারবেন না। তাঁদের প্রবেশাধিকার নেই। তাঁরা বহিরাগত।
সিংঘু, গাজ়িপুর এবং টিকরির কৃষক সমাবেশ যাতে মহানগরীর দিকে না এগোয়, দু’মাসের বেশি সময় ধরে এই তিন স্থানের রাস্তা বন্ধ। কংক্রিটের দেওয়াল, কাঁটাতার, রাস্তায় পেরেক পুঁতে কৃষকদের দিল্লি অভিযান প্রতিহত করা হচ্ছে। তাঁরা ভারতীয়, তবু দেশের রাজধানীতে তাঁদের প্রবেশ অবৈধ, কেন? তাঁরা দিল্লির মানুষ নন, তাঁরা বহিরাগত।
সীমানা এখানেও তৈরি হয়েছে। অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ এবং আধুনিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার সাহায্যে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে শত্রু প্রতিহত হচ্ছে। এ যেন এক আন্তর্জাতিক সীমানা। সীমারেখা কঠোর ভাবে নির্ধারণ করে তাকে সামলানো হচ্ছে নানা উপায়ে। কৃষকদের এখন মহানগরীতে প্রবেশ নিষেধ। তাঁরা বহিরাগত।
বিক্ষুব্ধ কৃষকদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক কণ্ঠস্বরও বহিরাগতদের কণ্ঠস্বর। এ দেশ নিয়ে অন্য দেশের লোক কথা বলবে কেন? যদিও আমরা পূর্বতন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচন বিজয়ের পক্ষে কথা বলতে পারি। সেটা বহিরাগতের কণ্ঠস্বর নয়। বিক্ষুব্ধ কৃষকদের উপর সিংঘুতে চড়াও হল যে আক্রমণকারীরা তারা বহিরাগত নয়, কৃষকরা যাঁরা জড়ো হয়েছেন, তাঁরা বহিরাগত। তাঁদের সরে যেতে হবে। এই ছিল দাবি।
সীমানা নানা ধরনের। বহিরাগতও তাই এক-এক পরিস্থিতিতে এক-এক অর্থ বহন করে। পশ্চিমবঙ্গে অন্য প্রদেশের রাজনৈতিক নেতাদের অভিযানকে বহিরাগতদের আগ্রাসন বলে যে সমালোচনা, তাতে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ ধুলোয় মিশে গেল বলে যে হাহুতাশ চলছে, তাতে তাই বিস্মিত হতে হয়।
যাঁরা তামিল জাতীয়তাবাদের ইতিহাস জানেন, তাঁরা বলতে পারবেন যে, কী ভাবে ভাষা, ব্রাহ্মণ-বিরোধী আন্দোলন, এবং কুসংস্কার বিরোধিতা তামিল সমাজের গণতন্ত্রীকরণের পথকে প্রশস্ত করেছিল। তামিল সত্তার গণতন্ত্রীকরণের এ চেষ্টা অব্যাহত। একই ভাবে প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ দেখিয়েছিলেন যে, কেরলের মালয়ালি সত্তার গণতন্ত্রীকরণ কী ভাবে এগিয়েছে। এক-এক ভাষাভিত্তিক জাতীয় গণতান্ত্রিক চেতনা এক-এক নির্দিষ্ট পথে এগিয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রীকরণ, পরিচিতি গঠন, এবং বিশেষ সত্তা অর্জন ভারতের সর্বত্র অল্পবিস্তর ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে।
বাংলায় আমরা আজ যা প্রত্যক্ষ করছি, তা এই প্রক্রিয়ারই এক নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি। এই পথে বিপদও আছে। সত্তা অর্জন এবং গণতন্ত্রীকরণ— এই দুইয়ের মিলনের যাত্রপথে কাঁটা আছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিহারি শ্রমিকের উপর আক্রমণ, হত্যা, ‘বহিরাগত’ অভিযোগে বড়োল্যান্ডে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, হাজারে হাজারে লোককে বিতাড়ন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিচিতি অর্জনের ইতিহাসকে কলুষিত করেছে। এই বিপদ বাংলার আগামী ইতিহাসে নেই, বলা যায় না।
তবু বাংলার পুরনো ইতিহাসই এই সম্ভাব্য পরিণামকে ঠেকানোর এক নিশ্চিত সম্বল। বাংলার জনবাদী আন্দোলনকে তার যাথার্থ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বারংবার ফিরে তাকাতে হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে। বার বার বলতে হচ্ছে, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নজরুল, সুভাষচন্দ্র— এঁদেরকে ঘিরেই বাঙালি পরিচিতির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। কিন্তু এতেই শেষ নয়, গুরুচাঁদ, সিধু কানু, পঞ্চানন বর্মা, এবং এ রকম আরও ঐতিহাসিক চরিত্র বাঙালি পরিচিতি গঠনের সাম্প্রতিকতম অধ্যায়ে আজ পুনরাবির্ভূত।
এতেও শেষ নয়। পাহাড় থেকে জঙ্গলমহল, চা শ্রমিক থেকে আসানসোলের খনি শ্রমিক— সবাই বাংলার অধিবাসী। তাঁরা বাঙালি। তাঁরা বহিরাগত নন। এই রকম এক উদার বাঙালি পরিচিতি গড়ে তোলা সহজ কথা নয়। এক দিকে উচ্চবর্ণাধিপত্য চিহ্নিত ঊনবিংশ শতাব্দীর উদার ঐতিহ্য এই কর্মসূচির পাথেয়; আবার, অন্য দিকে বর্ণাধিপত্য ভেঙে সমগ্র বাংলা জুড়ে অধোবর্ণের এবং অধোবর্গের সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে বাঙালি পরিচিতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রূপে বাংলার সামনে হাজির করা এক দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। বহু জিনিসই ইতিহাসে ঘটে, যা খুব চিন্তাপ্রসূত হয় না। কিন্তু মার্ক্স যাঁকে বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের অচেতন অস্ত্র’, ওই রকম অর্থে আজকের ‘বহিরাগত’ সংক্রান্ত বিতর্ক বাংলার এক গণতান্ত্রিক সত্তা অর্জনে সাহায্য করবে।
কাজেই রাজনৈতিক সংগ্রামে ‘বহিরাগত’ শব্দটি বার বার ফিরে আসবে। মোগল হানাদাররা বহিরাগত, ফিরিঙ্গি দখলদাররা বহিরাগত, ইতিহাসের এই দ্বন্দ্বের শেষ নেই। নিত্যকালের প্রতিক্ষণে যে অঘোষিত সামাজিক যুদ্ধ চলেছে, তাতে পরিখা কাটা হচ্ছে নিরন্তর, সীমানা নির্ধারিত, পুনর্নির্ধারিত হচ্ছে। পরিখার আশ্রয় নিয়ে সৈনিকরা এই সামাজিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এই সীমানা নির্ধারণের রণধ্বনি মাঝে মাঝে আমাদের কানে আসে। যেমন, নির্বাচন কালে। তখন অনেকে নীতিবাক্য স্মরণ করে বলে ওঠেন, বহিরাগত বলে কিছু নেই। আমরা সবাই এক, আমরা দেশবাসী। সমগ্র দেশে আমাদের অবাধ প্রবেশ।
কিন্তু, নির্বাচনোত্তর আবহে বাংলার সামনে এক সুদূরপ্রসারী প্রশ্ন থেকে যাবে: বহুত্ব স্বীকার করে বাংলার নিজস্ব সত্তা গড়ে তোলার স্বপ্নের কী হবে? কবির ভাষায় সীমার মাঝে অসীম সন্ধান কী করে সম্ভব হতে পারে? কাব্যের অতীন্দ্রিয় মণ্ডল থেকে নেমে রাজনৈতিক-সামাজিক কৃষ্টির জগতে এই নির্মাণে কি ব্রতী থাকা যাবে?
শিক্ষিত সমাজ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর দিকে যতই ব্যঙ্গোক্তি ছুড়ে দিক না কেন, যে দুরূহ প্রশ্ন তিনি আমাদের সামনে হাজির করেছেন, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
হয়তো এই চৈতন্য অর্জনের পাথেয় হল চিরায়ত বাংলার কল্পনা। বিস্ময়ের কী আছে যে, বহিরাগতদের থেকে বাংলাকে বাঁচাতে গিয়ে জনবাদী বা জনপ্রিয়তাবাদী আন্দোলনকে আজ বার বার স্মরণ করতে হচ্ছে, যাকে গত শতাব্দীতে কাজী আবদুল ওদুদ নাম দিয়েছিলেন ‘শাশ্বত বঙ্গ’— সেই চিরায়ত বঙ্গের ধারণাকে?
সমাজবিজ্ঞানী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy