Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
আমরা প্রশ্ন করিনি, ছেড়ে দিয়েছি, সরে গিয়েছি
Society

সেই পতাকা, জিলিপি এবং দেশ

জিলিপি আদ্যন্ত রাজনৈতিক খাদ্য, ফলে সে কখনও দেবে, কখনও কেড়ে নেবে, কখনও হতাশ করবে, কখনও মোক্ষম চাল দেবে জিভে, এটাই স্বাভাবিক।

boy.

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

ঈশানী দত্ত রায়
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৪৬
Share: Save:

লিখতে বসে নিজেকে সুকুমার রায়ের লক্ষ্মণের শক্তিশেল নাটকের দূত বলে মনে হচ্ছিল। রাবণের আগমন সংবাদ দিতে গিয়ে যে বলেছিল, “আমি চান টান করেই পুঁইশাক চচ্চড়ি আর কুমড়ো ছেঁচকি দিয়ে চাট্টি ভাত খেয়েই অমনি বেরিয়েছি— অবিশ্যি আজকে পাঁজিতে কুষ্মাণ্ড ভক্ষণ নিষেধ লিখেছিল, কিন্তু কি হল জানেন? আমার কুমড়োটা পচে যাচ্ছিল কিনা—”,

১৫ অগস্ট সকালে তিনটি জিলিপি ভক্ষণ করে একটি ছবি-সহ সমাজমাধ্যমে পোস্ট দিতে যাব বলে দুপুর পর্যন্ত পাঁয়তারা কষছি, ভেসে এল একটি ডাক, ‘লেবু নেবেন, ধনেপাতা নেবেন?’ এক বৃদ্ধ দুপুর রোদে ভ্যানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, লেবু, ধনেপাতা নিয়ে।

করোনার সময়ে এ দৃশ্য অনেক দেখেছেন সকলে, তবে স্বাধীনতা দিবসের দুপুরে এই অসহায় বৃদ্ধকে দেখে জিলিপির আস্বাদনটি মাঠে মারা গেল। কিন্তু জিলিপিটি থেকে গেল। কান্না পেল।

কেন?

জিলিপি আদ্যন্ত রাজনৈতিক খাদ্য, ফলে সে কখনও দেবে, কখনও কেড়ে নেবে, কখনও হতাশ করবে, কখনও মোক্ষম চাল দেবে জিভে, এটাই স্বাভাবিক।

অধুনা ডিম-ভাতের মতো জিলিপি প্রথম থেকেই রাজনৈতিক ভাবে জনপ্রিয়। তুলনায় কম পয়সায় ঢেলে খাওয়ানো যায় বলেই স্কুলে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক মিছিল, ভোটের জয়, সবেতেই জিলিপির একটি অগ্রাধিকার ছিল আগে। দেশনায়কদের জন্মদিনেও বিনা পয়সায় খাওয়াতে জিলিপির জুড়ি নেই। অন্তত জুড়ি ছিল না। সে দিন কি সত্যিই গিয়াছে? এখন লাড্ডু, তবকে মিষ্টি বিলোতে দেখে তা মনে হয় বইকি।

— বুঝতে পেরে গিয়েছি মশাই, এখন ‘আহা, আমাদের সময়ে কী ছিল’ বলে মস্ত কাঁদুনে গল্প ফেঁদে বসবেন তো।

তা ঠিকই ধরেছেন, আর কান্না নিয়ে যখন খোঁচা দিলেন, তখন শুনুন, সেই আমাদের সময়ে একটি ছায়াছবির সংলাপ ছিল,

“ছাদে যাব

কেন?

একটু কাঁদব

বেশি নয়, অল্প কাঁদব। একটু কেঁদেই চলে আসব।”

তখন কান্না ছিল।

এখনও পেল। সেই সব জিলিপির জন্য। জাতীয় পতাকাটার জন্য। স্কুলে ১৫ অগস্ট বা ২৬ জানুয়ারিতে স্কুলের অনুষ্ঠানের জন্য, সাদাকালো টেলিভিশনের পর্দায় ১৫ অগস্টের কুচকাওয়াজের জন্য, মফস্‌সলের সিনেমা হলে বিদ্যাসাগর আর টেলিভিশনে সুভাষচন্দ্র ছবিটা বাধ্যতামূলক দেখার জন্য।

তখন রাগ হত। উফ্, ১৫ অগস্ট বা ২৬ জানুয়ারি হলে সকালে উঠে টেলিভিশনের পর্দায় দেখতেই হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাজপথের ওই অনুষ্ঠান? তখন বুঝিনি, চলমান ছবি আর মাঝে মাঝে শান্ত স্বরে তথ্য জানানোর সংযমের জন্য আকিঞ্চন এক দিন ফুলে উঠবে ভিতরে, এই চিৎকৃত জাতীয়তাবাদের যুগে। কেউ দড়ি ধরে আস্তে আস্তে টানবেন, আর জাতীয় পতাকাটা খুলে দিয়ে ফুল ঝরে পড়বে, এই দৃশ্যে তখন বিস্ময় ছিল আর বিস্ময় মানে নিখাদ পবিত্রতা।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্কুলে গিয়ে এই আচরণ পালন করেছে, মা-বাবার শাসনে টেলিভিশনে বা সিনেমা হলে দেশপ্রেমধর্মী সব ছবি দেখতে বাধ্য থেকেছে। ১৫ অগস্ট বা ২৬ জানুয়ারি বাবা-মায়ের শাসনে এবং স্কুলে পতাকা তুলে নমস্কার করতে শিখেছে, পাখনা গজালে সেই অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু এ শিক্ষা স্কুলে বইয়ে মলাট দেওয়ার মতো, এক বার শিখলে সারা জীবন থেকে যায়। ভালবাসায়, স্মৃতিতে। এখন ইউটিউব খুঁজে খুঁজে সেই সব প্রজন্ম তাই দেখে, কারণ তাদের মনে হয়, এক বার ফিরুক সেই সাদাকালো ছবিগুলো, যেখানে কেউ চিৎকার করবে না, বালক সুভাষচন্দ্রকে দৃঢ় স্বরে হেডমাস্টারমশাই বলবেন, মুখ উঁচু করে সামনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়াতে, ৪২ ছবির অত্যাচারী পুলিশ অফিসারকে দেখে মনে হবে, মেরেই ফেলি, আর বিদ্যাসাগর ছবির সংলাপ শুনে মনে হবে, ১৯৫০ সালে লেখা হয়েছিল এই সংলাপ! যেখানে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন করছেন, হিন্দু মানে কী? এখন হলে তো সেন্সরের ছাড়পত্র পেত না। অথচ কেউ তখন বিরোধিতা করেছিল বলে মনে পড়ে না।

আসলে ভালবাসতে শেখানোর কোনও ইস্কুল ছিল না তখন। মিশনারি স্কুলে পড়তে হত রামায়ণ-মহাভারত, হজরত মহম্মদ, শ্রীচৈতন্য, বুদ্ধদেব, সব ধর্মের মহাপ্রাণদের জীবনী, পরীক্ষাও হত। তাই নিয়ে প্রশ্ন করেনি কেউ, তবে এটুকু বলা ছিল বাইবেলের পরীক্ষা দিতে বাধ্য নয় কেউ, কিন্তু প্রায় সকলেই দিত, কারণ গল্পগুলো সকলেরই মুখস্থ ছিল। কেরলের এক মিশনারি মহিলা একার হাতে আগলে রেখেছিলেন স্কুল, নকশাল আমলের হুমকিও তাঁকে স্কুল খোলা রাখা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এলাকা সেই দাপটকে শ্রদ্ধা করেছে। স্কুলের সামনে একটি মাজার ছিল। পরীক্ষার আগে মাজারে আর স্কুলের ভিতরে গির্জায় মাথা ঠেকাতে কারও দ্বিধা ছিল না।

ঠিকই বলেছেন, তখন স্বৈরাচার ছিল, তার জবাবও ছিল, কালো আঙুলের নখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, আর পাশে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে লেখা স্লোগান, সেই ছবি আঁকা দেওয়ালের স্কুলে পড়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। খুন ছিল, দুর্নীতি ছিল, ভাগাভাগি ছিল, হিংসা ছিল, কিন্তু এ ভাবে গল গল করে সর্বগ্রাসী বন্যার মতো ভাসিয়ে নেয়নি। মহাকাশে গেলেন রাকেশ শর্মা, মর্তে বসে তাঁকে প্রশ্ন করতে গলা কেঁপেছিল ইন্দিরা গান্ধীরও, বলেছিলেন, মহাকাশ থেকে ভারতকে কেমন দেখেছেন? রাকেশ বলেছিলেন, সারে জহাঁ সে আচ্ছা।

কে জানত, সেই ভারতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম থেকে এক দিন বাদ পড়ে যাবে সারে জহাঁ সে আচ্ছা-র স্রষ্টা কবি মহম্মদ ইকবালের লেখা!

মুক্তিযুদ্ধ কাকে বলে বুঝিনি তখন, শুধু স্মৃতি আছে, পিতৃব্যের বন্ধু এসে বলছেন, জয় বাংলা, শাঁখ বাজাতে বলো নিরঞ্জন। সারা পাড়া শাঁখ বাজাচ্ছে, ঠাকুমা বাজাচ্ছেন। আর পিতৃব্য সব ভুলে চিৎকার করছেন জয় বাংলা, জয় বাংলা বলে। এক ১৫ অগস্টে যাদের গৃহপ্রবেশ হয়েছিল, যে বাড়ির তলায় রাখা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে আনা মাটি, বাড়ির মাটি। সেই রকম অনেক বাড়িতে ঘুরে ঘুরে আসত মুশকিল আসান, শুচির বদভ্যাস থাকা ঠাকুমাও যে চামরের তলায় মাথা পাততেন, নাতনিদের পাঠাতেন সেই চামরের বাতাস খেতে। কে জানত, জয় বাংলা এক দিন হয়ে দাঁড়াবে রাজনৈতিক কামড়াকামড়ির বিষয়।

মূল প্রশ্নটা কিন্তু এড়িয়েই গেলাম। একেবারে অন্য একটা দেশেই যদি মশাই আপনারা বড় হয়ে উঠেছেন, তা হলে এখন এত বিষ কেন?

আমরা প্রশ্ন করিনি, আমরা ছেড়ে দিয়েছি, আমরা সরে গিয়েছি।

আমরা গেরুয়া রংকে, সবুজ রংকে, নীল রং, লাল রংকে রাজনীতির রং হতে দিয়েছি।

আমরা ভালবাসাকে রক্ষা করিনি। আমরা বিলাপ করেছি। আমরা পালিয়েছি।

অন্য বিষয়গুলি:

Society Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy