Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
গ্যাসলাইটিং: ব্যক্তিপরিসরের বাইরে সমাজ-রাজনীতির নতুন শব্দ
Society

আলোআঁধারির পরিবৃত্তে

‘গ্যাসলাইটিং’ তাই এক ঘটনামাত্র নয়, এ এক পদ্ধতি। এক সুপরিকল্পিত কৌশল, যার মধ্যে সম্পৃক্ত হয়েছে বিভ্রান্তি, মিথ্যা, প্রতারণা, বিচ্ছিন্নতা, অস্বীকার, অভিযোগ, আরও অনেক কিছু।

পরিকল্পিত ভাবেই তার স্ত্রীর পারিপার্শ্বিককে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা করে গ্রেগরি।

পরিকল্পিত ভাবেই তার স্ত্রীর পারিপার্শ্বিককে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা করে গ্রেগরি। প্রতীকী ছবি।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৫৪
Share: Save:

ইনগ্রিড বার্গম্যান অভিনীত ১৯৪৪-এর অস্কার-বিজয়ী ছবি গ্যাসলাইট (ছবিতে একটি দৃশ্য) তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ নাট্যকার প্যাট্রিক হ্যামিলটনের ১৯৩৮-এর নাটক অবলম্বনে। সেখানে ভিক্টোরীয় যুগের লন্ডনের গ্রেগরি তার স্ত্রী পলা-কে মানসিক ভাবে অসুস্থ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে, তার সম্পদ আত্মসাৎ করার অভিপ্রায়ে। বিশ্বাস করাতে চায় যে, পলা ক্রমশ ভুলে যাচ্ছে অনেক কিছু। পলা উপরের ঘরে পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়, গ্যাসলাইটগুলি হঠাৎ ম্লান হয়ে উঠতে দেখে। গ্রেগরি তাকে বোঝায় যে, সবই পলার কল্পনা। বাস্তবে অবশ্য এই পদশব্দ কিংবা আলো ম্লান হয়ে যাওয়াটা একেবারেই সত্যি ঘটনা; উত্তরাধিকারসূত্রে স্ত্রীর পাওয়া দামি গয়না উপরের তলায় অনুসন্ধান করেছে গ্রেগরি, এ সব তারই ফল। কিন্তু পরিকল্পিত ভাবেই তার স্ত্রীর পারিপার্শ্বিককে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা করে গ্রেগরি।

এ হল ব্যক্তিগত পর্যায়ে গ্যাসলাইটিং-এর রূপচিত্র। কিন্তু এ তো কেবলমাত্র ভিক্টোরীয় লন্ডনে আবদ্ধ থাকতে পারে না। এর ব্যাপ্তি দুনিয়া জুড়ে। এবং নাটক-চলচ্চিত্রের গণ্ডি পেরিয়ে তা মনস্তত্ত্ববিদ্যার চৌহদ্দিতে ঢুকে পরে ১৯৬৯ নাগাদ। তার পর, মোটামুটি বছর ছয়েক আগে, মনস্তত্ত্বের নোটবইয়ের পৃষ্ঠা পিছলে তা এসে পড়ে জনগণেশের ড্রয়িং রুমে। সেটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান-কাল। সভ্যতার ইতিহাসের এই অমোঘ পরিবর্তনটার পিছনে ট্রাম্প এবং অন্য কিছু রাজনীতিবিদের প্রভূত অবদান। তবে সেই সঙ্গে গ্যাসলাইটিং-এর চরিত্র এবং প্রকরণও বদলায়। ব্যক্তির গণ্ডি পেরিয়ে তা ক্রমে হয়ে পড়ে সমষ্টিগত গ্যাসলাইটিং: এক সঙ্গে বহু মানুষকে আবিষ্ট করে রাখা এবং সমাজ জুড়ে সফল ভাবে ‘পোস্ট ট্রুথ’-এর মায়াজাল বিস্তার করা।

‘পোস্ট ট্রুথ’ শব্দবন্ধটাও বোধকরি সাম্প্রতিক অতীতে এক নতুন চেতনার নির্মাণ। বিষয়টা নতুন কিছু নয়, অতীতেও এর প্রয়োগ হয়েছে। তবে এই রিমেক-এর কৃতিত্বও ট্রাম্প-সহ হালের কিছু রাজনীতিবিদেরই। ২০১৬-তে অক্সফোর্ড অভিধানের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হয়েছিল ‘পোস্ট ট্রুথ’, যা আধুনিক সভ্যতার গতিপ্রকৃতির নির্দেশক বলা চলে। উত্তর-সত্যতার এই নতুন তত্ত্বটা আপাত ভাবে বিমূর্ত ঠেকতে পারে। এর জগৎটাকে খানিক বুঝতে পারলেও এই মায়া-আবেশের সৃষ্টি-কৌশল কী রকম, এই জাদু-দুনিয়ায় ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্রটা ঠিক কী, তা অনুধাবন করতে হিমশিম খেয়েছে জনগণ।

এমনই পরিপ্রেক্ষিতে ‘গ্যাসলাইটিং’ শব্দটা এক ব্যাপকতর অর্থ পেল। মেরিয়ম-ওয়েবস্টার ডিকশনারি অনুসারে ‘গ্যাসলাইটিং’ দাঁড়াল কোনও ব্যক্তির উপরে প্রযুক্ত এক মনস্তাত্ত্বিক কৌশল, যা সাধারণত প্রয়োগ করা হয় অনেকটা সময় ধরে। এর ফলে ‘শিকার’ তার নিজের চিন্তাভাবনার ন্যায্যতা এবং বাস্তবতা, এমনকি নিজের স্মৃতি নিয়েও সন্দেহ করতে শুরু করে। তার মধ্যে তৈরি হয় দ্বিধা, হারিয়ে যায় আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসম্মান, আবেগ বা মানসিক স্থিতিশীলতায় তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। সেই সঙ্গে আসে অপরাধীর উপর নির্ভরতা।

২০১৬-তেই লরেন ডুকা লেখেন, ‘গ্যাসলাইট’ হল মনস্তাত্ত্বিক কৌশলের সাহায্যে কাউকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যখন সে নিজের মানসিক সুস্থতা সম্পর্কেই সন্দেহ প্রকাশ করবে, এবং আমেরিকায় ট্রাম্প ঠিক তা-ই করছেন। আবার ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরেই, ২০১৭-র জানুয়ারিতে, সিএনএন-এর ফ্রিদা ঘিটিস তাঁকে বর্ণনা করেন আমেরিকার ‘গ্যাসলাইটার ইন চিফ’ হিসেবে। তাই যে উত্তর-সত্যতার আবেশ ছড়িয়েছেন ট্রাম্প, মিডিয়াকে বারংবার কাঠগড়ায় তুলেছেন ‘ফেক নিউজ়’ ছড়ানোর অভিযোগে, তার সৃষ্টি-কৌশল হিসেবে গ্যাসলাইটিং-কে চিহ্নিত করতে দেরি করেননি বিশেষজ্ঞরা। এর প্রয়োগ হয়েছে অন্যত্রও। ব্রেক্সিটের পটভূমিতে ব্রিটিশ সরকারও ব্যবহার করে গিয়েছে একই কৌশল, এমন অভিযোগও আছে।

২০১৮-তেই কিন্তু ‘গ্যাসলাইটিং’ শব্দটি অক্সফোর্ড ডিকশনারির ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হওয়ার দৌড়ে ছিল। ‘ভুয়ো খবর’, ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’, ‘টুইটার ট্রল’, ‘ডিপফেক’ ইত্যাদির সমাহারে ‘গ্যাসলাইটিং’ এ কালের একটি উল্লেখযোগ্য শব্দ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মেরিয়ম-ওয়েবস্টারের হিসাবে এ বছর শব্দটির ব্যবহার বেড়েছে ১,৭৪০%। হয়েছে তাদের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’।

‘গ্যাসলাইটিং’ তাই এক ঘটনামাত্র নয়, এ এক পদ্ধতি। এক সুপরিকল্পিত কৌশল, যার মধ্যে সম্পৃক্ত হয়েছে বিভ্রান্তি, মিথ্যা, প্রতারণা, বিচ্ছিন্নতা, অস্বীকার, অভিযোগ, আরও অনেক কিছু। এ-ও যেন এক অরওয়েলীয় জগৎ। পোস্ট ট্রুথ দুনিয়ায় ক্রমেই শিকড় গাড়তে থাকে সমষ্টিগত গ্যাসলাইটিং। এ এমনই এক জগৎ যেখানে ‘নির্বাচন’, ‘বিরোধিতা’, ‘অধিকার’, এই সব শব্দও ক্রমে উপহাস হিসেবে পর্যবসিত হতে শুরু করে। যেমন, ‘ফেক নিউজ়’ বলে কোনও খবরকে দাগিয়ে দিতে পারলেই তো প্রকারন্তরে তালা দেওয়া যায় বাক্‌স্বাধীনতার অন্দরে। কিন্তু সেই দাগিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিটা জানা চাই। বহুসংখ্যক মানুষকে সেটা বিশ্বাস করাতে হবে। সমষ্টিগত ‘গ্যাসলাইটিং’ যেন এরই এক কার্যকর মাধ্যম। আবার ‘ফেক নিউজ়’-কে ‘রিয়াল নিউজ়’ হিসেবে প্রচারের চেষ্টাও কি গ্যাসলাইটিং নয়? ও-দিকে গুরুত্বপূর্ণ কোনও ভোটে হারলে নির্বাচনটাকেই ‘কারচুপি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু জনগণকে তা বিশ্বাস করানো সহজ নয় নিশ্চয়। জনমানসে এই প্রত্যয় জাগানো এবং তাকে দীর্ঘ দিন ধরে লালন করা সম্ভব সমষ্টিগত গ্যাসলাইটিং-এর সফল প্রয়োগে। এই তো, এখনও বহু আমেরিকানই বিশ্বাস করেন যে, ২০২০-র আমেরিকার নির্বাচনে আসলে জিতেছিলেন ট্রাম্পই।

কী কী ধরনের হতে পারে এই গ্যাসলাইটিং-এর পদ্ধতি? প্রধানত তিন রকমের গ্যাসলাইটিং-এর কথা আলোচনা করা হয়। বিপরীত আখ্যান তৈরি করা, সমালোচকদের ধুইয়ে দেওয়া, এবং সরল তথ্যকেও অস্বীকার করে যাওয়া। যেমন, ২০১৪-তে ইউক্রেনের আকাশে ধ্বংস হয় এক যাত্রিবাহী মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান। এ নিয়ে শোরগোল হয় বিস্তর। রাশিয়া-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এর পিছনে রয়েছে, এমন অভিযোগও ওঠে। ক্রেমলিন কিন্তু এ নিয়ে নানা ধরনের গল্প তৈরি করে গিয়েছে বছরের পর বছর। কখনও বলেছে এ কাজ ইউক্রেনের, কখনও বিমানটাকে ‘মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে, কখনও বলেছে এ ক্ষেত্রে আসল লক্ষ্য ছিল পুতিনের বিমান। এই বিপরীতধর্মী নতুন-নতুন আখ্যানকে ‘গ্যাসলাইটিং’-এর এক কৌশল বলে বর্ণনা করেছেন রিটডায়েক। আবার সদ্য নির্বাচনে পরাজিত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো-র আমলে আমাজ়নের বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্যকে পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংসের অভিযোগ উঠেছে বার বার। আর বোলসোনারোও অভিযোগ অস্বীকার করে গিয়েছেন। এই ক্রমান্বয়ে অস্বীকার করে যাওয়াটাও ‘গ্যাসলাইটিং’-এর এক প্রকরণ। অতিমারির সময় ট্রাম্প কিংবা বোলসোনারো-র মতো রাষ্ট্রনায়করা বার বার যে স্টাইলে ভাইরাস এবং তার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাকে ‘ফেক নিউজ়’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, সেটাও ‘গ্যাসলাইটিং’-এরই এক রূপ।

মুশকিল হচ্ছে সাধারণ মানুষের পক্ষে সত্যি আর মিথ্যার তফাত করা সম্ভব নয় সব সময়। ও-দিকে ‘গ্যাসলাইটিং-কে প্রতিরোধ করাও সহজ নয়। কেউ কেউ মনে করেন, সুপরিকল্পিত উপযুক্ত ‘প্রতিধ্বনি’ তৈরি করাই প্রতিরোধের সঠিক উপায়। সে চেষ্টাও চলে নানা ভাবে। কিন্তু ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি ব্যঙ্গ করলেই কি ধ্বনি ল্যাজ গুটিয়ে পালাবে, না কি তৈরি হবে এক নতুন সামাজিক সংঘাত, যার আবর্তে দিকভ্রান্ত হবেন সাধারণ মানুষ? কে জানে!

সভ্যতার এক জটিল সময়ের গোলকধাঁধায় পড়ে তাই স্তিমিত হয়ে আসে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত আলোর শিখা। এবং সেই আলোআঁধারিতেই ‘পোস্ট ট্রুথ’-এর ধূসর দুনিয়ার পরিধি ক্রমে ব্যাপ্ত হয়। এটাই আজকের ধ্রুব সত্য। তবু, সাম্প্রতিক কালে ‘গ্যাসলাইটিং’ শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার ইঙ্গিত দেয় যে, সচেতন জনগণ হয়তো ক্রমেই অনুধাবন করছে সমষ্টিগত ‘গ্যাসলাইটিং’-এর পদ্ধতি-প্রকরণ, আবিষ্কার করছে এর সঙ্গে উত্তর-সত্যতার নিবিড় যোগসূত্র, উপলব্ধি করছে ‘গ্যাসলাইটিং’-ই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে ‘পোস্ট ট্রুথ’-এর বুদ্বুদটাকে। এক ধূসর সময় কালে এটাই হয়তো উজ্জ্বল আলোক-বর্তিকা। কে বলতে পারে, পলাও হয়তো এক দিন ফিরে পাবে আত্মবিশ্বাস, গ্রেগরিকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস না করে উপরতলায় পদশব্দ কিংবা ম্লান আলোকে নিজের মনের ভুল হিসেবেই মেনে না নিয়ে ভাবতে বসবে তার কার্যকারণ। কোনও দিন।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

অন্য বিষয়গুলি:

Society Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy