‘সুখ’ মাপার ধারণাটা অবশ্য এসেছে হিমালয়ের আর এক ছোট্ট দেশ ভুটান থেকে। ফাইল চিত্র।
যক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “সুখী কে?” যুধিষ্ঠির বলিলেন, “যাহার ঋণ নাই, আর নিজের ঘরে থাকিয়া দিনের শেষে যে চারিটি শাক-ভাত খাইতে পায়, সেই সুখী।” উপেন্দ্রকিশোর এ ভাবেই বর্ণনা করেছেন ‘সুখ’ নিয়ে যক্ষ-যুধিষ্ঠিরের আলাপনকে। আবার সুকুমার রায়ের গল্পে কপর্দকশূন্য চালচুলোহীন ফকিরের সুখের অন্ত নেই। কিন্তু টাকা-পয়সা আর ক্ষমতা থাকলেও রাজামশাইয়ের অসুখ সারে না। সুকুমারী ভাষ্যে তাই অভাবকে নয়, অভাব-বোধকে জয় করতে পারাটাই সুখকে জাপ্টে ধরার চাবিকাঠি। সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন, রাজা যদি মাঠে গিয়ে হাওয়া খায়, তবেই শান্তি পাবে।
টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না, এমন কথা কি ধনীরাই বেশি বলেন? গত সেপ্টেম্বরে কর্মীদের সুবিধাতে কাটছাঁট করে গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই যেমন তাঁদের বললেন, ‘মজা’ এবং ‘অর্থ’কে এক করা উচিত নয়। তার আগের বছর পিচাইয়ের মাইনেই ছিল ৬৩ লক্ষ ডলার। তাই যক্ষ-যুধিষ্ঠির সংবাদের সঙ্গে কর্মীদের উদ্দেশে পিচাইয়ের উপদেশের পার্থক্য আছে নিশ্চয়ই।
প্রায় আড়াইশো বছর আগে টমাস জেফারসনের নেতৃত্বে আমেরিকার সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয় ‘পারসুট অব হ্যাপিনেস’ বা ‘সুখের সাধনা’র অধিকার। ‘যাও সুখের সন্ধানে যাও’ বলাটা সহজ বটে, কিন্তু ‘সুখ’টা ঠিক কী বস্তু? ১৭৭৬-এর আমেরিকার সমাজের প্রেক্ষিতে ‘ভাল থাকা’ই হয়তো ছিল সুখের রূপচিত্র। ভাল থাকার ধারণা বদলায়। সুখের ধারণাও কি বদলেছে?
গবেষকরা ‘সুখ’-এর তত্ত্বতালাশ করে আসছেন সেই কবে থেকে। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার এলিজ়াবেথ ডান এবং তাঁর সহ-গবেষকরা বিভিন্ন গবেষণাপত্রে, এবং তাঁদের ২০১৪ সালে প্রকাশিত বই হ্যাপি মানি-তে বলেছেন, টাকা যদি ‘সুখ’ আনতে না পারে, তা হলে নির্ঘাত তা ‘ঠিকমতো’ খরচ করা হচ্ছে না। ও দিকে ১৯৩৮ সালে মহামন্দার পরিপ্রেক্ষিতেই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি শুরু করে সুখ নিয়ে দুনিয়ার দীর্ঘতম গবেষণা প্রকল্প, যা চলছে আজও। এর বর্তমান নির্দেশক রবার্ট ওয়ালডিংগার একটি বই লিখেছেন সম্প্রতি, নাম দ্য গুড লাইফ। সেখানে ‘সুসম্পর্ক’কেই বলা হয়েছে ‘সুখী জীবন’-এর মহামন্ত্র।
সুখের সঙ্গে অর্থের একটা গাণিতিক সম্পর্ক তৈরির চেষ্টায় সাড়া-জাগানো এক গবেষণাপত্র ছাপা হয় ২০১০ সালে। লেখকদ্বয়ের এক জন, ড্যানিয়েল কানেম্যান, আগে থেকেই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং মনস্তত্ত্ববিদ; আর অন্য জন, অ্যাঙ্গাস ডিটন, অর্থনীতিতে নোবেল পাবেন পাঁচ বছর পরে, ২০১৫-তে। আমেরিকার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা দেখান যে, আয়ের সঙ্গে ‘সুখ’ বাড়ে বটে, কিন্তু আয় যখন মোটামুটি বছরে ৭৫,০০০ ডলারে পৌঁছয়, আয় বাড়লেও সুখ আর বাড়ে না। অঙ্কটা আজকের মানদণ্ডে মোটামুটি এক লক্ষ ডলার, আর আমেরিকায় দশ শতাংশেরও কম মানুষ এতটা আয় করেন।
কানেম্যান আর ডিটনের গবেষণা থেকে সুখের আর্থিক পরিমিতির ঊর্ধ্বসীমার সন্ধান পেয়ে প্রভাবিত হন কেউ কেউ। যেমন ড্যান প্রাইস— যাঁকে বলা চলে আধুনিক কালের এক রবিনহুড। ‘গ্র্যাভিটি পেমেন্টস’ নামে সিয়াটল-এর এক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও ছিলেন তিনি। কোম্পানির ১২০ জন কর্মচারীর সকলের মাইনে বাড়িয়ে দিলেন প্রাইস— করলেন বছরে ৭০,০০০ ডলার। আর এই অতিরিক্ত টাকা জোগাতে নিজের মাইনে বছরে ১১ লক্ষ ডলার থেকে কমিয়ে করলেন ৭০,০০০ ডলার। তাঁর বই ওয়ার্থ ইট এই ব্যতিক্রমী কর্পোরেট এবং সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক বিস্তারিত বর্ণনা।
২০২১-এ কিন্তু ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়া-র ম্যাট কিলিংসওয়ার্থ এক গবেষণাপত্রে দেখালেন, অর্থের সঙ্গে ভাল থাকা বাড়তেই থাকে। তার ঊর্ধ্বসীমা নেই। তা হলে কে ঠিক? এ সমস্যার সমাধানে এক ‘প্রতিপক্ষের সহযোগিতা’র বাতাবরণে কানেম্যান আর কিলিংসওয়ার্থ এক সঙ্গে বসলেন তাঁদের নিজেদের গবেষণার ‘ডেটা’ নিয়ে। পুনর্বিশ্লেষণের জন্য। তাঁদের যৌথ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩-এর মার্চে। তাঁরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, তাঁরা দু’জনেই ঠিক ছিলেন, কিন্তু কিলিংসওয়ার্থ একটু বেশি ঠিক। অর্থের সঙ্গে সুখের ধারাবাহিক উত্তরণ ঘটে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার ক্ষেত্রে। কিন্তু সুখের বিচারে সর্বনিম্ন এক-পঞ্চমাংশ জনগণের ক্ষেত্রে বার্ষিক এক লক্ষ ডলার আয়ের সীমারেখার পরে সুখের রেখচিত্র অনুভূমিক হয়।
কিন্তু, ভেবে দেখলে, এও তো সেই ভাল থাকার হিসাবই হল। ভাল থাকাটাই কি তা হলে সুখ? আজও? একটা কথা মনে রাখা ভাল, কানেম্যান আর কিলিংওয়ার্থের গবেষণায় আজকের মাপকাঠিতে যাঁরা পাঁচ লক্ষ ডলারের চাইতে বেশি রোজগেরে, তাঁদের ধরা হয়নি। তাই এই তত্ত্বের ছাঁচে ফেলা যাবে না সুন্দর পিচাই বা ইলন মাস্ক, ওয়ারেন বাফে বা জন রকফেলারকে। এবং এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবে না আড়াই হাজার বছর আগেকার হিমালয়ের এক ছোট্ট রাজ্যের রাজপুত্রের রাজ্যত্যাগের সুবিশাল ঘটনাকেও।
২০১৮-তে দিল্লির আপ সরকার সরকারি স্কুলে ছাত্রদের ‘হ্যাপিনেস ক্লাস’-এর ব্যবস্থা করে। তাতে ধ্যান, গল্প বলা, ইনডোর গেম, ইত্যাদির আয়োজন। সেই ক্লাস দেখে ভারত সফর-কালে বেজায় খুশি মেলানিয়া ট্রাম্প। কিন্তু ‘সুখ’ কি শেখানো যায়? অথবা, ‘সুখ’ কি ‘অসুখ’-এর বিপ্রতীপ বিন্দু? ফকিরের ‘সুখ’ দেখে ‘রাজার অসুখ’-এর রাজা নিজের ‘অসুখ’ নিজেই সারিয়ে নেন। কিন্তু ‘সুখ’ কি অর্জন করা গেল? কী ভাবে মাপা সম্ভব ‘সুখ’কে?
‘সুখ’ মাপার ধারণাটা অবশ্য এসেছে হিমালয়ের আর এক ছোট্ট দেশ ভুটান থেকে। ১৯৭৯ সালে বম্বে এয়ারপোর্টে এক সাংবাদিককে ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন ভুটানের ২৩ বছর বয়সি রাজা জিগমে সিংহে ওয়াংচুক। রাজা বলে বসলেন, গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্টের চাইতে গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এবং সেই সঙ্গে গোটা দুনিয়াকেই যেন এক নতুন দিশা দেখালেন তিনি। যেন তৈরি হল এক নতুন দর্শন। ভুটান অবশ্য এই গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে নাড়াচাড়া শুরু করে অনেক পরে, ২০০৮ নাগাদ। বাকি দুনিয়া সঙ্গে সঙ্গেই লুফে নেয় ‘সুখ’ মাপার তুলাযন্ত্র নির্মাণের এই ধারণাটা। পরিমাপের মানদণ্ড যদিও বদলে যায় অনেকটাই। তবু, ২০১২ থেকেই তৈরি হতে থাকল ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইন্ডেক্স’।
২০২৩-এর ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইন্ডেক্স-এর সারণি প্রকাশ পেয়েছে সম্প্রতি। ফিনল্যান্ড নাকি সবচেয়ে সুখী দেশ। ১৩৭টি দেশের তালিকায় ভারত ১২৬ নম্বরে। কী ভাবে মাপা হয় এই দেশগত সুখকে? জিডিপি-কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়। তার সঙ্গে নেওয়া হয় সামাজিক সহায়তা, সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার গড় সীমা, স্বাধীনতা, উদারতা, এবং দুর্নীতির অনুপস্থিতির হিসাবনিকাশ। এ সব মন্থন করে বানানো হয় ‘সুখ’ নামক যৌগিক পদার্থটা। তবে এ সবের কতটা যে ‘ভাল-থাকা’ আর কতটা যথার্থ ‘সুখ’, সে তর্ক তো চলবেই। দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকাটাই কি সুখ? সুখের সঙ্গে রোজগারের লম্বা হিসাবের ফর্দ নিয়ে অর্থনীতিবিদরা তো দড়ি টানাটানি করেই চলেছেন। ২০২৩-এর তালিকায় ভুটানকে কিন্তু খুঁজে পেলাম না। ২০১৯-এ ভুটান ছিল ৯৫ নম্বরে। তাতে অবশ্য আশ্চর্যের কিছুই নেই। সোজা হিসাব হল, সূচকের মানদণ্ডে সুখের জন্য নির্দিষ্ট মশলাগুলি যে দেশে মিলবে বেশি, তারাই এগিয়ে থাকবে সুখের তালিকায়।
সুখ দফতরের মন্ত্রী নিযুক্ত হয় ভেনেজ়ুয়েলা কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো দেশে। সুখকে কি তবু ধরা যায় দু’হাতের মুঠোয়? আবার ‘সুখ’ অবজ্ঞা করে কেউ কেউ যে ‘জয়’-এর সন্ধানে ছোটেন, সে তো আমরা জানিই। কিন্তু অনেকেই যে আবার ‘জয়’কে ‘সুখ’ বলে ভুল করে বসবেন, সেও তো অবশ্যম্ভাবী। ১৭৮৫ সালের গ্রাউন্ডওয়ার্ক অব দ্য মেটাফিজ়িক্স অব মরালস-এ দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট অবশ্য লিখছেন, “হ্যাপিনেস ইজ় নট অ্যান আইডিয়াল অব রিজ়ন, বাট অব ইমাজিনেশন।” ‘সুখের লাগিয়া’ আমাদের সাধনা তবু চলতেই থাকে। সুখ, অথবা ওই যাকে আমরা ‘সুখ’ মনে করি, তাই আর কী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy