Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪
দেশ জুড়ে ‘বেয়াড়া’ মানুষগুলো যাতে অশান্তি না করতে পারে...
Politics

শুধু রূপকথা আর চুপ কথা

এ দেশে কালো বলে কিছু নেই, সব সাদা। এখানে প্রতারণা নেই, কালোবাজারি নেই, দুর্নীতি নেই। এমনকি কেউ অসত্য বলে না।

ঈশানী দত্ত রায়
ঈশানী দত্ত রায়
শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২২ ০৪:৩৮
Share: Save:

এই দেশে নদীগুলো সব দুধের, আশপাশের লোক সোনার, রুপোর কলসি নিয়ে আসে আর দুধ ভরে নিয়ে যায়। এখানে প্রতিটি খেত শস্যশ্যামলা। এত ফসল ফলে যে সারা দেশের ১৩০ কোটির বেশি মানুষ এবং কোটি কোটি পশু-পাখি তা চার বেলা খায়। হ্যাঁ, এখানে পশু-পাখি ও মানুষ নিরামিষাশী। তাই কুমিরও খাবার না পেলে কাঁদে না। কুমিরের অশ্রু বিসর্জন এখানে নিষিদ্ধ। এখানে গাছ ফুল, ফলে ভরা। মনের ইচ্ছেয় সে সব গাছ সোনার, রুপোর, প্ল্যাটিনামের হয়ে যায়। যত ইচ্ছে তোলো, পরো, বিক্রি করো। দুঃখ-দুর্দশা কাকে বলে, দেশের লোকেরা জানে না।

যারা বলে গাছ আবার সোনার হবে কী করে, তাদের কল্পনাশক্তি বলে কিছুই নেই। কবি অশোকবিজয় রাহা ‘মায়াতরু’ কবিতায় লিখেছিলেন, “আবার যখন চাঁদ উঠত হেসে/ কোথায় বা সেই ভালুক গেল, কোথায় বা সেই গাছ/ মুকুট হয়ে ঝাঁক বেঁধেছে লক্ষ হীরার মাছ।” এখানে চাঁদের সঙ্গে ঝলসানো রুটির তুলনা করার প্রয়োজন নেই। কারণ এ দেশে বছর কয়েক আগে পোড়া রুটি আকাশে নয়, রেললাইনে পড়েছিল। যারা হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছিল শুকনো মুখে, তাদের রুটি। তারা কাটা পড়েছিল রেলের চাকায়, দোষ তাদের ছিল।

কারণ, এ দেশের রাজা ভারী ভাল মানুষ। তিনি কানে শোনেন না, চোখেও ভাল দেখেন না, কিন্তু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি প্রখর। সেই দৃষ্টি দিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, কোথায় অশান্তির সম্ভাবনা, কে বা কারা শব্দে বিপ্লব ঘটাতে পারে। তিনি মানেন শব্দ ব্রহ্ম। সেই ব্রহ্মতেজ দমনের জন্য তিনি কয়েক জন কর্মচারী রেখেছেন। তাঁরা মোলায়েম সম্মার্জনী দিয়ে সেই সব আপদকে বিদেয় করেন। না না, এ দেশের সংশোধনাগারও অতি মনোরম। সেখানে ধনী-দরিদ্র বিভেদ নেই, বিদ্বান এবং বাহুবলী সমান সম্মান পেয়ে থাকেন। তাই কোনও বিদ্বান যদি কারাগারের সোনার চামচেতে ভাত খেতে না পেরে সিপার চান, কেউ যদি সোনার মাটিতে শুতে না পেরে তক্তপোষ চান, রাজার কর্মচারীরা তা দেবেন কেন? আইন সকলের জন্যই সমান। তাই যত বিদ্বান, যত অসুস্থ, অশক্ত, বয়স্কই হোন না কেন, তাঁদের সোনার মাটিতেই শুতে হয়, উপবাসে থাকতে হয়। তা নিয়ে চিৎকার করে কোন অর্বাচীন! এই শান্তিপ্রিয় দেশে হোক কলরবের স্থান নেই, গোলযোগ যাতে না হয়, তাই দ্রুত অশান্তিকারীদের ধরে ধরে সংশোধনাগারে রেখে দেওয়া হয়।

কিন্তু কিছু মানুষ বড়ই বেয়াড়া। দেশ জুড়ে মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের বড় বড় যন্ত্র থাকলেও তাঁদের একবগ্গা মনোভাব বশ মানে না। তাই রাজা এবং তাঁর কর্মচারীরা শিক্ষা এবং ভাষা সংস্কারে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন। এতে দোষের কিছুই নেই। কারণ, যে শিক্ষা মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে, সেই শিক্ষাকে ধিক। যে ভাষা প্রতিবাদ করতে বলে, সেই ভাষাকে ধিক। ‘যৌন নির্যাতন’ উচ্চারণ করাও এ দেশে পাপ, কারণ এ দেশে সকলেই মহিলাদের গরুর মতো সম্মান করে, তাঁদের গায়ে হাত দেয় না। যদিও কু-ব্যক্তিরা বলে থাকেন, গরুর গায়ে হাত দিলে এ দেশে সাক্ষাৎ মৃত্যু, মহিলাদের ক্ষেত্রে তা ঘটে না।

এ দেশে কালো বলে কিছু নেই, সব সাদা। এখানে প্রতারণা নেই, কালোবাজারি নেই, দুর্নীতি নেই। এমনকি কেউ অসত্য বলে না। রাজাও সত্যবাদী তবে তা নিজের নির্মিত সত্য।

এ দেশে এক সময় কু-কথার বান ডেকেছিল। রাজার আসনের সামনে কিছু কিছু দুষ্টু লোক জুমলা, বিনাশপুরুষ, কালোবাজারি, কালো দিন, মিথ্যে, অসত্য ইত্যাদি নানা বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেছিল। রাজা তাতে আহত হন। এ দেশ ধর্মাশোকের, এখানে অশোক স্তম্ভের সিংহমূর্তি দাঁত বার করে গর্জন করতে পারে, কিন্তু চণ্ডাশোকের স্থান নেই, এখানে অহঙ্কার, রাগ, নিন্দা, হিংসা, ঈর্ষা, বিশ্বাসঘাতকতার স্থান নাই। সকলেই সকলকে ভাই, বোন এবং মিত্রোঁ বা সাথি বলে সম্বোধন করেন। এ-হেন দেশে ভালমানুষ রাজার এই অসম্মান কেন? দেশের আইনভঙ্গ করে সোনার লঙ্কার মতো ছারখার করার বাসনা কেন? এমন দয়াবান রাজা, রাজকর্মচারী, তাঁদের কুকথা বলা তো রাষ্ট্রদ্রোহ।

রাজা তো তা-ও তাঁদের শাস্তি দেননি, শুধু মুখের কুভাষা বন্ধ করতে চেয়েছেন, চেয়েছেন মিথ্যে ভাষণে লাগাম পরাতে।

আসলে আমরা প্রায় সকলে অল্পে খুব ভয় পাই আর অপপ্রচার করি। সুকুমার রায় কী লিখেছেন, মনে মনে ঝালিয়ে নিন—

হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাকবে না?

মুগুর আমার হাল্‌কা এমন মারলে তোমায় লাগবে না।

অভয় দিচ্ছি, শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?

বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!

আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে—

সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।

ওহো, একটা কথা তো বলাই হয়নি। ভাবছেন তো, জল ছাড়া জীবন বাঁচে কী করে? এখানে নদীতে তো দুধের ধারা, জল কই। সমুদ্র আছে, তাতে নোনা জল রয়েছে। অশ্রুরও স্বাদ নোনা। যে মানুষেরা পরিযায়ী পাখির মতো হেঁটে হেঁটে বাড়ি গেল, মরে গেল, করোনাকালে লঙ্গরখানায় দু’মুঠো ভাত চেটেপুটে খেল, তাদের ছবি প্রকাশিত হল (ভিনগ্রহে জলের মতোই তাদের কান্না দুর্লভ, তাই ছবি প্রকাশিত হয়েছিল), তাদের সবার নোনা জল বিশেষ প্রযুক্তিতে পানীয়যোগ্য করা হয়েছে। রোজ হয়।

আমাদের সবার গেলাসে, বোতলে, আঁজলায় সেই জল। রাজা তুষ্ট, আমরাও তুষ্ট। তাই আমাদের গলা দিয়ে আর নোনা জল বা ভাত উঠে আসে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy