মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহজি।
আমরা অনেকেই মাইসুরু বা বরোদার মহারাজাদের মতো আঞ্চলিক শাসকদের তাৎপর্য জানি না। কিন্তু রঞ্জি ট্রফির সৌজন্যে জামনগরের মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহজিকে (১৮৭২-১৯৩৩) তাঁর ডাক নামেই চেনেন ক্রিকেটপ্রেমী ভারতীয়।
ভারতবাসী এখনও তাঁর ক্রীড়া নৈপুণ্যকে সম্মান জানায়। কিন্তু অনেক ইতিহাসবিদের মতে, মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহজি গণপরিধিতে ছিলেন এক জন মন্দ শাসক। তাই তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্তির আবহে এমন ক্রিকেটার ও শাসকের অবশ্যই একটি মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। ‘ভাবের রাজ্যে স্বাধীনতা’ নামক প্রবন্ধে আচার্য কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য বুঝিয়েছেন যে, নৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল আদর্শগত মুক্তি। শক্তিশালী জাতির কাছে অনিচ্ছাকৃত নতিস্বীকার খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ভিতরে ভিতরে জাতীয় মর্যাদাবোধ না থাকা দুর্বলতা। ঠিক এই জায়গা থেকে রঞ্জিৎ সিংহজি ভাবের রাজ্যে পরাধীন ছিলেন।
পালকপিতা বিভোজি দত্তক নিয়েছিলেন তাঁকে। ফলে প্রাচুর্য তাঁর ছোটবেলার বাস্তব। কিন্তু দত্তক নেওয়ার পদ্ধতি বিভোজি ইচ্ছাকৃত ভাবে অসম্পূর্ণ রেখেছিলেন। এগুলো রাজকীয় জটিলতা, যে কোনও রাজপরিবারের খুব স্বাভাবিক ঘটনা। নেতিবাচক এই বৈশিষ্ট্যগুলো রঞ্জি দ্রুত আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। ব্যর্থ প্রেমিক, অকৃতদার রঞ্জিও দত্তক নিয়েছিলেন রাজপাট রক্ষার তাগিদে। নওয়ানগরের রাজসিংহাসন দখলের জন্য সব সময় ইংরেজ সরকারের মন জুগিয়ে চলতেন। কোনও রাজপরিবারে এ সব কাহিনি নতুন নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের দলগত একটি খেলার এক জন দুর্ধর্ষ খেলোয়াড়ের থেকে এ রকম সঙ্কীর্ণ মানসিকতা হতাশাজনক। ক্রীড়া মনোবিদ্যা বলে, খেলার মাঠের স্বার্থপরতা বা হিংসা স্বাস্থ্যকর। তবে রঞ্জিৎ সিংহজি ক্রীড়াক্ষেত্রে চূড়ান্ত সফল হলেও স্বদেশপ্রেমের মহাকাব্যে তিনি আত্মকেন্দ্রিক মহারাজা। ব্রিটিশের চাটুকার হলেও তাঁর লাগামছাড়া বিলাসে ব্রিটিশ সরকার নানা ভাবে তাঁকে তিরস্কার করেছে, জরিমানা করেছে। নিজেকে বাঁচাতে তিনিও মামলা মকদ্দমায় জড়িয়েছিলেন বহু বার। রংবেরঙের হিরে, মূল্যবান রত্ন সংগ্রহ ছিল তাঁর শখ। ক্রিকেটের পাশাপাশি টেনিসেও ছিলেন অসাধারণ পারদর্শী। কিন্তু এই খেলাকে তিনি বিনোদন আর ব্রিটিশতোষণের উপায় বলেই মনে করতেন। সারা জীবন ইংল্যান্ডের হয়ে ব্যাটিং করেছেন— কখনও মাঠে, কখনও মাঠের বাইরে। গুজরাতের নানা অঞ্চলে প্রকাশ্য জনসভায় অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। বিলিতি দ্রব্য বর্জনের ডাকের বিরোধিতা করে তুলো সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিয়েছিলেন। পত্রিকার প্রতিবেদনে বোঝা যায়, বিদেশি দ্রব্য আমদানি করার পথ সুগম করতে তিনি তাঁর অধীনে থাকা বন্দর উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
চিন্তার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন ইংরেজ অনুসারী। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত তথ্যের বাইরের বেশ কিছু ঘটনা সাক্ষী দেয়, তিনি ছিলেন এক জন স্বৈরাচারী শাসক। ভৌগোলিক কারণেই জামনগর খরাপ্রবণ অঞ্চল। তাই জলসঙ্কট ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। সঙ্গে ছিল চূড়ান্ত দারিদ্র আর নানা ধরনের অসুখ। কৌশলে এই ঘটনাগুলোকে এক করে প্রচার করলেন ‘জামনগর অশুভ নগরী’। কিন্তু এই প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের সাহায্য করা। শুরু হল নগরের আধুনিকীকরণ। রাজকোষ নিঃশেষ করে বন্দরের সংস্কার হল, রুক্ষ ভূমিতে বসল রেলপথ।
ঠিক এর বিপরীত ভাবনার প্রকাশ দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বদেশী সমাজ’-এ। তিনি লিখেছিলেন, ভারত রাজত্বের দিকে তাকায়নি, সমাজের দিকেই দৃষ্টি রেখেছে। ১৯১৯ সালে মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন, আর ১৯১৭ সালে রঞ্জিৎ সিংহ অসদুপায়ে জিতে নিয়েছিলেন নাইট কমান্ডার উপাধি, ১৯১৯ সালে গ্রেট ক্রস খেতাব। এরও দুই বছরের মধ্যে তাঁকে নাইট গ্র্যান্ড কমান্ডার সম্মানে ব্রিটিশ সরকার ভূষিত করে। ব্রিটিশের তরফ থেকে এটাই ছিল তাঁর অর্ধশতবর্ষের জন্মদিনের উপহার।
তবে, তিনি ছিলেন ক্রিকেটসাধক। ব্যাটার রঞ্জিৎ সিংহের স্মারক আজকের রঞ্জি ট্রফি। ‘স্মিথ’ ছদ্মনামে রঞ্জি ইংল্যান্ডের ক্রিকেটমহলে নায়ক ছিলেন। তাঁর ক্রিকেটীয় সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিলেন স্বয়ং গ্রেস।
জীবনী মানেই মূলত প্রশংসাময় আখ্যান। কিন্তু রঞ্জিৎ সিংহজির জীবনের সাদা ও কালো দু’টি দিকই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই শুধু ক্রিকেটার রঞ্জিকে আলোচনায় নিয়ে এসেই আমরা দায়মুক্ত হতে পারি না। বিপ্রতীপ দুই বৈশিষ্ট্যকেই বর্তমানের ক্রীড়া ও রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে নিয়ে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে যে, স্বাধীনতার ৭৫ পূর্তি উদ্যাপনে মশগুল একটি জাতি এমন স্বাধীনতা-বিরোধী, মনেপ্রাণে ব্রিটিশভক্তের নামে আস্ত একটা জাতীয় প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাবে কি না।
শারীরশিক্ষা বিভাগ, বহরমপুর ইউনিয়ন ক্রিশ্চিয়ান ট্রেনিং কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy