চলে গেলেন বনরাজ ভাটিয়া (ছবিতে)। ভারতের অন্যতম সেরা কম্পোজ়ার। সেই কবে নন্দনে গোবিন্দ নিহালনির তামস দেখতে গিয়ে ছবির টাইট্ল থিমটি শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম! মুগ্ধ হয়েছিলাম বললে অবশ্য ভুল বলা হবে, বলা উচিত বিদ্ধ হয়েছিলাম। একটা সম্পূর্ণ শূন্যতার মধ্যে থেকে উঠে এল ঈশ্বরের প্রতি কোরাসে একটি বেদনাক্লিষ্ট মানুষ-দলের আর্তচিৎকার: “হায় রব্বা, হায় রব্বা”— হা ঈশ্বর, হা ঈশ্বর— এবং, জেগে উঠল সুর। সারি সারি যাত্রা করা দাঙ্গাবিধ্বস্ত দেশ ভাগ হওয়া মানুষগুলোর মধ্যে থেকেই যেন জন্মাল সেই জাগরণ। সুরের এই উদ্ধত শানিত তরবারি চিরে দিল ভারতীয় নিউ ওয়েভ ছবির অন্তরপট। আঁধারের মধ্যে কালপুরুষে লেগে রইল বনরাজের আলো। সুর দিয়ে অন্তর মন্থনের এই যে একটা সোজাসাপ্টা পথ, সেটা যেন ছায়াবিহীন। মুগ্ধই করে না শুধু, ঝলসেও দেয়।
আমরা তো শুনলাম, কিন্তু বনরাজ ভাটিয়া করলেনটা কী করে? যে বহুস্বর তিনি ব্যবহার করলেন, তা মিউজ়িক্যালি গড়ে তোলা একমাত্র বনরাজের পক্ষেই সম্ভব। তাঁর পক্ষেই সম্ভব সুরে ঝলসে দেওয়া। সেই ঝলকে দেখি, বনরাজ ভেসে চলেছেন সমস্ত পরিযাণে, সমস্ত লাইন জুড়ে পড়ে থাকা রুটিতে, হাওয়াই চপ্পলের ছিঁড়ে যাওয়া স্ট্র্যাপে। দেখতে পাই, সারি সারি ভেঙে পড়া মুখের উদ্দেশে বনরাজ তুলে দিচ্ছেন তাঁর সারেঙ্গির ক্ষুরধার তীব্রতা, তুলে দিচ্ছেন তাঁর ট্রাম্পেটের যুদ্ধনির্ঘোষ। বনরাজ যাত্রা করেন তাদের সঙ্গেই, যারা স্বপ্ন দেখেছিল তাদের বাড়ির সেই ছায়াঘেরা উঠোনের, উঠোনের সেই কতকালের পরিচিত চারপাইয়ের। আমি দেখতে পাই হাজার হাজার কড়া পড়ে যাওয়া পায়ের এগিয়ে আসা, সিরিয়াতে লেবাননে পরিবার হারা মানুষগুলোকে। দেখতে পাই সেই তিন বছরের লাল জামা পরা আয়লান কুর্দিকে, তুরস্কের সমুদ্রপ্রান্তরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ওর চোখের জলের নোনায় মিশে যাচ্ছে মহাসমুদ্রের লবণ।
বনরাজের সুর যেন সেই মহাসমুদ্র।
বনরাজ ভাটিয়া যখন মন্থন-এ সুর দিচ্ছেন, তখন ‘মেরো গাম কথা পরে’ গানটির জন্য বেছে নিলেন গুজরাতের একটি লোকবাদ্যযন্ত্রকে। কচ্ছের লাঙ্গা উপজাতির একটি ছোট্ট বাঁশি: সুন্দরী। বেজে উঠছে রাবণহাত্তা। সেই বাঁশি ও বেহালার ভারতীয় সংস্করণ বেজে উঠল ট্রেনের শিসের ভূমিকার অব্যবহিত পর। ঘনিয়ে উঠল একটা সাব-অল্টার্ন রুক্ষতা। কালো কালো অনাহারে ক্লিষ্ট মানুষগুলোর ছায়ায় আমরা আবৃত হয়ে গেলাম। আহ্, বাঁশির কী অপূর্ব ব্যবহার! ভাষা লাগল না সহমর্মিতার। কতকাল ধরে যেন চিনি আমরা ওই মানুষগুলোকে! শিশুগুলোকে।
এই বনরাজ ভাটিয়াই আবার যখন লিরিল সাবানের বিজ্ঞাপনে সঙ্গীত সাজালেন, তখন তা-ই হয়ে উঠল উদ্দাম ভাবে শহুরে। মোহময়ী।
বনরাজ এমন এক মিউজ়িশিয়ান ছিলেন, যাঁর সুরগুলো কুচি কুচি হয়ে লেগে থাকত ছবির এবং দৃশ্যের আয়োজনে। বা, বৃষ্টি দিনের কাচের মধ্যে থেকে এসে পড়া শেষ সূর্যের মতো হয়ে থাকত মণিমাণিক্য। এক ফোঁটা জল হয়েও যারা মুহূর্তের হিসেবে অমূল্য! যেন একরঙা সূর্য থেকে সাত রঙা রামধনু হয়ে যাওয়া।
অপর্ণা সেনের থার্টি সিক্স চৌরঙ্গি লেন-এর সঙ্গীত আয়োজনে যেন ঘনিয়ে উঠল সেই রাঙা আলোর প্রবাহ। নীল বরফের পেটের মধ্যেকার বিষাদকে রাঙিয়ে দিল চেলো। চেলোর এমন ব্যবহার আর কোনও ছবিতে হয়েছে এমন করে? কোথায় এমন নিস্তব্ধ একটা রাতে হাওয়া আর সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেঙে পড়েছে মরণ? যখন এমন একটা প্রসারিত চেলোয় পিয়ানো কুচিতে ভোর হয় আকাশ, তখন বোঝা যায় যে, এক জন সঙ্গীতকারের ঔজ্জ্বল্য কতখানি আলো এনে ফেলতে পারে দর্শকদের মনে। যেখানে ক্যামেরার চোখ শুধু পার্থিব শরীর গঠন করে, বনরাজ তখন সুরের ছায়ায় যোগ করেন সেই শরীরে মন। ছবি তখন ছবি থাকে না, হয়ে ওঠে একটা অভিজ্ঞতা। জন্মান্তরের স্মৃতি।
বনরাজ জানতেন, কী ভাবে ট্রাম্পেটে মিশিয়ে দিতে হয় পিয়ানোকে। বনরাজ জানতেন, কী ভাবে পিয়ানোর চকমকিতে জ্বালাতে হয় চেলো।
বনরাজ জানতেন...
ভারত এক খোঁজ-এ আবার বনরাজ তৈরি করে ফেলছেন আর এক রকমের ম্যাজিক। বেদ-শ্লোকের ধ্বনি দিয়ে গড়ে তুলছেন একটা প্রিলিউড! তার পর, সেই প্রিলিউডের শরীরে এসে বসাচ্ছেন প্রাণ। যেন সেই প্রাণ শূন্যস্থান থেকে জেগে উঠল। চেলোতে সে কী টান, সেই উর্জায় মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেল পার্কাশন। যেন মেঘ জমল, গুরু গুরু গর্জনে জানিয়ে দিল একটা ঝড়ের কথা। সেই সৃষ্টির আদিমতম মেঘ। জেগে উঠবে এ বারে টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর ধারে একটা সভ্যতা। গড়ে তুলবে তারা দেশ, নগর, নাগরিক ক্লেদ, ক্লেদে বিদ্ধ হওয়া ছোট-বড় মানুষগুলোর কত রকমের ক্যালাইডোস্কোপিক আবেগ। রাগ দুঃখ প্রেম অভিমান বিরহ বিদ্রোহ। কবিতা!
এই অনাগত কালের দ্রষ্টা হিসেবে রয়ে যান বনরাজ, যিনি সৃষ্টির থেকেও আদিম, যিনি আকাশের থেকেও শূন্য। তিনি শূন্য, কারণ তাঁর সঙ্গীতের থেকেই জন্মাবে একটা বোধ। যে বোধ বলবে, ‘সো(অ)হম্’। আমিই সে।
যে সঙ্গীতকার সলিল চৌধুরীর কাছে উচ্চ-প্রশংসিত হন, তাঁর বিষয়ে আলাদা করে খুব বেশি কিছু বলার থাকে না। আমার সঙ্গেও বনরাজের ছিল খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক কি আর আগুনে পোড়ে!
বনরাজ ভাটিয়া, তোমার প্রতি রইল আমার অন্তরের শেষ বিন্দু অবধি ভালবাসা। এই ভালবাসার অমৃত শাশ্বত প্রাণের, সুর মেলানো স্রোতের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকুক। পেরিয়ে যাক নশ্বর মৃত্যুর দিগন্তকে। এ ছাড়া কী আর চাইব বলো তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy