নাগরিক: উন্নয়নের বাইরে থেকে গিয়েছেন যাঁরা। —ফাইল চিত্র।
শাসক দলের এক নেতা বছরকয়েক আগে টেলিভিশনের সান্ধ্য বিতর্কে বেজায় নাকাল হন, ট্রিলিয়নে ক’টি শূন্য থাকে জানতে চাওয়ায়। তবে, ট্রিলিয়নের মার নেই— তিন, পাঁচ ছাড়িয়ে এখন সাত ট্রিলিয়ন ডলার আয়তনের অর্থব্যবস্থা তৈরির খোয়াব ফিরি করছেন ভারতীয় অর্থনীতির হর্তাকর্তারা। অর্থব্যবস্থার ভাল-মন্দ বিচারে জিডিপি-র অঙ্কে শূন্যের সংখ্যা বা জিডিপি-র বৃদ্ধির হারের উপরে একবগ্গা গুরুত্ব-আরোপ কতখানি যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে উন্নয়ন-চর্চার পণ্ডিতেরা বিস্তর প্রশ্ন তুলে থাকেন— কিন্তু, নেতারা জানেন যে, পাবলিক ও-সব কূট তর্কের পরোয়া করে না। পরশুর পরের দিন ডলারের অঙ্কে ভারতীয় অর্থনীতির ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটবে, জনতা জনাদর্নের জন্য এর চেয়ে বড় সুসংবাদ নেই। তার জন্য জানতে হয় না যে, এক ট্রিলিয়ন মানে একের পাশে বারোটা শূন্য।
এই বাজেটও ট্রিলিয়নময়। এমনিতে এটা পূর্ণাঙ্গ বাজেট নয়, তা পেশ হবে নির্বাচনের পরে নতুন সরকার গঠিত হলে— নির্মলা সীতারামন পেশ করলেন অন্তর্বর্তী বাজেট। তাই এ বছর আর্থিক সমীক্ষার বদলে সরকার ইন্ডিয়ান ইকনমি: আ রিভিউ নামে চুয়াত্তর পাতার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে গত দশ বছরের আর্থনীতিক অগ্রগতির হিসাব দিয়ে বলা হয়েছে, তিন বছরের মধ্যেই পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে দেশের জিডিপি; ২০৩০ সালের মধ্যে পৌঁছতে পারে সাত ট্রিলিয়ন ডলারেও। পাঁচে যদি বা পৌঁছনো যায়, সাতে পৌঁছনোর পথটি কী হবে, তা ওই রিপোর্টেও নেই, অর্থমন্ত্রীর ভাষণেও নেই। কিন্তু, পথের প্রয়োজনই বা কী, মানুষ তো শুধু শুনতে চান যে, ভারত ইতিমধ্যেই জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনটিতে রুমাল পেতে ফেলেছে।
কিন্তু, বাজেট জুড়ে কি কেবলই ট্রিলিয়নের মহিমাকীর্তন? মোটেই না। ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে উন্নত দেশ বানিয়ে তুলতে নরেন্দ্র মোদীর বাতলানো দাওয়াই হল ‘জ্ঞান পর ধ্যান’। ‘জ্ঞান’ কথাটিকে অবশ্য তার চেনা অর্থে ধরলে ভুল হবে— শিক্ষার খাতে ‘ধ্যান’ দেওয়ার কুঅভ্যাস তাঁদের কোনও কালেই নেই। এখানে ‘জ্ঞান’ হল অ্যাক্রোনিম— বড় শব্দবন্ধের আদ্যক্ষর জুড়ে শব্দ তৈরির খেলার ফসল। এই ‘জ্ঞান’ হল জি-ওয়াই-এ-এন। ‘জি’ হল গরিব, ‘ওয়াই’ যুব, ‘এ’ অন্নদাতা আর ‘এন’ নারী। এই চার গোষ্ঠীর উপরে বিশেষ নজর দিলেই নাকি উন্নত দেশ হয়ে ওঠা সওয়া ঘণ্টার পথ। ভারী আশ্চর্যের কথা, এমন চমৎকার শব্দসংক্ষেপখানা দিন তিনেক আগেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় ব্যবহার করলেন, অথচ নির্মলার বাজেট-ভাষণে তা অনুপস্থিত।
তবে, প্রসঙ্গটি বিলক্ষণ আছে। নির্মলা এঁদের কথা আলাদা আলাদা করে উল্লেখ করে পিলে চমকে দিয়ে বললেন, প্রধানমন্ত্রী গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন যে, এই চারটি প্রধান ‘কাস্ট’-এর উন্নতিসাধনে নেমে পড়তে হবে। এই প্রসঙ্গে ‘কাস্ট’ বা জাতি শব্দটির এমন চমকপ্রদ অপপ্রয়োগও প্রধানমন্ত্রীই আগে করেছেন। এ দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা মানবোন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের উপরে তথ্য পাওয়া যায় যে সমস্ত রিপোর্টে, তার যে কোনও একটির পাতা উল্টোলেই দেখা যাবে, সমস্ত সূচকের নিরিখেই গড় হিসাবে পিছিয়ে রয়েছেন অনগ্রসর জাতির মানুষ। জাতিগত বৈষম্যের পাশাপাশি রয়েছে জাতিগত ঘৃণাও। সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে দলিতদের বিরুদ্ধে অপরাধ। বহু বছরের বহু গবেষণাপত্র দেখিয়েছে যে, দরিদ্রদের মধ্যেও সবচেয়ে প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছেন নিম্নবর্ণের মানুষ। কৃষক, মহিলা বা যুবসমাজ যে জাতির নিরিখে এক-একটি অবিমিশ্র গোষ্ঠী নয়, তা কি আলাদা করে বলে দেওয়ার বিষয়? গরিবদের মধ্যে কি বর্ণবিভাজন বা লিঙ্গবৈষম্য নেই? কৃষক বলতেই বা কার কথা বলে হচ্ছে— পঞ্জাবের বিত্তবান উচ্চবর্ণ বহু একর জমির মালিক পুরুষ চাষি, না কি পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্র মহিলা ভাগচাষি? অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাষণে ‘কাস্ট’ শব্দের অপপ্রয়োগ নেহাতই বেখেয়াল-প্রসূত, না কি প্রান্তিকতা সম্পর্কে আমাদের এত দিনের সমস্ত ধারণাকেই গুলিয়ে দেওয়ার সচেতন প্রয়াস, সে প্রশ্ন রয়ে গেল।
এক জন প্রান্তিক মানুষের নানান পরিচিতি থাকতে পারে। দরিদ্রদের মধ্যে যিনি পুরুষ, তাঁর শ্রেণিগত অবস্থান প্রান্তিক হলেও, লিঙ্গপরিচিতির নিরিখে তিনি হয়তো বৈষম্যের শিকার নন। আধুনিক কালের সমাজকর্মী এবং গবেষকেরা মনে করেন যে, ‘মহিলাদের ভাল হবে’ বা ‘কৃষকদের উন্নতি হবে’, এমন কথাও আদতে অর্থহীন। এমনকি, ‘মহিলাদের ভাল হবে’ আর ‘দরিদ্ররা সুখের মুখ দেখবেন’, এই দু’টি বাক্য পর পর বলার মানে এই নয় যে, গরিব মেয়েদের ভাল হবে। কারণ গরিব মেয়েদের সমস্যা গরিবদের সমস্যা আর মেয়েদের সমস্যার যোগফল নয়। সমস্যাগুলি বহুমাত্রিক এবং প্রায়শই একে অন্যকে বাড়িয়ে তোলে। নির্মলার বাজেটভাষ্য ছ’বার ‘ইনক্লুসিভ’ শব্দটি ব্যবহার করলেও অসাম্যের আলোচনার এই সব সূক্ষ্ম বিচারে ঢোকে না।
এই সব বিশ্লেষণাত্মক কাটাছেঁড়ায় না ঢুকে যদি দেখি যে, ওই চারটি ‘কাস্ট’-এর প্রতি সরকার এত দিন কী রকম ভাবে কতখানি দায়িত্ব পালন করেছে, সেই ছবিটিও উজ্জ্বল নয়। যে কোনও সমাজে অসাম্য কমানোটা আসলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন। সেই সদিচ্ছা থাকলে, মোট যত কর আদায় হয়, তাতে প্রত্যক্ষ করের ভাগ বাড়ার কথা। এ দেশে কিন্তু তার উল্টোটাই ঘটছে। কর্পোরেট কর এবং পরোক্ষ করের (গরিব মানুষের উপরে যার বোঝা চাপে সবচেয়ে বেশি) অনুপাত গত দশ বছরে লক্ষণীয় ভাবে কমেছে। নির্মলা ঘোষণা করলেন, গত দশ বছরে দেশের মানুষের গড় প্রকৃত আয় (টাকার অঙ্কে আয়বৃদ্ধির পরিমাণের থেকে মূল্যস্ফীতির ভাগটুকু বাদ দিলে যা পড়ে থাকে) দেড় গুণ বেড়েছে। অক্সফ্যামের একটি রিপোর্ট কিন্তু দেখাচ্ছে যে, ২০১২ থেকে ২০২১-এর মধ্যে দেশে যত সম্পদ তৈরি হয়েছে, তার ৪০ শতাংশের মালিক দেশের ধনীতম এক শতাংশ মানুষ। দরিদ্রতম ৫০ শতাংশের হাতে এসেছে মোট সম্পদের তিন শতাংশ। কর্পোরেট সংস্থাদের ছাড় দিয়ে এক বছরেই সরকার হারিয়েছে এক লক্ষ কোটি টাকা। বিনিয়োগ যে তদনুরূপ ভাবে বেড়েছে, তা-ও কিন্তু নয়। দেখেশুনে মনে হয়, সমাজ হিসাবে অসাম্যই আমাদের চয়ন। শিশুদের অপুষ্টির হারের নিরিখে দরিদ্রতম দেশগুলির তুলনাতেও পিছিয়ে রয়েছে ভারত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রকাশিত হলে সেই রিপোর্টের পদ্ধতিগত ভুল নিয়ে যত কথা তোলে সরকার, তার ছিটেফোঁটাও শোনা গেল না অপুষ্টি কমানোর উদ্যোগ প্রসঙ্গে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির উন্নতির কথা শোনা গেল মাত্র এক বার।
জি ফর গরিব, ওয়াই ফর যুব। যুবসমাজের মঙ্গলের কথা ঢক্কানিনাদ সহকারে ঘোষণা করা হল বটে, কিন্তু বাজেট-ভাষণে বেকারত্বের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উল্লেখমাত্র নেই। বিভিন্ন সমীক্ষা দেখাচ্ছে, দেশে কর্মসংস্থানের ঘাটতি বেড়েই চলেছে। এমনকি সরকারি তথ্য (পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে) অনুযায়ীও ১৫ বছর থেকে ২৯ বছর বয়সিদের ১৭ শতাংশ কর্মহীন। অল্পবয়সি, শিক্ষিত অংশের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। অল্পবয়সিদের মানসিক অসুখও অচিরেই মহামারির আকার ধারণ করতে চলেছে।
কৃষকদের গালভরা নাম দিলেও সাম্প্রতিক অতীতে আমরা দেখেছি, কী ভাবে তাঁদের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ করেছে রাষ্ট্র। সার-সহ অন্যান্য কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যসামগ্রীর খুচরো বাজারে মূল্যস্ফীতি এবং কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ ক্রমশই আরও অলাভজনক হয়ে ওঠায় ‘অন্নদাতা’রা যে খুব সুখে নেই, তা বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৪ থেকে ২০২২-এর মধ্যে কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত এক লক্ষেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেন।
নির্মলা বলেছেন, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের ফলে দেশে নাকি এক কোটি ‘লাখপতি দিদি’ তৈরি হয়েছেন। কত দিনে, কোথায়, কী ভাবে তাঁরা কত লক্ষ টাকা উপার্জন করেছেন, সে সব খতিয়ান অবশ্য তিনি দেননি। উল্টে বলেছেন, সংখ্যাটা দু’তিন গুণ বাড়ানো হবে। পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে-র তথ্য দেখাচ্ছে, সাম্প্রতিক কালে মহিলাদের কর্মসংস্থান বেড়েছে। কিন্তু, এর বেশির ভাগটাই হয়েছে উপার্জনহীন শ্রমে। তার ফলে মেয়েদের বঞ্চনা কমার বদলে বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
শুনছি, এ সরকার নাকি এতই আত্মবিশ্বাসী যে, ভোটের মুখেও করছাড়ের মতো বড় কোনও জনমোহিনী পদক্ষেপ করতে হল না তাকে। পূর্ণ বাজেট নয়, তাই বড়সড় পরিবর্তন আশাও করেনি কেউ। আশঙ্কা ছিল, বাজেটভাষ্য নির্বাচনী ভাষণের রূপ নেবে। তা-ই হল, এবং বিভিন্ন রাজ্যের শেষ কয়েকটি নির্বাচনের ফল স্মরণ করে শঙ্খ ঘোষের দু’টি লাইন মনে পড়ে গেল— “লোকে আমায় ভালই বলে, দিব্যি চলনসই/ দোষের মধ্যে একটু নাকি মিথ্যে কথা কই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy