Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
বিজেপি কিন্তু দুর্নীতি-অভিযুক্ত নেতাদের কাছে টেনে নিয়েছে
BJP

আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি?

মোদী বলেননি, তিনি একাই ৩৭০ আসনে বিজেপিকে জিতিয়ে দেবেন। এই সবটা মিলিয়ে বিজেপির যে ভোট জেতার যন্ত্র, তার ৩৭০ আসন জয়ের কথাই বলেছিলেন।

ক্ষোভাগ্নি: মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালকে গ্রেফতার করার পর আপ বিধায়কদের প্রতিবাদ কর্মসূচি, দিল্লি, ২৭ মার্চ। পিটিআই।

ক্ষোভাগ্নি: মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালকে গ্রেফতার করার পর আপ বিধায়কদের প্রতিবাদ কর্মসূচি, দিল্লি, ২৭ মার্চ। পিটিআই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪ ০৮:০১
Share: Save:

আত্মবিশ্বাস কি কম পড়িয়াছে? বিজেপির আত্মবিশ্বাস। কম পড়িয়াছে? প্রশ্ন একটা উঠছে বইকি। প্রথমে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। তার পরে বিআরএস নেত্রী কে কবিতা। শেষে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়াল। ভোটের ঠিক দোরগোড়ায় ইডি একের পর এক বিরোধী শিবিরের নেতানেত্রীকে গ্রেফতার করছে। এই ‘মরিয়া’ ভাব দেখে অনেকের মনে হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী মোটেই তৃতীয় বার ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী নন। মুখে তিনি এনডিএ এ বার চারশো পার করে যাবে বলে যতই ভবিষ্যদ্বাণী করুন, বাস্তবে বিজেপির আত্মবিশ্বাসে টান পড়েছে। তাই বিরোধীদের জেলে পুরে, নির্বাচনকে বিরোধী-মুক্ত করে দিয়ে বিজেপি ভোটে জিততে চাইছে।

ঠিক এবং ভুল। নরেন্দ্র মোদীর মতো বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ ভূ-ভারতে কমই রয়েছে। তিনি মোটেই মনে করেন না যে, তিনি ভোটের ময়দানে গিয়ে দাঁড়াবেন এবং বসন্তের ঝরা পাতার মতো বিজেপির ঝুলিতে ভোট পড়তে থাকবে। বিজেপিও জানে, মোদী সরকার দশ বছর ক্ষমতায় কাটিয়ে গিয়েছে। মানুষ আর সত্তর বছরে কী কী হয়নি, শুধু তার ভিত্তিতে ভোট দেবেন না। মোদী সরকারের কাজও নিক্তিতে মাপা হবে। বেকারত্বের মতো বাস্তব সমস্যা ধামাচাপা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। মানুষের আয় না বাড়লেও বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। ধনী-গরিবের অসাম্য ক্রমবর্ধমান। এই সব প্রশ্ন ভোটারদের মনে উঠে আসবেই।

এই বাস্তবতা সত্ত্বেও বিজেপি ৩৭০ আসনে জিতবে এবং এনডিএ-র সাংসদ সংখ্যা চারশো পেরিয়ে যাবে বলে নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছিলেন। সেটা ভবিষ্যদ্বাণী নয়। তিনি বিজেপি নামক ভোট জেতার যন্ত্র বা ‘ইলেক্টোরাল মেশিনারি’-র জন্য লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছিলেন। বিজেপি নেতৃত্বও মোটেই ধরে নেয়নি যে, নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় ভর করেই ৩৭০ আসন পকেটস্থ হবে। বিজেপি জানে, তার জন্য সর্বশক্তি দিতে হবে। রাজ্যে-রাজ্যে শিবরাজ সিংহ চৌহান থেকে বাসবরাজ বোম্মাইয়ের মতো প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীদের লোকসভা ভোটে লড়াতে হবে। গভীর রাত পর্যন্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্থনের পরে প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্রে জাতপাতের সমীকরণ মেনে প্রার্থী ঠিক করতে হবে। প্রয়োজনে পুরনো সাংসদদের বাদ দিতে হবে। কিছু বিরোধীকে সিবিআই বা ইডি-র সাহায্যে নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে। বিজেপির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কর্পোরেট সংস্থাগুলির দেওয়া কোটি কোটি টাকা চাঁদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে উঠুক। ত্রিশ বছরের পুরনো আয়করের অনিয়মের নোটিস পাঠিয়ে কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করাতে হবে। প্রয়োজনে কর্নাটকে ন’টি সিবিআইয়ের মামলায় অভিযুক্ত খনি মাফিয়া জি জনার্দন রেড্ডিকে বরণ করে দলে ফিরিয়ে আনতে হবে। যে কংগ্রেসের নেতাদের বিরুদ্ধে বিজেপি এত দিন দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে, তাঁদেরও বিজেপিতে নিয়ে আসতে হবে। আর এনডিএ-কে চারশো পার করাতে হলে যে সব শরিক দলের নেতাদের জন্য বিজেপির দরজা বন্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, প্রয়োজনে আবার তাঁদের বুকে টেনে নিতে হবে। তার সঙ্গে রামমন্দিরকে ঘিরে ভাবাবেগ, সিএএ-এনআরসি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির মতো মেরুকরণের হাতিয়ারও থাকবে।

মোদী বলেননি, তিনি একাই ৩৭০ আসনে বিজেপিকে জিতিয়ে দেবেন। এই সবটা মিলিয়ে বিজেপির যে ভোট জেতার যন্ত্র, তার ৩৭০ আসন জয়ের কথাই বলেছিলেন। রাহুল গান্ধী হয়তো একেই নরেন্দ্র মোদীর পিছনের ‘আসুরিক শক্তি’ বলতে চেয়েছিলেন।

ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পরে ১৯৮৪ সালের ভোটে কংগ্রেস চারশোর বেশি আসনে জিতেছিল। তার পরে আর কোনও শাসক দল লোকসভা নির্বাচনে চারশোর বেশি আসনে জিতে ক্ষমতায় ফেরেনি। বস্তুত তার পরের তিন দশকে আর কোনও দল একার জোরে সরকার গড়ার মতো লোকসভায় ২৭২টি আসনই জেতেনি। ২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদী তা করে দেখিয়েছিলেন। দেশ জুড়ে ইউপিএ সরকারের প্রতি বিতৃষ্ণা, উল্টো দিকে মোদীর ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন বাজি মাত করেছিল। ২০১৯-এ তিনশোর বেশি আসনে জয়ে পুলওয়ামার ঘটনাকে ঘিরে জাতীয়তাবাদের আবেগ অনুঘটকের কাজ করেছিল।

মনে করা হচ্ছিল, এ বার ভোটের ঠিক আগে রামমন্দিরকে ঘিরে আবেগ একই অনুঘটক হয়ে উঠবে। কিন্তু ভোট যত এগিয়ে আসছে, ততই স্পষ্ট, বিজেপি রামমন্দিরের আবেগের ভরসায় নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না। মোদী তাঁর দশ বছরের কাজের সাফল্য বর্ণনায় অক্লান্ত। তা বলে তিনি জয় নিশ্চিত বলে হাত গুটিয়ে বসে নেই। বরং ভোট-জয়ে কোনও কসুর বাকি রাখতে বিজেপি নারাজ। তাতে যদি বিরোধীদের জেলে পোরার জন্য স্বৈরতন্ত্রের অভিযোগ ওঠে, যদি নৈতিক-অনৈতিকের সীমারেখা ম্লান হয়ে যায়, তা হলেও কুছ পরোয়া নেই।

কর্নাটকে খনি মাফিয়া জি জনার্দন রেড্ডিকে বিজেপিতে ফিরিয়ে আনাই যেমন। নরেন্দ্র মোদী গোটা বিরোধী শিবিরকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে কালিমালিপ্ত করছেন। কিন্তু সিবিআইয়ের ন’টি মামলায় অভিযুক্ত খনি মাফিয়া রেড্ডিকে দলে ফেরাতে বিজেপি দ্বিতীয় বার ভাবেনি। ইউপিএ আমলের আদর্শ আবাসন কেলেঙ্কারি নিয়ে বিজেপি মহারাষ্ট্রে অশোক চহ্বাণের দিকে আঙুল তুলেছিল। কয়লা খনি বণ্টন কেলেঙ্কারিতে বিজেপির নিশানায় ছিলেন নবীন জিন্দল। দুই প্রাক্তন কংগ্রেসিকেই বিজেপি দলে স্বাগত জানিয়েছে। সর্বোপরি, সাত বছর আগে কর্নাটকের রেড্ডিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের দায় ঝেড়ে ফেলতে অমিত শাহ বলেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে বিজেপির কোনও সম্পর্ক নেই। সেই অমিত শাহই এখন রেড্ডিকে বলেছেন, তাঁর দলকে বিজেপিতে মিশিয়ে দিতে। সে অবশ্য অমিত শাহ এক কালে নীতীশ কুমার, চন্দ্রবাবু নায়ডুদের জন্যও বিজেপির দরজা বন্ধ বলে ঘোষণা করেছিলেন। এখন এনডিএ-র শক্তি বাড়াতে তাঁদেরই আবার কাছে টেনে নিয়েছে বিজেপি। কর্নাটকে জেডি(এস)-র সঙ্গে জোট করার পরে ওড়িশায় বিজু জনতা দল, পঞ্জাবে শিরোমণি অকালি দলের সঙ্গেও জোট করার চেষ্টা সফল হয়নি।

বিজেপি নেতারা জানেন, দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে লোকসভায় আসন সংখ্যা ৩০৩ থেকে বাড়িয়ে ৩৭০-এ নিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। উত্তর ভারতে বিজেপির আসন সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ খুব কম। তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, পঞ্জাবে বিজেপির শক্তি এতই কম যে, সেখানেও বিজেপির আসন সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা নেই। কর্নাটকে বিজেপি পাঁচ বছর আগে ২৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৫টি আসনে জিতেছিল। এ বার সিদ্দারামাইয়া-ডি কে শিবকুমারের কংগ্রেস-শাসিত কর্নাটকে বিজেপির আসন সংখ্যা কমলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্দের শিবসেনা ও অজিত পওয়ারের এনসিপি-র সঙ্গে জোটের পরেও এনডিএ পাঁচ বছর আগের মতো ৪৮টির মধ্যে ৪১টি আসন জিততে পারবে কি? একই ভাবে বিহারে এনডিএ গত লোকসভায় ৪০টির মধ্যে ৩৯টি আসন জিতেছিল। এ বার কি নীতীশ কুমারকে সঙ্গে নিয়েও সেই রেকর্ড ধরে রাখা যাবে? উত্তরপ্রদেশে বিজেপি আবার ৮০টির মধ্যে ৭১টি আসনে জয়ের লক্ষ্য নিচ্ছে। আপাত ভাবে মনে হয়, তার জন্য তো অযোধ্যায় রামমন্দির থেকে যোগী আদিত্যনাথের বুলডোজ়ারই যথেষ্ট। তা হলে আর জয়ন্ত চৌধরির রাষ্ট্রীয় লোক দলকে এনডিএ-তে টানতে তাঁর পিতামহ চৌধরি চরণ সিংহকে ভারতরত্ন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ল কেন!

নরেন্দ্র মোদী মুখে যা-ই বলুন, বিজেপি ৩৭০ আসন জিতে গিয়েছে ধরে নিয়ে বসে নেই। বিজেপি-আরএসএসের সংগঠনও নিশ্চয়ই জানান দিয়েছে, এখনও তেমন কোনও হাওয়া নেই। বিজেপি তাই প্রতিটি আসন জিততে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছে। দিল্লিতে মাত্র সাতটি লোকসভা আসন। কেজরীওয়াল দিল্লির বিধানসভায় বিজেপিকে টেক্কা দিলেও লোকসভায় এই সাতটি আসন গত দশ বছর বিজেপির দখলে। এ বার আম আদমি পার্টি ও কংগ্রেস আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়ছে। এই জোটকে ধাক্কা দিতে তার প্রধান মস্তিষ্ক কেজরীওয়ালকে প্রচার থেকে সরিয়ে রাখা দরকার ছিল। সেটাই করা হয়েছে। কেজরীওয়াল-হীন আম আদমি পার্টি ও ছত্রভঙ্গ বিরোধী শিবির এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নরেন্দ্র মোদী ভয় পেয়ে গিয়েছেন বলে আমজনতাকে বোঝাতে পারবে, এমন আশা কম। কেজরীওয়ালকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে যদি জনমানসে ক্ষোভ তৈরি হয়, তার প্রভাবও দিল্লির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এই অঙ্ক কষেই বিজেপি তার পূর্ণ শক্তি দিয়ে ভোটে লড়তে নেমেছে। ঠিক যে ভাবে বিজেপি ভোটে লড়ে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy