Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Swab Test

জনস্বাস্থ্য ছাড়া জননীতি হয় না

ভাইরাসের ক্রমাগত চরিত্র-বদলে বিভিন্ন ভেরিয়্যান্ট বা প্রকারভেদ বাইরে থেকে দেশে এসেছে, বা তৈরি হয়েছে— তা সবাই দ্বিতীয় ঢেউকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।

অমিতাভ সরকার
শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৪২
Share: Save:

আজ অবধি করোনার দৈনিক সংক্রমণ সবচেয়ে কম ছিল চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। তার পর থেকে দ্বিতীয় ঢেউয়ে এখন পর্যন্ত (২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ এপ্রিল ২০২১) আনুমানিক ষাট লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন; দৈনিক সংক্রমণের নিরিখে ভারত এই মুহূর্তে পৃথিবীতে পয়লা নম্বরে। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের হার অনেকটাই বেশি। প্রথম দু’মাসে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে প্রথম ঢেউয়ে যেখানে গড়ে ২৮ দিন লেগেছিল, তা এখন ১০ দিনে হচ্ছে।

ভাইরাসের ক্রমাগত চরিত্র-বদলে বিভিন্ন ভেরিয়্যান্ট বা প্রকারভেদ বাইরে থেকে দেশে এসেছে, বা তৈরি হয়েছে— তা সবাই দ্বিতীয় ঢেউকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। ভারতে ব্রিটেন ভেরিয়্যান্টের সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে ২০২০-র ২৯ ডিসেম্বর, এবং পরের ষোলো দিনে আরও ১০৯ জন ওই ভেরিয়্যান্টে আক্রান্ত হন। তার পরেও দেশের এপিডেমিক ইন্টেলিজেন্স ব্রিটেন বা অন্যান্য ভেরিয়্যান্টকে অতি সংক্রামক হওয়া থেকে রুখতে ব্যর্থ হয়। কারণ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণ তলানিতে ঠেকলে মহামারি রোখার আপৎকালীন শর্তগুলোই (স্ক্রিনিং-ট্র্যাকিং-টেস্টিং এবং যথার্থ প্রচার) শিথিল হয়ে যায়। ভাইরাসের ভেরিয়্যান্ট চিহ্নিত করতে যে ‘জিনোম সিকোয়েন্সিং’-এর (যা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা-প্রণালী নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়) দরকার হয়, তা-ও দেশের অতিমারি পরিকল্পনায় স্থান পায়নি। ২০২১-এর প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) সমস্ত কোভিড পজ়িটিভের এক শতাংশেরও কম ক্ষেত্রে ল্যাবরেটরিতে স্যাম্পলের জিনোম সিকোয়েন্সিং হয়েছে।

মহামারি রোখাটা জায়গাবিশেষে (যেমন কোনও শহর বা তার অংশবিশেষ) একটা আপৎকালীন ব্যবস্থা, কিন্তু অতিমারির সঙ্গে লড়াই একটা দীর্ঘকালীন যুদ্ধ, যেখানে ভৌগোলিক সীমারেখা থাকে না। অতিমারিতে সংক্রমণ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়ায়। তাই ভারতের মতো বৃহৎ দেশে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সমন্বয় ছাড়া এই যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়। আজ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এমন কোনও কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয় সমিতি তৈরি হয়নি, যা দেশ জুড়ে অতিমারি পরিস্থিতির উপরে নজর রাখবে, ও রাজ্য বা এলাকাবিশেষে মহামারির সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনা প্রদান করবে।

কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যে টাস্ক ফোর্স ও উপদেষ্টামণ্ডলীগুলি আছে, তারা মূলত নিজ-নিজ সরকারকে ‘রেসপন্স ম্যানেজমেন্ট’-এ (চিকিৎসা পরিকাঠামো, টিকাকরণ, টেস্টিং কৌশল) নীতি নির্ধারণে সাহায্য করছে, কিন্তু অতিমারি রোধের ক্ষেত্রে আন্তঃরাজ্য ও কেন্দ্র-রাজ্য পরিকল্পনায় কোনও সম্মিলিত প্রয়াসে শামিল হচ্ছে না। বিভিন্ন রাজ্যে অক্সিজেন বণ্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়া এর মোক্ষম উদাহরণ। কেন্দ্র ও রাজ্যের মন্ত্রী-আমলাদের যৌথ মিটিংয়ে প্রশাসনিক কর্মপদ্ধতি আলোচনা করা যায়, কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ছাড়া এপিডেমিক ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষণ করা যায় না। তাই দ্বিতীয় ঢেউ প্রাথমিক ভাবে কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়হীনতা এবং এপিডেমিক ও জেনেটিক ইন্টেলিজেন্স সঠিক ভাবে ব্যবহার না করার পরিণাম।

টিকাকরণের ক্ষেত্রেও কিছু কৌশলগত পরিবর্তন জরুরি। আমরা যদি রাজ্যওয়াড়ি কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখে টিকাকরণ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি মাপি, তা হলে দেখব যে, ত্রিপুরা বা সিকিমের মতো রাজ্যে, যেখানে রোগের প্রাদুর্ভাব কম, সেখানে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে টিকাকরণের হার অনেক বেশি। বিপরীতে মহারাষ্ট্র বা দিল্লির মতো জায়গায় টিকাকরণের হার মোট জনসংখ্যার অনুপাতে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। দেশে এখন ‘বয়স ভিত্তিক রিস্ক-গ্রুপিং’ করে টিকা প্রদান হচ্ছে, যেখানে রোগের প্রাদুর্ভাব নয়, বরং ব্যক্তির বয়স ও ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রি (কো-মর্বিডিটি) হল ঝুঁকি নির্ণয়ের মাপকাঠি। তার বদলে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখে ‘শহর/ জেলা/ রাজ্যভিত্তিক রিস্ক-গ্রুপিং’ করে সেখানে সকল বয়সের মানুষের টিকা প্রদান কর্মসূচি গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে সংক্রমণ রোখার ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি কার্যকর হবে। তবে এ কথা বলা প্রয়োজন যে, বর্তমানে টিকার অপ্রতুলতার সঙ্গে দ্বিতীয় ঢেউয়ের কমা বা বাড়ার কোনও সম্পর্ক সে ভাবে নেই।

অতিমারির মধ্যে আট দফা নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক উঠছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে নির্বাচনী প্রশাসনিকতার সম্পর্কের মূল্যায়ন হওয়া উচিত। এই দফাগুলোতে নির্বাচনী বিন্যাস জেলাভিত্তিক করার বদলে বিধানসভা-ভিত্তিক করা হয়েছে। তাই বিভিন্ন জেলায় দুই বা তিন দফায় নির্বাচন হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের নিরিখে এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। যদি জেলাভিত্তিক বিন্যাসের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ থেকে ধাপে ধাপে আটটা দফায় দক্ষিণবঙ্গে নামা যেত (বা উল্টোটা), তা হলে একই জেলায় বার বার রাজনৈতিক জমায়েত ও এক সঙ্গে অনেক মানুষের আনাগোনা অনেক দিন ধরে হত না। একই জেলাতে বিভিন্ন দফায় নির্বাচন রাখায় মানুষের জমায়েত ও যাতায়াত একাধিক বার হচ্ছে, যা এখন অত্যন্ত বিপজ্জনক।

জননীতিতে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব কম হলে তা সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে চলা কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ ও আট দফা নির্বাচন তা আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Corona virus Swab Test
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy