—ফাইল চিত্র।
যুদ্ধ শেষ। ক্যামেরায় ধরা পড়ে পাহাড়চূড়ায় জাতীয় পতাকা নিয়ে সৈন্যদের বেপরোয়া কিন্তু ক্লান্ত হাসি। এ বার ঘরে ফেরার পালা। শুধুই পুরুষ সৈন্যেরা ঘরে ফিরবেন? না, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসের নতুন পথে সাক্ষাৎ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সে বার ঘরে ফিরলেন মেয়েরাও।
বীরাঙ্গনাদের মধ্যে ছিলেন ২৪ বছরের ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট গুঞ্জন সাক্সেনা (ছবি)। তাঁর ছোট্ট হেলিকপ্টার যুদ্ধের প্রচণ্ড ভয়াবহতাকে অগ্রাহ্য করে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে বাজপাখির মতো উড়েছে। প্রস্তুতিহীন ল্যান্ডিং করেছে। দরকার হলে একক ভাবে বাতাস চিরে উড়ান দিয়েছে। ৯০০-র উপর আহত বা নিহত সৈন্যকে হাসপাতালে ফিরিয়ে আনার কাজে সহায়ক হন গুঞ্জন। দ্রাস বা বাতালিকের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে দেন খাদ্য, পথ্য, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আকাশের বুকে তীক্ষ্ণ নজর নিয়ে ঘুরপাক খান। শত্রুর ঘাঁটি কোথায় আছে, সন্ধান করে তথ্য নিয়ে আসেন।
পদার্থবিদ্যা নিয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক গুঞ্জন সাক্সেনা সফদরজং ফ্লাইং ক্লাব থেকে প্রশিক্ষণ নেন। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ফাইটার জেটের পাইলট হবেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী উদারতার দরজা তখন অতখানি খুলে দিতে পারেনি। সামান্য যে কয়েক জন মহিলাকে পাইলট হিসাবে যোগ দিতে দেওয়া হয়েছিল, গুঞ্জন তাঁদের অন্যতম। সেনাবাহিনীতে তাঁর বাহন ছিল হেলিকপ্টার। ১৯৯৬-এ বাহিনীতে এসে গুঞ্জনের পোস্টিং হয় উধমপুরে। শুরু হয় কার্গিল যুদ্ধ। ১৯৯৯-এর সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের সময় তিনি শ্রীনগরের পাইলট দলের দশ জনের এক জন।
তবে এর পরও বেশি দিন সেনাবাহিনীতে থাকতে পারেননি গুঞ্জন। ২০০৪-এ অবসরে বাধ্য হন। ভারতীয় সেনা তখনও মহিলাদের স্থায়ী ভাবে নিযুক্ত হওয়ার অনুমতি দিত না। সামন্ততান্ত্রিক ভারত সে দিন তাঁকে ও তাঁর মতো নারীদের আকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল।
গুঞ্জনের আত্মজীবনী থেকে আমরা পেয়েছি ২০২০-র চলচ্চিত্র। পরিচালক শরণ শর্মা ও অভিনেত্রী জাহ্নবী কপূরের দৌলতে সারা ভারত চিনেছিল সাহসিনীকে। আজকের ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রত্যক্ষ ভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে কাজ করার ইতিহাস কি একা গুঞ্জনই সৃষ্টি করেছেন? ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শ্রীবিদ্যা রাজন জানিয়েছেন, তিনিও লড়েছেন কার্গিল যুদ্ধে। গুঞ্জনের কিছু আগে থেকেই। বিতর্ক যতই থাক, এই তরুণ পাইলটের কথাও জানতে হবে আমাদের। শ্রীবিদ্যা কেরলের পালক্কাড় জেলার গ্রামের মেয়ে। চার ভাইবোনের অন্যতম। রসায়ন নিয়ে পড়ার সময় বিমানবাহিনীতে পাইলট হয়ে যোগ দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। মালয়ালম মাধ্যমে পড়াশোনা। ইংরেজিতে সড়গড় নন। বড্ড রোগা চেহারা, মনে অদম্য জেদ। পাইলট হয়ে দেশের জন্য লড়তে আবেদন করলেন। বিফল হলেও থামার পাত্রী ছিলেন না। ইংরেজির চর্চা শুরু করলেন। তৃতীয় চেষ্টায় সাফল্য এল। অনেক বন্ধুর পথ পেরিয়ে কার্গিল যুদ্ধের সময় যেতে পারলেন শ্রীনগরে। আহত সৈন্যদের উদ্ধার শুরু করলেন। আসল কাহিনি তো কেবল কার্গিল জয়ের নয়, হাজারো বছরের সামন্ততান্ত্রিক ভারতে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও টক্কর দেওয়ার। সেনাবাহিনীর সকলেই সমান নন, কিন্তু দুই মহিলা যোদ্ধাই স্বীকার করেছেন, তাঁদের বিস্ময় ও বিশেষ নজরে দেখা হত সর্বক্ষণ। সামান্য ভুলেরও সুযোগ ছিল না।
যুদ্ধ এবং সমরাস্ত্র নিয়ে লড়াই কখনও সভ্য পৃথিবীর কাম্য হতে পারে না। কিন্তু প্রতিরক্ষার বিষয়টিকে যেমন এড়িয়ে যাওয়া যায় না, তেমনই অস্বীকার করা যায় না লিঙ্গবৈষম্য ও অসাম্যের অভিশাপকে। গুঞ্জনরা বারংবার প্রমাণ করেছেন, তাঁরা পারেন। তবু প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নারীর অন্তর্ভুক্তি কেউ সহজে মানতে পারেন না। তাও প্রথম দিকে কাজের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। ২০০৬-এ তা বেড়ে হয় ১৪ বছর। অথচ ২০ বছর কাজ না করলে পুরো পেনশন মেলে না। ২০২০-তে এসে সুপ্রিম কোর্টের দৌলতে মেয়েরা স্থায়ী ভাবে নিযুক্ত হওয়ার অধিকার পেলেন। এত কিছু সত্ত্বেও এখনও বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, স্থলবাহিনীতে মহিলাদের উপস্থিতি যথাক্রমে ১৩.৯, ৬ ও ৩.৮% মাত্র। অথচ প্রয়োজনের তুলনায় বাহিনীতে সেনা যথেষ্ট কম।
মহিলারা সেনাবাহিনীতে এলে পুরুষ অফিসারদের নাকি মানসিক বিপর্যয় হবে। মহিলারা যুদ্ধবন্দি হলে নাকি দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলবেন। মহিলাদের অধীনে পুরুষ সেনা কাজ করতে অভ্যস্ত নন। মহিলারা সন্তানপালনে ব্যস্ত বলে নাকি দেশের জন্য আত্মত্যাগ করতে পারবেন না। মহিলারা সেনাবাহিনীতে এলে সংসার উচ্ছন্নে যাবে। বিভিন্ন তরফ থেকে দেওয়া এমন কুযুক্তির কোনও শেষ নেই। এই সব কিছুকে গুঞ্জন, শ্রীবিদ্যারা ভুল প্রমাণিত করছেন। তবুও যুদ্ধবিমান চালানোর স্বপ্ন তাঁদের পূর্ণ হয়নি। তার জন্য ২০১৯ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। কমব্যাট মিশনের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন ভাবনা কান্থ। এসেছেন অবনী চতুর্বেদী, মোহনা সিংহরা। যুদ্ধ সেবা পদক পেয়েছেন স্কোয়াড্রন লিডার মিন্টি আগরওয়াল। গ্রুপ ক্যাপ্টেন শালিজ়া ধামি গত বছর ইতিহাস সৃষ্টি করেন ফ্রন্টলাইনে কমব্যাট ইউনিটের দায়িত্ব নিয়ে।
সাফল্য পরের প্রশ্ন। কিন্তু সমানাধিকারে পৌঁছতে ভারতের আর কতগুলো কার্গিল বিজয় দিবস (২৬ জুলাই) লাগবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy