Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বিদ্বেষবিষ কি অবিনাশী
Communal Violence

সংখ্যাগুরুবাদই গ্রাস করে নেবে রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ?

কাজী আবদুল ওদুদ পশ্চিমবঙ্গে থেকে গিয়েছিলেন, বাঙালি মুসলমানের ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন ও সেই আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার কথা কি আমরা ছেলেমেয়েদের পড়াই?

দীপেশ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২১ ০৫:০৯
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথের লেখনী দিয়ে ‘বরণীয়, স্মরণীয়’ মানুষেরা একদা বলেছিলেন ‘অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো’। বিচারের বাণীর মতো সে কথাও বুঝি এখন নীরবে, নিভৃতে কাঁদে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটের সময়ে দেখছি বিদ্বেষবিষের গরলে অনেক শিক্ষিত মানুষও মত্ত। প্রবাসী আমার পশ্চিমবঙ্গের গ্রামেগঞ্জে ঘুরে সাধারণ মানুষের মন বোঝার উপায় নেই। কিন্তু বন্ধুদের বিতর্কে, মিডিয়ার উপস্থাপনায় পরিচিত শিক্ষিত ও ভাল মানুষের যে মনোভাবের সাক্ষাৎ পাই তাতে প্রায়শই বাঙালির জাতি হয়ে ওঠার ইতিহাসের নানান অন্ধকার সময়ের কথা মনে পড়ে যায়। আমার ভোট নেই। বাংলার মানুষ যা চাইবেন তা শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নেব। কিন্তু প্রবাসী আমারও অন্য কোটি কোটি মানুষের মতো একটা বাঙালি মন আছে। সেই মনের যেন আর কিছুতেই ভাল থাকার উপায় নেই আজ।

বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, শিক্ষিত হিন্দু-বাঙালিরা আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক দল ভাবছেন বাংলার সবচেয়ে গভীর বিপদ নিহিত হয়ে আছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মধ্যে। আমাদের যে চাকরি প্রয়োজন, অর্থনৈতিক উন্নতি প্রয়োজন, সুস্থ রাজনীতি প্রয়োজন, দৈনন্দিন জীবনে দুর্নীতির, গুন্ডামির অবসান হওয়া প্রয়োজন, এ কথা তাঁরা অবশ্যই মানবেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা মনে করেন সবচেয়ে ভয়াবহ ভবিষ্যৎ হল এমন এক রাজনীতি, যা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক শিরদাঁড়াটিকে চিরকালের জন্য ভেঙে দিতে চায়, ও হিন্দুর সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে জোরদার করার জন্য হিন্দুধর্ম ও হিন্দুর সংস্কৃতিকে একটি অসহিষ্ণু, পিতৃতান্ত্রিক, বৈচিত্র-বিরোধী ও হিংস্র চেহারা দিয়ে একটি ক্ষমতাস্পর্ধী ‘হিন্দু’ জাতি গড়ে তুলতে চায়। সমস্ত দেশ জুড়ে এক অখণ্ড হিন্দু জাতির স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। এক সময় সত্যজিৎ রায়ের মতো মানুষেরা গর্ব করে বলতেন, ‘আমি প্রথমে বাঙালি, পরে ভারতীয়’। এতে তাঁকে দেশদ্রোহের অভিযোগ শুনতে হত না। আমাদের সেই অতি পরিচিত লাইনটিই আবার মনে পড়ে: “বিশ্বজগৎ আমারে মাগিলে কে মোর আত্মপর।” রবীন্দ্রনাথ মনে করিয়ে দিতেন বিশ্বনাগরিকতার কথা। এই ঐতিহ্য বহন করা বাঙালিরা ভয় পান যে এমন একটা রাজনীতি আমাদের ভবিষ্যৎ হয়ে আসতে পারে, যাতে এই আন্তর্জাতিকতা-বোধের, এই উদার বাঙালিত্বের বোধের ইতিহাস অবলুপ্ত হয়ে গিয়ে এক অতি সঙ্কীর্ণ, বাঙালি-নয় এমন এক ‘হিন্দুত্ব’-বোধের মধ্যে বাঙালিকে নিজের জায়গা করে নিতে হবে। এই ভবিষ্যতের বিপদকেই এঁরা হয়তো আজ সবচেয়ে বড় বিপদ বলে মনে করেন।

অন্য দিকে যে শিক্ষিত বাঙালিকে দেখি, তাঁদের মধ্যেও দু’টি ভাগ। এক শ্রেণির মানুষ এই ভবিষ্যৎকে ভয়ের কিছু মনে না করে বরং মনে-মনে ভাল ভেবেই গ্রহণ করে নিয়েছেন। তাঁরা এই মারমুখী হিন্দুত্বকেই শ্রেয় বলে মেনে নিয়েছেন। অন্য আর এক দল আছেন। এঁরা তৃণমূল-বিরোধী কিন্তু নিজেদের সাম্প্রদায়িক মনে করেন না। তাঁরা ভাবেন, হ্যাঁ, পূর্বকথিত ভবিষ্যতের বিপদ থাকতে পারে বটে, কিন্তু দৈনন্দিনের তোলাবাজি, গুন্ডাবাজি, সিন্ডিকেট ইত্যাদি বন্ধ করাটা আরও আশু প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূল্য দিয়ে যদি দৈনন্দিন জীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে তা-ই সই।

এই দু’টি অবস্থান থেকেই কিন্তু বর্তমান শাসক দল যে ‘মুসলিম তোষণ’ করে সেই তত্ত্বে পৌঁছোনো যায়। এখন যাঁরা মনে করেন পশ্চিমবঙ্গ হিন্দু-বাঙালির দেশ, মুসলমান-বাঙালিকে বা অবাঙালি মুসলমানকে এখানে মাথা নত করে এক ধরনের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়েই থাকতে হবে ও থাকা উচিত, তাঁদের ‘বিদ্বেষবিষ নাশো’ বলে কোনও লাভ নেই। মুসলিম-বিদ্বেষ তাঁদের রাজনৈতিক চেতনার উৎসস্থল। অন্য দিকে যাঁরা ভাবেন যে তাঁরা মুসলিম-বিদ্বেষী নন, কিন্তু যাঁদের কাছে তৃণমূল নেত্রীই প্রধান ও সর্বপ্রধান বিপদ, তাঁদের যুক্তি এই রকম: (১) দুর্নীতির ও অনুন্নয়নের রাজনীতি বজায় রাখতে গিয়ে তৃণমূল নেত্রী ‘মুসলিম তোষণ’ করেছেন; (২) তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে যে, এই তোষণের ফলে শহরাঞ্চলে মুসলিম-গুন্ডামির অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে হিন্দুর দৈনন্দিন জীবন অসহ্য হয়ে উঠেছে; (৩) এবং তৃণমূলের এই নীতিই হল আদি-সাম্প্রদায়িকতা, যা আজ বাঙালি হিন্দুর মনে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ, আজ যে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, তার ভিত্তিভূমি তৈরি করেছেন মমতা। মূল কারণ মুসলমানের প্রতি মমতার এক সাম্প্রদায়িক প্রীতির মনোভাব। এঁদের কাছে প্রধান শত্রু মমতা, এবং মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করাই এঁদের প্রধান লক্ষ্য। তাতে আগ্রাসী হিন্দুত্বের জয় হলে সেটাকে একটা পার্শ্ব-প্রতিক্রয়া ভাবতে হবে। এই যুক্তির নানান প্রকাশ দেখতে পাই। এই সে-দিনও এক বন্ধু তাঁর এক কলকাতাবাসী বন্ধুকে উদ্ধৃত করে লিখলেন: “[তৃণমূল] সাম্প্রদায়িক কাজকর্ম করে আজ সবাইকার মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ আমদানি করেছে।” এই দ্বিতীয় মতাবলম্বীদের যুক্তিতে বিজেপির কোনও স্পষ্ট সমর্থন থাকে না, কিন্তু বিজেপির জয়ের চেয়ে মমতার পরাজয় অধিকতর কাম্য মনে হয়। অর্থাৎ, যে কোনও মূল্যেই এঁরা তৃণমূলের ও বিশেষ করে ওই দলের ‘মুসলিম তোষণ’ নীতির ভরাডুবি দেখতে চান।

মমতার নীতির ফলে মুসলমানদের বাড়াবাড়ির যে ধরনের উদাহরণ শুনেছি তার কয়েকটি হল: রাস্তা জুড়ে প্রতি শুক্রবারে নমাজ পড়া; মুসলিম ছেলেদের হেলমেট ছাড়াই মোটরসাইকেল চড়া ও পুলিশের তোয়াক্কা না করা; ‘আরবের পয়সায়’ মুসলিমদের মসজিদের জমিজমা ও বাড়িঘর কেনা আর তার ফলে পুরনো হিন্দু পাড়া নতুন মুসলমান পাড়া হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ও আশঙ্কা।

এই কথাগুলোর সত্যাসত্য বা ব্যক্তি-মানুষের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার সত্যিই কিছু বলার নেই। আমি কলকাতায় থাকি না। এই সব কথা যাঁদের কাছে শুনি, তাঁদের অভিজ্ঞতার একটা সত্য আছে, তাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন আমাদের দেশে হাতে কাঁচা পয়সাওয়ালা অনেক সম্প্রদায়ের মানুষেরাই এই রকম আচরণ করেন। অবশ্যই রাস্তা আটকে নমাজ পড়া কেবল মুসলমানরাই করবেন, কিন্তু অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ কি কাজে-অকাজে, পুজোপার্বণে রাস্তা আটকে বা অন্য ভাবে জনজীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেন না? তখন কি আমরা তাঁকে ওই সম্প্রদায়ের নাম করে ‘অমুক-তোষণ’ বা ‘তমুক-তোষণ’ বলি? বা ধরুন, সম্প্রতি এক জন ফেসবুকে রামকৃষ্ণ মিশনের একটি আশ্রমের জমির উপর স্থানীয় কিছু দুর্বৃত্তের হামলার খবর দিয়ে দুর্বৃত্ত প্রসঙ্গে লিখেছেন ‘একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের দুর্বৃত্ত’। কিন্তু গুন্ডার তো দেশে অভাব নেই, অন্যদের ক্ষেত্রে কি আমরা তাদের সম্প্রদায় নিয়ে কথা বলি? এমনিতে বলা হয় ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর কোনও ধর্ম নেই, জাত নেই, কিন্তু ‘সেকুলার’ সন্ত্রাস, অর্থাৎ যে সন্ত্রাস ধর্মের সূত্রজাত নয়, যে সন্ত্রাসের প্রকাশ দৈনন্দিনে, তা যদি মুসলমানের হয় তা হলে সেই সন্ত্রাসের জাত ও ধর্ম দুই-ই আছে?

এ কথার উত্তরে কেউ বলতে পারেন, “দেখুন, রাজনৈতিক আশকারা না-পেলে কি আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এত সাহস হত?” রাজনৈতিক আশকারা পেলে মানুষের যে বাড়াবাড়ি হয়, সে কথা সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সত্য। কিন্তু মুসলমানদের ‘বাড়াবাড়ি’কে আমরা একটি সম্প্রদায়ের বাড়াবাড়ি বলে অনুভব করি কেন? অর্থাৎ, ফিরে আসতে হবে আমাদেরই একটি সাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসে। এটা ধার্মিক সাম্প্রদায়িকতা নয়, কিন্তু সংখ্যাগুরুর সংখ্যাগুরুত্ববাদী চেতনার সাম্প্রদায়িকতা। সব দেশেই এর সাক্ষাৎ পাই। চেতনাটি বলে, “এটা আমাদের, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দেশ; তোমরা আছ, তোমাদের ধর্মসাধনায় আমরা কোনও বাধা দিইনি, কিন্তু বাপু একটু চেপেচুপে থাকবে, এমন ভাব কোরো না, যেন এটা একই ভাবে তোমাদেরও দেশ। যদি নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারো, তা হলে অবশ্যই এখানে থাকবে। কিন্তু কোনও রকম বাড়াবাড়ি, ট্যাঁ ফোঁ চলবে না।”

আশ্চর্যের কথা কী জানেন, বিদেশে আমরা সংখ্যালঘু হিসেবে যখন এই ব্যবহার পাই, তখন একবাক্যে তাকে জাতিবিদ্বেষ বলে নিন্দে করি। কিন্তু সংখ্যালঘু মানুষ যখন পুরুষানুক্রমে পশ্চিমবঙ্গবাসী, যখন তাঁর নাগরিকত্ব ভারতীয়, আর মাতৃভাষা বাংলা, তখন? তখন এই বিশেষ বিদ্বেষবিষটি কার? সংখ্যালঘুর না সংখ্যাগুরুর?

এরও একটি আপাত-উদারবাদী উত্তর পাওয়া যায়। বলা হবে, মুসলমানদের মূলস্রোতে নিয়ে আসতে হবে, তা হলেই এই তোষণের রাজনীতি থাকবে না। কিন্তু ভাবুন, যদি সত্যিই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ জীবনের মূলধারার অংশ হতেন, যদি আমাদের চার পাশে অনেক মুসলমান নামধারী সফল ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক, সাহিত্যিক থাকতেন, তখন কি আমরা নালিশ করতাম না এই বলে যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা অনেক বেশি চাকরি নিয়ে নিচ্ছেন?

বলতে পারেন, মূলধারায় আনার চেষ্টা করে তো দেখিনি, তা হলে সংখ্যাগুরুর উদারতায় আপনি এত সন্দিহান হচ্ছেন কেন? হওয়ার কারণ আছে। হিন্দু-বাঙালি একটি আধুনিক জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার চেষ্টা করেছে সেই উনিশ শতাব্দী থেকে। আমরা তখনই আমাদের জাতি-সত্তা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত থাকতে পেরেছি, যখন আমরা মুসলমান বাঙালি প্রতিবেশীদের ভুলে থাকতে পেরেছি। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে তৈলচিত্রের সঙ্কলনটি দেখবেন। দেখবেন নজরুল কি মীর মশারফ হোসেনকে বাদ দিলে বাকি যে সব মুসলমানের প্রতিকৃতি আছে, তাঁরা সবাই নবাবি মুসলমান। উনিশ শতক জুড়ে বাঙালি মুসলমানকে আমরা গরিব কৃষক ব্যতীত অন্য কিছু বলে বিশেষ জানিনি। জনশুমারি করে যখন জানা গেল অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানেরই সংখ্যাধিক্য, তখন হিন্দু বাঙালি চমকে উঠেছিলেন। পাট চাষ করে হাতে কিছু পয়সা ও লেখাপড়ার সুযোগ পেয়ে উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় যে বাঙালি-মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হল, তাঁরা অভিমানভরে খেয়াল করলেন বাংলা সাহিত্যে মুসলমান চরিত্র প্রায় অনুপস্থিত।

স্বদেশি আন্দোলন পরিষ্কার করে দিয়েছিল যে, হিন্দু বাঙালির ‘জাতি’-কল্পনায় মুসলমান একটি ভুলে-যাওয়া গোষ্ঠী। এই নিয়ে সারা জীবন ভাবতেন যিনি, তিনি সেই অসামান্য ও ব্যতিক্রমী বাঙালি, রবীন্দ্রনাথ। যত দিনে শিক্ষিত হিন্দুর সাহিত্যে গ্রামীণ মুসলমানের কথা উঠে এল, তত দিনে হিন্দু-মুসলমানদের কাজিয়া তুঙ্গে উঠে দেশ ভাগাভাগির মুখে। ১৯২০-র দশকে দেশবন্ধু চেষ্টা করেছিলেন হিন্দু-মুসলমানকে এক রাজনৈতিক, সামাজিক বন্ধনে বাঁধতে, কিন্তু তাঁর সেই দূরদর্শী প্রচেষ্টার সূত্র তাঁর মৃত্যুর পরে কেউ ধরে রাখেননি। ফজলুল হকের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। দেশভাগের পরও বাংলাদেশি সিনেমায় হিন্দুর (শরৎচন্দ্রের) রচিত কাহিনি চিত্রায়িত হয়েছে (সম্প্রতি প্রয়াত বাংলাদেশি অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান তাতে অভিনয়ও করেছিলেন)। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট সংখ্যক মুসলমান থাকা সত্ত্বেও আমাদের সিনেমায় সাধারণ বাঙালি মুসলমানের চরিত্রচিত্রণ প্রায় হয়নি বললেই চলে। বিশ শতকের যুক্ত বাংলায় শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান যে সব ভাবান্দোলনের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তার আমরা খবরও রাখি না। কাজী আবদুল ওদুদ স্বেচ্ছায় পশ্চিমবঙ্গে থেকে গিয়েছিলেন, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন ও সেই আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার কথা কি আমরা ছেলেমেয়েদের পড়াই? কলকাতায় যাঁর নামে একটি বিদ্যালয় আছে সেই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের রচনা পড়ে ক’জন হিন্দু বাঙালি বড় হন? ও-পার বাংলার মুসলমান যে আমাদের দেশছাড়া করেছেন এই ক্ষোভে আর অভিমানে এ-পার বাংলার সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের কথা, তাঁদের ঐতিহ্যের কথা— আমাদের মিলিত সংস্কৃতিতে যার প্রতিফলন হওয়া উচিত— তাঁদের কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম।

এই ভুলে-যাওয়াটা সংখ্যাগুরুর সঙ্ঘারামে থেকে সংখ্যালঘুকে ভুলে-যাওয়া। ঠিক এমনি করে উঁচু জাতের মানুষ এক দিন নিচু জাতের মানুষকে ভুলে যেত, যদিও আজ তা করা ন্যায্যতই আগের চেয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান এমন করে সামনে এসে মাঝে মাঝে দাঁড়ান, যা আমাদের হিন্দুদের কাছে প্রীতিপ্রদ হয় না। আমরা ভাবি, এটা তোষণের ফল, এবং এই তোষণটাই মূল সাম্প্রদায়িকতা। আমাদের বৈরিতা যেন নেহাতই একটি প্রতিক্রিয়া মাত্র। এই অবস্থা থেকে কি কোনও উত্তরণের উপায় আছে? আজ একটি উপায় সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তা হল, রাজনৈতিক ভাবে সংখ্যালঘুদের এমন জায়গায় ফেলে দেওয়া, যাতে তাঁদের কথা আমাদের আর ভাবতেই না হয়, এবং তা করতে গিয়ে, অর্থাৎ তোষণের রাজনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে, আমাদের যদি এক নির্মীয়মাণ ‘ভারতীয়’ ও অখণ্ড হিন্দু সত্তার মধ্যে লীন হয়ে রামমোহন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের চেষ্টায় যে বাঙালি সত্তা তৈরি হয়েছিল— যা আজ নানান চাপে এমনিতেই বিধ্বস্ত— তাকে বিসর্জনও দিতে হয়, তাতেও পিছপা হলে চলবে না।

আজ শিক্ষা ও সংস্কৃতি-অভিমানী বাঙালিকে ভাবতে হবে, এটাই হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের বাঞ্ছিত ভবিষ্যৎ কি না।

ইতিহাস বিভাগ, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Communal Violence Religious polarization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy