আপনি ফেসবুকে নিজের পেজ খুলে ফেললেন, শিবুদা?” অবাক গলায় প্রশ্ন করে সূর্য। অবাক হওয়ার কারণ আছে বিলক্ষণ। গত বছর মার্চে যখন লকডাউন হল, তখনও শিবুদা ঘোর ফেসবুক-বিরোধী। এক বছরে এতটা হবে, সূর্যরা ভাবেনি।
“খুললাম,” লাজুক হাসেন শিবুদা। “বুঝলি, এখানে ওখানে অনেকেই নানান প্রশ্ন করে, বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স কোন ঘটনাকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবে, জানতে চায়। তাই পেজ খুলে দিলাম। এক জনকে উত্তর দিলে সবাই দেখতে পাবে।”
“তা বেশ করেছেন, কিন্তু এ রকম একটা জ্যোতিষীমার্কা নাম দিলেন কেন— ‘বিফলে মূল্য ফেরত’?” প্রশ্ন করে তপেশ।
“জ্যোতিষীমার্কা বলেই দিলাম,” শিবুদার মেজাজ ফুরফুরে, তপেশের খুচরো খোঁচায় চটলেন না। “তবে, শুধু জ্যোতিষী-তান্ত্রিকরাই নয়, তোদের অনলাইন রিটেলাররাও তো ঠিক এক কথা বলেই মাল বেচছে। চাইলে, কোনও জিনিস হাতে পাওয়ার দশ দিনের মধ্যে সেটাকে ফেরত পাঠিয়ে টাকা ফেরত পাওয়া যায়, দেখিস না? বিনা প্রশ্নে জিনিস ফিরিয়ে টাকা ফেরত দেবে, এটা হল অনলাইন রিটেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি।”
পকেট থেকে একটা লবঙ্গ বার করে মুখে ফেললেন শিবুদা। সিগারেট বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। সবাই চুপ করে আছে দেখে নিজের কথার খেই ধরে নিলেন তিনি। “জ্যোতিষীই হোক বা অনলাইন রিটেল, এই ব্যবসাগুলোর একটা চরিত্রগত মিল আছে, বুঝলি— ক্রেতা যখন পয়সা দিয়ে কোনও মাল কিনছে, সেটার কোয়ালিটি যাচাই করার উপায় ক্রেতার নেই। জ্যোতিষীর কাছে নেই, কারণ তিনি যে পাথরটি গছাচ্ছেন, সেটা আদৌ কাজ করবে কি না, তা জানা যাবে ভবিষ্যতে। অনলাইন রিটেলে নেই, কারণ সেখানে তুই ছবি দেখে পয়সা দিচ্ছিস— জিনিসটা আসলে কেমন, সেটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখার কোনও উপায় নেই। এই অবস্থায়, ক্রেতা ভরসা করবে কিসে?
“টাকা ফেরত পাওয়ার গ্যারান্টি হল সেই ভরসা। কেনার সময় যদি তুই জানিস যে, পছন্দ না হলে পুরো টাকাটা ফেরত পেয়ে যাবি, তা হলে জিনিসটা কিনলে তোর কোনও ক্ষতি নেই। পছন্দ হওয়া মানে, যে টাকায় কিনলি তার সমান বা তার চেয়ে বেশি ইউটিলিটি পেলি জিনিসটা থেকে, আর পছন্দ না হলে পুরো টাকাটা ফেরত পেলি। ফলে, অনেক সহজে জিনিসটা কিনে ফেলবি তুই। বিনা প্রশ্নে টাকা ফেরত দেয় বলেই অনলাইন রিটেলাররা ফাটিয়ে ব্যবসা করছে— এবং,” শেষ অবধি লবঙ্গটা মুখ থেকে ফেলে একটা সিগারেট ধরিয়েই ফেললেন শিবুদা, “বিহেভিয়রাল মার্কেটিংয়ের লোকরা তা নিয়ে গন্ডা গন্ডা রিসার্চ পেপার লিখছে।”
“অর্থাৎ, পয়সা ফেরত দিয়ে জিনিস ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিটা আসলে যে জিনিসটা কিনছি, তার গুণমান সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দিচ্ছে।” শিবুদা থামতে, বলল শিশির।
“একদম। এবং, যে ক্ষেত্রে পণ্যের গুণমান যাচাই করা যত কঠিন, সে ক্ষেত্রে এই প্রতিশ্রুতির মাহাত্ম্য তত বেশি।” যত্ন করে একটা রিং ছাড়েন শিবুদা। “ধর, অনলাইনে একটা জুতো কিনলি। সেটা ভাল না মন্দ, পায়ে দিলেই বুঝবি। এক দিনে না বুঝলেও, এক সপ্তাহে বুঝবিই। কিন্তু, ধর কোনও জ্যোতিষীর থেকে পাথর নিলি। তাতে কাজ হচ্ছে কি না, বুঝবি কী করে? অন্তত, যে সময়টার মধ্যে পয়সা ফেরত পাওয়ার সুযোগ আছে, সেটুকুর মধ্যে বুঝবি কী করে? সে ক্ষেত্রে, ওই যে তুই গ্যারান্টি দেখে বিশ্বাস করেছিলি, তোর সেই বিশ্বাসটাই তোর মনকে দিয়ে ভাবিয়ে নেবে যে, পাথরটা কাজ করছে।
“অবিশ্যি, যে জিনিস পয়সা দিয়ে কিনছিস না, সেই ক্ষেত্রেও কি এই গ্যারান্টির ভূমিকা নেই? আলবত আছে, একশো বার আছে। এই যে পাবলিক বিশ্বাস করল, নরেন্দ্র মোদীকে আনলেই ‘অচ্ছে দিন’ও আসবে গুটি গুটি পায়ে, সেটা কি এমনি এমনি করল? এই বিশ্বাসটা এল বিজ্ঞাপন দেখে। এবং, সেই বিজ্ঞাপনে একটা ইমপ্লিসিট— অন্তর্নিহিত— প্রতিশ্রুতি ছিল, অচ্ছে দিন যদি না আসে, তা হলে পাঁচ বছর পরে সরকার পাল্টে ফেলা যাবে। অর্থাৎ, বিফলে মাল ফিরিয়ে নেওয়া হবে। নির্বাচনী গণতন্ত্রের যা নিয়ম। পাবলিক যদি জানত যে, কাউকে এক বার ভোটে জিতিয়ে নিয়ে এলে তাকে আর পাল্টানোর উপায় থাকবে না, তা হলে কি লোকে নেতা বাছার ক্ষেত্রে আরও একটু সাবধান হত? আমার ধারণা, হত।”
“গরুর রচনা লিখছেন, শিবুদা। হচ্ছিল জ্যোতিষীর কথা, মোদীকে টেনে আনলেন!” শিবুদাকে খোঁচা দিল তপেশ।
“মাথাটা গোবরে ঠাসা না হলে নিজেই যোগসূত্রগুলো দেখতে পেতিস।” শিবুদা খোঁচা ফেরত দিলেন। “এই যে বললাম, মালের গুণমান বিচার করা যত কঠিন হবে, গ্যারান্টি থাকলে সেই জিনিসটা সম্বন্ধে মানুষ তত বেশি সন্তুষ্ট হবে, এই কথাটার শিকড় কোথায়, ভেবেও দেখলি না। মানুষ ক্ষতি স্বীকার করতে ভয়ঙ্কর অপছন্দ করে। তার চেয়ে, নিজেকে বুঝিয়ে ফেলা অনেক বেশি সহজ। গ্যারান্টি আমাদের মনকে এই বোঝানোর কাজেই সাহায্য করে— বলছে যখন পছন্দ না হলে টাকা ফেরত দেবে, তখন নিশ্চয়ই জিনিসটা ভাল। এ বার ভাব, পশ্চিমবঙ্গে ভোটের আগে বিজেপি কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে— সোনার বাংলা গড়ে দেবে। সোনার বাংলা বস্তুটা গানে ভাল, হোটেলের নামেও ভাল— কিন্তু, সেটা খায় না মাথায় মাখে, তুই জানিস? কেউই জানে না। ভোটারের দিক থেকে এটার সুবিধা হল, যে যার মতো করে সোনার বাংলা ব্যাপারটা কল্পনা করে নিতে পারে। আর বিক্রেতা, অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের সুবিধা হল, সোনার বাংলা গড়া নামক পণ্যটা তুই কিনলে, সেটার গুণমান যাচাই করে দেখার উপায় তোর হাতে নেই। ফলে, কিনে ফেললে জিনিসটায় বিশ্বাস করতেই হবে।”
“এটা ফ্যাসিস্ট, অথরিটারিয়ান রেজিমের স্বভাবধর্ম, শিবুদা।” চায়ের কাপটা হাত থেকে নামিয়ে মুখ খুলল শিশির। “এই যে অতীত গৌরবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নন-ট্যানজিব্ল প্রতিশ্রুতি, বিংশ শতক এর ঢের উদাহরণ দেখেছে। হিটলার বলত পিতৃভূমির হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনবে, মুসোলিনি বলত নতুন করে রোমান সাম্রাজ্যের সূর্যোদয় ঘটাবে। বিশ শতকের গণ্ডি পেরিয়েও বহু উদাহরণ। ট্রাম্প বলেছিলেন মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন। মোদীও বলেছেন, অচ্ছে দিন এই এল বলে!”
“একদম। এটা একেবারে ক্লাসিক কেস— এমন প্রতিশ্রুতি, যেটা কখনও যাচাই করে নেওয়া যাবে না। সোনার বাংলায় কী হবে, বিজেপি এখনও অবধি বলেনি। বলবে বলে সন্দেহও হয় না। একটা কথা না বললে অন্যায় হবে যে, গত সাড়ে ছ’বছরে কেন্দ্রীয় সরকারকে দেখেও, উত্তরপ্রদেশ থেকে ত্রিপুরা, হরেক রাজ্যে বিজেপির খেল দেখেও পশ্চিমবঙ্গে যারা বিজেপিকে ভোট দেবে, তাদের বেশির ভাগই ভোট দেবে বিজেপি এসে মুসলমানদের টাইট দেবে, এই আশায়। কিন্তু, যারা সত্যিই ‘সোনার বাংলা’র আশায় ভোট দেবে, তাদের পক্ষে এই প্রতিশ্রুতি মিলিয়ে দেখা অসম্ভব। কথাটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্যই বলছি না, এটা গোটা দুনিয়ার সর্বত্র ঘটে চলেছে। ভোটে প্রতিশ্রুতি নিয়ে ইদানীং বেশ ভাল কিছু অ্যাকাডেমিক কাজ হচ্ছে, সেখানেও একই কথা বলছে।” শিবুদা দম নেওয়ার জন্য থামেন।
“শুধু এই গ্যারান্টির ভরসায় ভোট লড়বে বিজেপি, আপনি বলছেন?” প্রশ্ন করে শিশির।
“বলতে পারলে খুশি হতাম, বুঝলি,” প্রশ্নটা শুনে একটু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে টেবিলের উপর দেশলাই বাক্সটা ঠুকতে ঠুকতে বললেন শিবুদা। “কিন্তু, বলছি না। মনে একটা আশঙ্কা হচ্ছে— ভোট আরম্ভ হওয়ার আগেই হয়তো এই রাজ্যের কোনও প্রান্তে একটা বড় মাপের সাম্প্রদায়িক গোলমাল বাধবে। তাতে যাদের লাভ, তারাই হয়তো গোলমালটা বাধাবে। অথবা, উগ্রপন্থী হামলা হবে। অথবা, প্রশান্ত কিশোর যেমন বললেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধেও হামলা হতে পারে। এ সব না হলেই যে খুশি হব, সেটা বলা বাহুল্য। কিন্তু, মানুষের আস্থার উপর ভরসা যথেষ্ট না থাকলে ‘জাতীয়তাবাদী’ আবেগ জাগিয়ে তুলতে এই সব ঘটনা ঘটতেই পারে। ঘটানো হতেই পারে।”
শিবুদা থামলেন। তাঁর কথাগুলো গোপালের চায়ের দোকানের হাওয়ায় ভাসতে থাকল।
আরও একটা সিগারেট ধরিয়ে শিবুদা বললেন, “ব্যবসার সঙ্গে রাজনীতির সবচেয়ে বড় ফারাক কী জানিস? তুই এক জন অনলাইন রিটেলারের থেকে কোনও জিনিস কিনলে, তার পর সেটা তোর পছন্দ না হলে দশ দিনের মধ্যে, বা এক মাসের মধ্যে পাল্টে নিতে পারবি। নির্বাচনী গণতন্ত্রে অপেক্ষা করতে হবে চার-পাঁচ বছর। তদ্দিনে অনেকের মনই তাদের বুঝিয়ে দেবে যে, জিনিসটা কিনতে ভুল হয়নি। ফলে, সেই ভুল আরও এক বার করে ফেলতে পারিস। বিফলে মূল্য ফেরত, এই প্রতিশ্রুতি যে আমাদের দিয়ে কত ভুল জিনিস কিনিয়ে নেয়, আর কত ভুল জিনিসকে ‘ঠিক’ বলে ভাবায়, সেটা ভুলিস না। এই বার বাংলায় ভুল জিনিস কিনলে তার কত মূল্য চুকাতে হবে, সে হিসেব নেই।”
শিবুদার কথায় অশনিসঙ্কেত। এমন কঠিন সঙ্কেত আগে তারা দেখেছে কি?