অনড়: অমৃতসর সংলগ্ন অঞ্চলে কৃষকরা শামিল হয়েছেন ‘রেল রোকো’ আন্দোলনে, ১০ মার্চ। পিটিআই।
সাময়িক বিরতি সত্ত্বেও, ভারতে কৃষক আন্দোলন কিন্তু থেমে যায়নি। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে কৃষকরা অনড়। তাঁরা চাইছেন, আইন করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রের সরকার তাতে রাজি নয়, অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের অনেকে এ বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন। আবার কৃষকদের পক্ষেও সওয়াল করছেন অনেকেই। তাঁদের যুক্তি, দেশের খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে কৃষিকে অপরিহার্য ক্ষেত্র বলে মানতে হবে ও কৃষকের পর্যাপ্ত আয় নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তিনি কৃষিকাজে যুক্ত থাকেন। দেশে যথেষ্ট খাদ্যশস্য উৎপন্ন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কৃষিকাজ থেকে কি চাষি পর্যাপ্ত আয় করছেন? তাঁরা কি কৃষিকাজে যুক্ত থাকছেন? এক কথায় উত্তর— না। ২০১১-র জনগণনাতেই জানা গিয়েছিল, প্রতি দিন দু’হাজার চাষি চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন। তার পরে প্রতিটি নমুনা সমীক্ষায় এই সংখ্যা বেড়েছে। কৃষিতে যুক্ত চোদ্দো কোটি পরিবারের প্রায় সাতাশি ভাগ কৃষি থেকে রোজগার করেন মাসে দশ হাজার টাকার কম।
একমাত্র কৃষিতেই উৎপাদন ও বাজার, দু’টিই প্রতিটি মরসুমে ঝুঁকিপূর্ণ, অথচ কৃষিতে বিমার সুযোগ এসেছে সাত বছর আগে, কিন্তু ভারতের মাত্র দশ ভাগ কৃষক তার সুবিধা পান। ফসল ভাল হলেও কৃষক তাঁর উপযুক্ত দাম পান না। কৃষিপণ্যের বাজার পাইকার ও বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। বাজারকে ন্যায্য করার কোনও উপায় দেখতে পাচ্ছেন না চাষিরা। সার-কীটনাশকে ভর্তুকি, কিংবা চাষিকে অনুদান, সরকারের কোনও সহায়তাই চাষকে লাভজনক করতে পারছে না। তাই চাষি দাবি করছেন, ভারতের প্রধান তেইশটি ফসলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আবশ্যক করে আইন হোক।
আপত্তি উঠবে, ফসলের দাম আগে থেকে নির্ধারিত থাকলে বাজারে চাহিদা-জোগানের যে প্রক্রিয়া চলে, তা বিকৃত হবে। এই যুক্তির সারবত্তা তখনই থাকে যখন বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা, দু’পক্ষই সমান শক্তিশালী। কৃষি বাজারের বাস্তব পরিস্থিতি তা থেকে অনেক দূরে। তা ছাড়া এখানে প্রধান প্রশ্ন ন্যূনতম দাম পাওয়া। শেয়ার বাজারেও ন্যূনতম দামের সুরক্ষা থাকে, তার নীচে চলে গেলে সেই শেয়ারের কেনা-বেচা বন্ধ হয়ে যায়। চাষি কেন প্রায় বিনামূল্যে ফসল বিক্রিতে বাধ্য হবেন?
বাজার ব্যবস্থায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ যে নেই তা নয়, কয়েকটি তো অতি পরিচিত। যেমন, যে কোনও পণ্যের মোড়কে ছাপা ‘এমআরপি’ (ম্যাক্সিমাম রিটেল প্রাইস), যাতে বিক্রেতা নিজের মর্জিমতো জিনিসের দাম বাড়াতে না পারেন। এই ব্যবস্থা ক্রেতাকে সুরক্ষিত করে। আর আছে কিছু পণ্যের দামের উপর সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণ। শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরিও বেঁধে দেয় সরকার। কৃষিপণ্যের দাম ক্রেতার আয়ত্তে রাখতে সরকার নানা ব্যবস্থা করে। যেমন, পেঁয়াজ, বা চাল-গমের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে রফতানি বন্ধ করে। ডাল-সহ কিছু ফসলের দাম বাড়লে তা আমদানি করে। আবার, খোলা বাজারে শস্যের দাম পড়ে গেলে সরকার কিছু শস্য কিনে নেয়, যাতে ফসলের দামে স্থিতাবস্থা আসে।
তবে সরকার কৃষিপণ্যের সামান্যই কেনে— গম কেনে উৎপাদনের কুড়ি ভাগ, ধানের চল্লিশ ভাগ, বাকি একুশটি শস্য কেনে না বললেই চলে। খোলা বাজারে শস্যের দামে স্থিতাবস্থা আনতে সাময়িক সরকারি ক্রয় প্রকল্পের (মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম) বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমেছে, এ বছর বরাদ্দ মাত্র ছ’কোটি টাকা। পাইকার যথেচ্ছ দামে ফসল কেনেন। কৃষির বাজারে সরকারি নিয়ন্ত্রণ খুব আঁটসাঁট নয়। এমনকি সরকারি মান্ডিতেও ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কেনাবেচা হয় না। তাই চাষিদের দাবি, আইন করে এমএসপি সব কেনাবেচার জন্য আবশ্যক করা হোক।
এখন প্রশ্ন, কী কী উপায়ে তেইশটি ফসল ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কেনাবেচা নিশ্চিত করা যায়? এক, সরকার প্রয়োজনমতো কৃষিপণ্যের বাজারে এসে কিছুটা শস্য কিনে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনবে। দুই, সমস্ত মান্ডিতেই কেনাবেচা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে বা তার চেয়ে বেশি দামে হবে, আর তিন, যদি কোনও কারণে কৃষক সহায়ক মূল্য না পান, তা হলে বিক্রির বৈধ ক্যাশ মেমো দেখালে সরকার ঘাটতি পূরণ করে দেবে। এ ছাড়া রেশনে বিতরণের জন্য ধান-গমের সঙ্গে ডাল ও অন্য দানাশস্যও কেনা হবে।
এর কোনওটাই নতুন নয়। শস্যের দামে স্থিতি আনতে সরকারি ক্রয়, বা ‘মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম’ গত চার দশক চালু আছে। মধ্যপ্রদেশ ও হরিয়ানা ‘ঘাটতি-পূরণ’ প্রকল্পও রূপায়ণ করতে চেষ্টা করেছে, যার নাম ‘ভাওয়ান্তর ভুগতান যোজনা’। রেশনে তো সরকার চাল-গম কিনছেই। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করতে কেবল সরকার-অনুমোদিত মান্ডিতে কেনাবেচার ধারণাও নতুন নয়। বেসরকারি ক্রয়ে, যেমন চিনির ক্ষেত্রে— চিনিকলগুলি কেবল পূর্বনির্ধারিত দামেই আখচাষিদের থেকে কিনে থাকে।
তেইশটা ফসল ন্যূনতম দামে কিনতে গেলে সরকার ফতুর হয়ে যাবে, এমন আশঙ্কা করছেন অনেকে। সত্যিই কি তাই? ক্রাইসিল সংস্থা ষোলোটি শস্যকে নিয়ে হিসাব করেছে যে, সরকারকে ‘ঘাটতি-পূরণ’ করতে হলে অতিরিক্ত ২১ হাজার কোটি টাকা খরচা হবে, যা কেন্দ্রীয় বাজেটের মাত্র ০.৫ ভাগ। অবশ্য মান্ডিতে সব শস্যের সবটাই কেনাবেচা হয় না। এই ব্যবস্থা চালু করতে গেলে মান্ডির সংখ্যা দেড়গুণ করতে হবে। সঙ্গে যদি মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিমের বরাদ্দ বাড়াতে হয়, তা হলে হিসাবটা কেন্দ্রীয় বাজেটের ১%-এর একটু বেশি হবে, রাজ্যের বাজেট যোগ দিলে টাকার অঙ্কটা আসলে নগণ্য। এ কথাও উঠছে যে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি হলে পিএম কিসান প্রকল্পের প্রয়োজনটাও কমে যাবে।
তা হলে আপত্তিটা কোথায়? একটা আপত্তি হল, কৃষকেরা চাইছেন মোট খরচার দেড়গুণ। সেটা দিতে গেলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বেড়ে যাবে প্রায় ২৫ ভাগ। তা হলে রেশনে দেওয়ার জন্য সরকারি ক্রয় বাজেট বর্তমানের দু’লক্ষ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হবে আড়াই লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু রেশন ব্যবস্থার জন্য সরকারি ক্রয় তো উপভোক্তাকে সহায়তা দেওয়ার জন্য। তা ছাড়া এই অতিরিক্ত খরচা কি সরকারের সাধ্যাতীত?
প্রশ্নটা আসলে অন্য। কৃষকদের দাবি মেনে যদি আইনি গ্যারান্টি দেওয়া হয়, তা সুনিশ্চিত করতে আরও অনেক কাজ করতে হবে। প্রথমত মান্ডির সংখ্যা দেড়গুণ করতে হবে। মান্ডিগুলির পরিকাঠামো আধুনিক করতে হবে। চাষিরা যাতে মান্ডিতে কোনও চাপ ছাড়াই বিক্রি করতে পারেন, তার জন্য নজরদারি দৃঢ় করতে হবে।
‘ঘাটতি পূরণ’-এর ব্যবস্থায় দুর্নীতির সম্ভাবনা বিস্তর, মধ্যপ্রদেশ দুর্নীতি ঠেকাতে পারেনি বলেই পিছিয়ে এসেছে। সেই দুর্নীতি দমন করতে হবে। মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম তৎপরতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে রূপায়ণ করতে গেলে জেলা ও ব্লক স্তরের কৃষি বিভাগের কর্মক্ষমতা বাড়াতে হবে। কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের মতো একটি বিস্তৃত তথ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy