প্রহসন? দলীয় সভাপতি নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন কর্নাটকের প্রতিনিধিরা। ১৭ অক্টোবর, বেঙ্গালুরু। পিটিআই।
১৭ অক্টোবর, ২০২২। কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ। বিকেলে নির্বাচন পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত নেতা মধুসূদন মিস্ত্রি এআইসিসি-র সদর দফতরে সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবি করলেন, দলের একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে সাংগঠনিক নির্বাচনের মাধ্যমে শীর্ষপদের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হল। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের এ এক অনন্য উদাহরণ। অন্যান্য রাজনৈতিক দল কংগ্রেসকে দেখে শিখতে পারে, বিশেষত যাঁরা কংগ্রেসের অন্দরে গণতন্ত্র নেই, পরিবারতন্ত্র চলে বলে নিন্দেমন্দ করেন।
ঠিক সেই মুহূর্তেই কলকাতার এক কংগ্রেস নেতার মেসেজ ঢুকল হোয়াটসঅ্যাপে— যদি নরেন্দ্র মোদী ঠিক কংগ্রেসের পদ্ধতিতেই দেশে লোকসভা নির্বাচন করাতে চান, তা হলে কেমন হবে? যে ভাবে প্রদেশ সভাপতির দায়িত্বে কংগ্রেসের নির্বাচনের ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছে, সেই ভাবে যদি লোকসভা ভোটে রাজ্যপাল বা মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে প্রতিটি রাজ্যে ভোটার তালিকা তৈরি হয়, তা হলে কংগ্রেসের কি আপত্তি থাকা উচিত হবে?
প্রশ্নটা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কারণ কংগ্রেসের সংবিধান বলছে, প্রথমে দলের তৃণমূল স্তরে নির্বাচন করে ব্লক কংগ্রেস প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। দেশে ন’হাজারের বেশি ব্লক কংগ্রেস কমিটি রয়েছে। এই ব্লক কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা ভোট দিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রতিনিধি ঠিক করবেন। প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি, জেলা সভাপতি, এআইসিসি সদস্য, বিধায়করাও প্রতিনিধির তালিকায় থাকবেন। এই প্রতিনিধিরাই কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে ভোট দেবেন। যাঁদের সংখ্যা প্রায় ৯,৮০০ জন।
কার্যক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। কোনও ব্লকেই নির্বাচন হয়নি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির দফতর থেকেই ব্লক কমিটির প্রতিনিধিদের বাছাই করা হয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিরাই মল্লিকার্জুন খড়্গেকে সমর্থন করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কাকে ভোট দিতে হবে। যিনি ভোটার তালিকা তৈরি করলেন, তিনিই বলে দিলেন কাকে ভোট দিতে হবে। দল ছাড়ার আগে প্রবীণ গুলাম নবি আজ়াদ বিনা কারণে কংগ্রেসের নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ বলেননি।
তা বলে বিজেপি নেতারা ‘দুয়ো, দুয়ো’ রব তুলবেন, সে উপায় নেই। সনিয়া গান্ধী সীতারাম কেশরীকে হটিয়ে কংগ্রেসের শীর্ষপদে বসেছিলেন ১৯৯৮ সালে। তার পরে ২০০০ সালে কংগ্রেস সভাপতি পদে নির্বাচন হয়। জিতেন্দ্র প্রসাদকে হারিয়ে সনিয়াই জেতেন। ২২ বছর পরে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে ভোটাভুটি হচ্ছে। এই ২২ বছরে বিজেপিতে ন’জন সভাপতি এসেছেন। কোনও বারই নির্বাচন হয়নি। ভোটাভুটি তো দূরের কথা। প্রত্যেকেই না কি সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি পদে উঠে এসেছেন! জনা কৃষ্ণমূর্তি, বেঙ্কাইয়া নায়ডু থেকে লালকৃষ্ণ আডবাণী, রাজনাথ সিংহ, নিতিন গডকড়ী, অমিত শাহ এবং বর্তমান সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডা। নির্বাচনে জিতে সভাপতি হওয়ার ভানটুকুও কেউ করেননি। আগামী বছর নড্ডার প্রথম দফার মেয়াদ ফুরোচ্ছে। তিনিই যে সভাপতি পদে থেকে যাবেন, তা-ও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ-মোহন ভাগবতরা এখনই ঠিক করে রেখেছেন।
কংগ্রেস, বিজেপি ছাড়া দেশের অন্য দলগুলির মধ্যে সিপিএম অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ঢাক পিটিয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ধুয়ো তুললেও, সিপিএমের পলিটবুরো, কেন্দ্রীয় কমিটি বা রাজ্য কমিটির সদস্যরাও দলীয় নির্বাচনে জিতে আসেন না। এ কে গোপালন ভবন বা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের হর্তাকর্তারাই ঠিক করেন, এ বার কে পলিটবুরোয় জায়গা পাবেন, কে পাবেন না। হর্তাকর্তাদের মধ্যে যাঁর দলে লোক বেশি, তিনিই গদি দখল করেন।
আর আঞ্চলিক দল? সেখানে শুধু একটাই প্রশ্ন। শীর্ষপদের উত্তরাধিকারী কে হবেন? পুত্র, না কি কন্যা? ভাই, না কি ভাইপো? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শরদ পওয়ার, মুলায়ম সিংহ যাদব থেকে লালু প্রসাদ যাদব, করুণানিধি থেকে কে চন্দ্রশেখর রাও— সকলের দলেই এক ছবি। এই সব আঞ্চলিক দলে বোধ হয় সাংগঠনিক নির্বাচনের কথা কোনও দিন কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি।
মোদ্দা কথা হল, কংগ্রেস যতই সভাপতি নির্বাচন দেখিয়ে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ঢাক পেটাক, বিজেপি যতই কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলগুলিকে ‘পরিবারতন্ত্র’ বা ‘ভাই-ভাতিজাবাদ’-এর নামে দুয়ো দিয়ে নিজেদের দলে গণতন্ত্রের ভান করুক, এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র আসলে সোনার পাথরবাটি। রাজনৈতিক দলগুলি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেয়। অথচ কোনও দলের অন্দরমহলেই প্রকৃত গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। কর্তা বা কর্ত্রীর ইচ্ছাতেই কর্ম। কোথাও ক্ষমতার রাশ পরিবারের হাতে। কোথাও মুষ্টিমেয় নেতার জিম্মায়। কোথাও তার নাম ওয়ার্কিং কমিটি, কোথাও পলিটবুরো, বা সংসদীয় বোর্ড।
হালফিলে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র আনতে উদ্যোগী হওয়ার চেষ্টা করছে। অন্ধ্রের ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টি জগন্মোহন রেড্ডিকে আজীবন সভাপতি হিসেবে মনোনীত করেছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, কোনও পদে পাকাপাকি কাউকে রেখে দেওয়াটা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে কোথাও রাজনৈতিক দলগুলির সাংগঠনিক নির্বাচনের কথা বলা নেই। দেশের সংবিধান এ বিষয়ে নীরব। রাজনৈতিক দলগুলির জন্য নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় অবশ্য বলা রয়েছে যে, কমিশনের কাছে দলের সংবিধান জমা করতে হবে। সেই সংবিধানে দলের বিভিন্ন স্তরে সাংগঠনিক নির্বাচনের নিয়মকানুন থাকতে হবে। কত দিন অন্তর সাংগঠনিক নির্বাচন হবে, কোন পদের কত দিন মেয়াদ, তা-ও নিয়মের মধ্যে থাকা আবশ্যিক। মুশকিল হল, কেউ এই নিয়ম না মানলেও নির্বাচন কমিশনের কিছু করার ক্ষমতা নেই।
এ দেশের রাজনীতিকরা বলতেই পারেন, আমেরিকা বা ব্রিটেনের মতো দেশেও রাজনৈতিক দলগুলিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নেই। সেখানে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী ভোটে কে দলীয় প্রার্থী হবেন, তা নিয়ে দলের মধ্যে লড়াই, খোলাখুলি বিতর্ক হয় বটে। নরেন্দ্র মোদীকে যেমন ২০১৪-র নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে উঠে আসতে লালকৃষ্ণ আডবাণী-সুষমা স্বরাজদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল। কিন্তু সেটাকেও প্রকৃত অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বলা যাবে না।
কেউ যুক্তি দিতেই পারেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলেশ যাদব, এম কে স্ট্যালিন বা শরদ পওয়াররা নিজেদের দলের শীর্ষপদে নির্বাচনে প্রার্থী হলে তো তাঁরাই জিতবেন। আর তাঁরা যদি নিজেরা সভাপতি না হয়ে অন্য কাউকে শীর্ষপদে বসাতে চান, তা হলেও সবাই চোখ-কান বুজে তাঁকেই মেনে নেবেন। নরেন্দ্র মোদী বা রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। তা হলে আর নির্বাচনের নামে খামোকা প্রহসন করানোর কী দরকার!
১৩৭ বছরের পুরনো দল কংগ্রেসের কাছে আশা করাই যেত যে, বাকিদের সামনে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রকৃত নমুনা তারাই তুলে ধরবে। স্বাধীনতার আগে সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে মোহনদাস গান্ধীর আশীর্বাদধন্য প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারিয়ে ভোটে জিতেছিলেন। আবার স্বাধীনতার পরেই পুরুষোত্তমদাস টন্ডন জওহরলাল নেহরুর সমর্থিত প্রার্থী জে বি কৃপালনীকে হারিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর আমলে কংগ্রেসের রাশ গান্ধী পরিবার ও তার অনুগামীদের নিয়ে তৈরি কংগ্রেস হাই কমান্ডের হাতেই কুক্ষিগত হয়েছে। সনিয়া-রাহুল মুখে যা-ই বলুন, তাঁরা সেই রাশ ছাড়তে নারাজ।
নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ নিজেরা বিজেপির সভাপতির আসনে না বসে অন্য কেউ বিজেপির সভাপতির আসনে বসেছেন বলে এ কথা বলা যাবে না যে, বিজেপিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ক্ষমতা আসলে মোদী-শাহর হাতেই। একই ভাবে রাহুল গান্ধী ফের সভাপতি না হওয়ায়, ২৪ বছর পরে গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ সভাপতি হলেও নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, গান্ধী পরিবারের হাতেই কংগ্রেসের লাগাম থাকবে।
কংগ্রেসে অবশ্য এর বাইরে কিছু হওয়ারও ছিল না। খোদ মহাত্মা গান্ধীই কংগ্রেসের কোনও পদে না থেকে পিছন থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। জওহরলাল নেহরু বা সর্দার বল্লভভাই পটেলরা সামনে থাকলেও রাশ ছিল তাঁরই হাতে। একই ভাবে এখন কংগ্রেসের সভাপতি যিনিই হোন না কেন, রাহুলই দল চালাবেন। বলা চলে, রাহুল গান্ধী এ বার প্রকৃত অর্থে ‘গান্ধীজি’-র পথে চলবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy