প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
মফস্সল শহরের বইমেলার মাঠ। সময়টা গত দশকের গোড়ার দিক। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়তে ঢোকা এক ছাত্রকে তারই স্কুলের ইংরেজি মাস্টারমশাই অনুযোগের ছলে ভর্ৎসনা করেছিলেন— যথাযথ ভাবে ইংরেজি না শেখার জন্য। পরবর্তী কালে কলকাতা বইমেলার মাঠে সেই ছাত্রই দেখেছিল গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে। চার পাশের অনেকেই তাঁর সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করছেন, প্রায় সকলেই কথা বলতে চাইছেন ইংরেজিতে। কিছু ক্ষণ পরে, এক সভামঞ্চে গায়ত্রী স্পষ্ট বাংলায় বললেন— “আমি কলকাতায় বড় হয়েছি। এখানে এখন আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলার অর্থ কী?”
এই দু’টি ঘটনার ব্যবধান দশ বছর। এর মধ্যে সেই ছাত্র কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করেছে। প্রথা মেনে বিভিন্ন ইংরেজি বই ও জার্নাল পড়েছে এবং সেখানে লিখেছে। জেনেছে যে, ভাষা আসলে সুশৃঙ্খল ভাবে ভাবনাকে প্রকাশের একটা মাধ্যমমাত্র। সমস্ত ভাষাই এক-একটি অনন্ত খনির প্রবেশপথ, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই ভাষার দীর্ঘকালব্যাপী চলা পথের যাবতীয় মূল্যবান সঞ্চয়।
ভাষার শক্তিমত্তা আছে। শুধু ইংরেজি বা হিন্দি নয়, সমস্ত ভাষারই জটিল আগ্রাসন, সঞ্চয় ও ক্ষয় আছে। তাকে আয়ত্ত করার কাজটা সহজ নয়। কোনও ভাষা শিখে, সেই ভাষার ব্যাকরণের শাসন বুঝে নিয়ে, ভাষার বহিরঙ্গ রপ্ত করা যায়; তবে, অত সহজে কোনও ভাষার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়া যায় না। তার জন্য দরকার হয় ভাষাটির দীর্ঘ দিনের প্রবাহের ইতিহাস ও সেই ইতিহাসের নানাবিধ জয়-পরাজয়কে জানা। প্রতিটি শব্দের ভিতরের যে আপস, বিদ্রোহ ও সমঝোতা রয়েছে, তার নাগাল পাওয়া।
আর পাঁচটা ভাষার মতোই ইংরেজিও একটা ভাষা। ইংরেজি কাজের ভাষা। তাকে অস্বীকার করে লাভ কিছু নেই, বরং আখেরে ক্ষতিই। তার নিজস্ব সঞ্চয়ের পাশাপাশি, দীর্ঘ দিন ঔপনিবেশিক শাসকের ভাষা হওয়ায় এ ভাষা অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। তবে, ইংরেজির বেলায়, বিশেষত আমাদের ক্ষেত্রে, একটা অন্য সমস্যা আছে। ‘শাসকের ভাষা’, এই অভিমানটা ইংরেজি ভাষার সঙ্গে এখনও যেন ভীষণ ভাবে জড়িয়ে আছে। এর ফলে ইংরেজি জানা, লিখতে ও বলতে পারার বা পড়ানোর একটা প্রবল স্পৃহা কাজ করে। আর তার সমান্তরালে জেগে ওঠে মাতৃভাষা বাংলাকে তাচ্ছিল্য করার একটা প্রবণতা। প্রশ্ন ওঠে বাংলা ভাষার কর্মক্ষমতার সীমা ও অর্থকরী দিক নিয়ে। অথচ ভাষার আখরগুলি স্পর্শ করার ইচ্ছা জাগে না। মাতৃভাষা অর্থকরী হলে তবেই কি আদরণীয়? এই প্রশ্ন কখনও কাউকে করতে শুনিনি।
অন্য ভাষা দিয়ে চিন্তাকে বাহ্যিক ভাবে বোঝা ও বোঝানো যায়। কিন্তু, আমাদের ভাবনার ভাষা কী? একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে— সেটিই আসলে মাতৃভাষা। অন্য ভাষায় দক্ষতা কাজ চালানোর মতো হোক অথবা তুখোড়, আসলে ভাবনাকে আমরা মাতৃভাষায় অনুবাদ করেই বুঝি এবং কোনও চিন্তাকে বোঝানোর জন্য মাতৃভাষা থেকে সংশ্লিষ্ট ভাষায় অনুবাদ করি। আর এইখানেই অনুবাদের একটি বড় বিতর্কের কথা স্মরণ করা যায়। অনুবাদ মূল ভাষার অনুগত হবে, না কি যে ভাষায় অনূদিত হচ্ছে সেই ভাষার অনুগত হবে।
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বিবিসি রেডিয়ো শুনে শুনে তাঁর ধারালো ইংরেজি বলার কৌশলটি রপ্ত করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে দেওয়া তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে এই কথাগুলি জানা। অথবা ধরা যাক, বরিশাল বাখরগঞ্জের যে এক মনীষার নেতৃত্বে এক ঝাঁক মেধাবী ভাবুক পশ্চিমকে নতুন ভাবে ইতিহাস পড়তে শেখালেন, তাঁরাই বা কত জন আগাগোড়া ইংরেজি মাধ্যম? অথচ, রণজিৎ গুহের সাবঅল্টার্ন গোষ্ঠী দিব্যি পশ্চিমের দেশগুলিতে সাহেবদের সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় ভাবনার আদানপ্রদান চালিয়ে গিয়েছেন, যাচ্ছেন।
ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি মঞ্চে বলতে উঠে গ্লানিহীন ও নিঃসঙ্কোচ ঘোষণা করেন— “আমার বলা ইংরেজির এক বর্ণও আপনারা বুঝতে পারবেন না।” কার্যত হয়ও তাই। কিন্তু এর পরও আমরা তাঁর বই থেকে তাঁর ভাবনাকে বোঝার চেষ্টা করি। অন্য দিকে, গবেষণার প্রয়োজনে বই খুঁজতে খুঁজতে কোনও বাংলা বইয়ের নাম দেখলে আমরা বিকল্প ইংরেজি বইয়ের নাম খুঁজতে থাকি।
স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস, ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল ইত্যাদির বিপুল আয়োজন দিয়ে ইংরেজি শেখা এবং শেখানোর বিলাসবহুল আয়োজনে আমরা ভুলে যাই, দ্বিভাষিক হওয়া এক সময় শিক্ষিত বাঙালির কাছে স্বাভাবিক ছিল— বাংলাকে ভুলে ইংরেজি নয়, দু’টি ভাষাই সমান যত্নে শেখা ছিল শিক্ষার পরিচয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy