দেখতে দেখতে দু’সপ্তাহ পার হয়ে গেল। ২৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ম্যানহোলে মারা গিয়েছিলেন মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর এলাকার পূর্ব তালসুর গ্রাম থেকে কাজ করতে আসা তিন ভাই— মহম্মদ আলমগীর (৩৫), জাহাঙ্গীর আলম (২২) এবং সাবির হোসেন (১৯), আর তাঁদের প্রতিবেশী লিয়াকত আলি (২০)। তার পর শহরের নর্দমায় অনেক জল বয়ে গেছে। ভোটের হাওয়ায় উথলে ওঠা বীভৎস মজার তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে কত ক্ষণ আর পেটের তাগিদে ম্যানহোলে নেমে মরে যাওয়া চারটে ছেলের কথা মনে রাখা যায়?
এই মৃত্যুর পিছনে যে নির্মম অবহেলার দিনলিপি, তা নিয়ে পবিত্র ক্রোধ উদ্গিরণের বা আবেগমথিত হা-হুতাশের কোনও অর্থ নেই। ও-সব অনেক হয়েছে। এ-ঘটনার পরে আমরা আরও এক বার জেনেছি, নিকাশি নালায় বিপজ্জনক কাজ করার জন্যে যে সব নিরাপত্তার আয়োজন দরকার, আইনকানুনে সে বিষয়ে যে সব নির্দেশ আছে, সচরাচর কেউ তার তোয়াক্কাই করে না। গ্যাস-মাস্ক সহ নানা রক্ষাকবচের, এমনকি কোমরে দড়ি বেঁধে রাখার সামান্যতম ব্যবস্থাটিও করা হয় না। প্রায়শই দেখা যায়, যাঁরা নামছেন তাঁদের এ-কাজের কোনও অভিজ্ঞতা বা ধারণা নেই— কী ধরনের বিপদ ঘটতে পারে, তা থেকে বাঁচবার জন্যে কী কী করা দরকার, কেউ তাঁদের সে-কথা জানানোর প্রয়োজন মনে করে না। ছোট বড় দুর্ঘটনা লেগেই থাকে, কেউ মাথা ঘামায় না। নেহাত প্রাণহানি ঘটলে, এবং সেই মৃত্যু সংবাদ হয়ে উঠলে, দু’এক দিন দু’চারটে বাঁধা গত শোনা যায়, ‘কমিটি’ বসে, তার পর গভীর যবনিকা। চারটে তরতাজা প্রাণ এ ভাবে চলে গেল কেন, সেটা কোনও প্রশ্নই নয়। আরও অনেক প্রাণ কেন বেঘোরে চলে যায় না, সেটাই বরং বিস্ময়ের ব্যাপার।
এই অবহেলার উল্টো পিঠে আছে গরিবের অতলান্ত অসহায়তা। গ্রামে কাজ নেই, অতিমারির বাজারে অন্য রাজ্যে যেতে ভয়, সেখানকার যোগাযোগও হয়তো বিচ্ছিন্ন, অতএব আরও অনেকের মতোই ওঁরা কলকাতায় এসেছিলেন কাজের খোঁজে। কী কাজ করেন, বাড়ির লোক জানতেন না। না-জানাই দস্তুর। অনেকেরই কাজের কোনও ঠিকঠিকানা থাকে না, যেখানে যখন যে কাজ পান সেটাই করেন। মজুরির কোনও ধরাবাঁধা হিসেব নেই, থাকলেও সেই অনুসারে হাতে মজুরি পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। যখন যেটুকু টাকাকড়ি বাড়িতে পাঠাতে পারেন, পাঠান। মোবাইলে মাঝে মাঝে ফোন করতে পারেন। সে-দিনও, ম্যানহোলে নামার আগে, আলমগীর বাড়িতে ফোন করেছিলেন, লিয়াকত তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর শরীরের খবর নিয়েছিলেন। তার পর নিজেরা খবর হয়ে গেলেন। সেই খবর যখন বাড়িতে পৌঁছল তখন পরিবার পরিজন জানতে পারলেন, কী কাজ করতে গিয়ে এই মৃত্যু। এমনটা হয়েই থাকে ওঁদের জীবনে, দূরদেশে কাজ করতে গিয়ে কেউ মারা গেলে তখন বাড়ির লোক তাঁর কাজের হদিস জানতে পারেন।
এই ছবি ব্যতিক্রম নয়, এটাই নিয়ম। সামনে এলে আমরা একটু নড়াচড়া করি। এক বছর আগে করোনা যখন আছড়ে পড়ল, অগণন শ্রমিকের দুর্দশা দেখে আমরা শিহরিত হয়েছিলাম। কিন্তু যে অসহায়তা আর অবহেলার যুগলমিলনে জলজ্যান্ত মানুষ ম্যানহোলে দম আটকে, বিষাক্ত গ্যাসের ঝাঁঝে মারা যায়, দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে হেঁটে চলা শ্রমিকদের মর্মান্তিক ছবিগুলিও তো তারই পরিণাম। এমন অভিজ্ঞতার পরে আমরা কী করলাম? যাঁরা দেশ চালাচ্ছেন, তাঁরা কী করলেন? বিপর্যয় মানুষকে অনেক কিছু শেখায়, সেই শিক্ষা থেকে পরিবর্তন আসে। বড় পরিবর্তন। পৃথিবীর ইতিহাসে তার নিদর্শন আছে। আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা কি তেমন নিদর্শন রচনায় ব্রতী হলেন? অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত যে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নেই, কাজের সুস্থ নিরাপদ পরিবেশ এবং পরিকাঠামো নেই, তাঁদের সুরক্ষার আয়োজনে উদ্যোগী হলেন কি?
না। তাঁরা অতিমারির সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শ্রম আইন ‘সংস্কার’-এর জন্য বিল পাশ করিয়ে নিলেন সংসদে। সংগঠিত ক্ষেত্রে অল্পসংখ্যক শ্রমিকের জীবিকার যেটুকু নিরাপত্তা এখনও আছে, কাজ করতে গিয়ে স্বাস্থ্যহানি বা দুর্ঘটনা নিবারণের যেটুকু ব্যবস্থা আছে, সেই ব্যবস্থা জারি রাখার যেটুকু আইনি বাধ্যবাধকতা আছে, সেটাও এই সংস্কারের কল্যাণে বরবাদ হবে। নতুন শ্রম আইনগুলি নিয়ে গত কয়েক মাসে কিছু তর্কবিতর্ক হয়েছে, শ্রমিক সংগঠন ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি কিছু আন্দোলন, সমাবেশ, ধর্মঘট করেছে, যদিও তার ব্যাপ্তি এবং গভীরতা দুইই সীমিত। সংস্কারের অন্যান্য প্রসঙ্গ সরিয়ে রেখে এখানে শুধু ‘অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশনস’ সংক্রান্ত আইনের একটি অংশের দিকে নজর দিতে পারি। একটি সংস্থায় কর্মীর সংখ্যা যদি ১০ (সংস্থাটি বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে) বা ২০-র (সংস্থাটি বিদ্যুৎ ব্যবহার না করলে) কম হয়, তা হলে এই আইন সেই সংস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হত না। শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা রক্ষার মতো দায়িত্ব থেকে ছোট সংস্থাকে কেন ছাড় দেওয়া হবে, সেটাই স্বাভাবিক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু সে-প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া দূরে থাকুক, সরকার উল্টো পথে হেঁটেছে। আইনটির নতুন সংস্করণে ছাড়ের নিম্নসীমা কমানো হয়নি, বাড়িয়ে করা হয়েছে যথাক্রমে ২০ ও ৪০। অর্থাৎ, আরও বহু সংস্থা এখন এই আইন থেকে রেহাই পেয়ে গেল। আইন থাকতেও অনেক মালিকই শ্রমিকের স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তা বিধানের শর্ত বেমালুম অমান্য করে, এখন আর আইন ভাঙার প্রয়োজনও থাকল না। এহ বাহ্য। অতঃপর কোনও রাজ্য সরকার ‘অর্থনৈতিক কাজকারবার বা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির স্বার্থে’ যে কোনও নতুন কারখানাকে এই আইনের আওতা থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার কোনও দায়ই কার্যত নিয়োগকর্তাদের থাকবে না।
তথাকথিত উদার অর্থনীতির প্রবক্তারা দীর্ঘ দিন ধরেই বলে আসছেন, শ্রমের বাজার থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিলে বিনিয়োগ বাড়বে, শিল্পের প্রসার হবে। শ্রমিক-কর্মীদের পুরোপুরি পুঁজিমালিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার এই পাইকারি ব্যবস্থাপত্রটি বিনিয়োগ তথা অর্থনীতির প্রসারে সত্যিই সাহায্য করে, এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। ইতিমধ্যে, শ্রম আইন সংস্কারের তোয়াক্কা না করেই, অনেক দিন ধরে সর্বত্র, এমনকি সরকারি কাজেও ঠিকা কর্মী নিয়োগের মাত্রা বিপুল ভাবে বেড়েছে, তাতে অর্থনীতির কোন শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, ঈশ্বরও জানেন না। কিন্তু নেহাতই তর্কের খাতিরে এই ‘জুমলা’টি মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায়: কেমন সেই উন্নয়ন, যা তার কারিগরদের সুস্থ এবং নিরাপদ কাজের ন্যূনতম সংস্থান করতেও নারাজ? স্বাধীনতার পৌনে-শতবার্ষিকীর চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভারতের শ্রমজীবী মানুষকে কেবল প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে যেতে হবে? মানুষ হিসেবে তাঁর কোনও দাবি থাকবে না? ম্যানহোলে নেমে, বহুতল ইমারতের কার্নিশ থেকে পড়ে গিয়ে, রক্ষণাবেক্ষণহীন বয়লার ফেটে, আগুন নেবাতে গিয়ে বেমালুম মরে যাওয়া স্বাভাবিক বলে গণ্য হবে? মানুষ হিসেবে ন্যূনতম মর্যাদার দাবি নাকচ করে দিয়ে নীতিকাররা উন্নয়নের নামে পুঁজির ওপর সব নিয়ন্ত্রণ, সব নজরদারি তুলে দেবেন?
হ্যাঁ, সেটাই তাঁরা করছেন। এবং করবেন, যদি না শ্রমজীবী মানুষের সংগঠিত রাজনীতি সেই সর্বনাশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে। আর সেখানেই ফিরে আসে ওই প্রশ্নটি: আমরা কী করলাম? কী করছি? কী করতে পারি? এই মুহূর্তের পশ্চিমবঙ্গে এ-প্রশ্ন যতটা জরুরি, ততটাই কঠিন। নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রচারের নামে যে কদর্য তাণ্ডব চলছে, তা নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করতেও বিবমিষা হয়। কিন্তু এই ভূতের নৃত্যের কবলে পড়ে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি এটাই যে, যা নিয়ে ভাবা দরকার, কথা বলা দরকার, গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রাম তৈরি করা দরকার, সেই মৌলিক প্রশ্নগুলি ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেও যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার কথা বলবার চেষ্টা করছেন, তাঁদের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমকে ছোট করলে মস্ত অন্যায় হবে। হতাশার কাছে আত্মসমর্পণ করার কোনও কারণ নেই, কখনওই থাকতে পারে না। এই অন্ধকারের মধ্যেও নানা নতুন সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি অনেক নতুন মানুষকে, যাঁরা বস্তাপচা রাজনীতির তরজা আর লেনদেনকে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপ করে কাজের কথা বলছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যথার্থ দাবিদাওয়াগুলিকে তুলে আনছেন ভোটের প্রচারে, সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের কবল থেকে ‘প্রগতিশীলতা’র সদর্থ উদ্ধার করছেন।
কিন্তু, অবকাশ নেই সন্তুষ্টিরও। বরং উদ্বেগের হেতু আছে। প্রগতিশীল রাজনীতির শিবিরে যে বিভাজন দুনিয়ার ইতিহাসে বার বার বিপদ বাড়িয়েছে, আমাদের চার পাশে তার দুর্লক্ষণ আজও প্রকট। মধুবংশীর গলিতে আজও ‘কে যে শত্রু ঠিক নেই, নিজেরাই মারামারি করছি, ঘরে বাইরে মরছি’। আমাদের মতের অমিল থাকতেই পারে, কিন্তু এখন অন্তর্দ্বন্দ্বের সময় নয়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের সময়। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদাই সেই লড়াইয়ের লক্ষ্য। পাখির চোখ যদি দেখতে না পারি, তবে নর্দমায় তলিয়ে যাওয়াই আমাদের নিয়তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy