অনিবার্য: ইডি-র উপর আক্রমণের পর এলাকায় চাপা উত্তেজনা, ৫ জানুয়ারি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
একটা সময় ছিল যখন এই রাজ্যে কোনও বড় দুষ্কর্ম হলেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও তাঁর সহকর্মীরা বিহারের উপমা টেনে আনতেন। বিশেষত আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে তো বটেই। এখানে কোনও খুন-জখম-দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিরুদ্ধে বললে তখন বাম শাসকদের একটি তৈরি সাফাই ছিল, বিহারের দিকে তাকিয়ে দেখুন। জ্যোতিবাবু নিজেও কথাটি বহু বার বলেছেন।
হতে পারে, তখন হয়তো বিহারে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা অনেক বেশি ছিল। হয়তো সেখানে যে ধরনের অপরাধ সংগঠিত হত, তার তুলনায় এই রাজ্যে অপরাধের চরিত্র বা মান ছিল কিঞ্চিৎ আলাদা। কিন্তু রাজ্যবাসী বাম-প্রভুদের মুখে ওই সব শুনে হাসত। মনে মনে দুয়ো দিত। আর বিরোধী দল প্রকাশ্যেই বলত, শেষ পর্যন্ত বিহারের তুলনা টেনে পশ্চিমবঙ্গকে সার্টিফিকেট আদায় করতে হবে!
সন্দেশখালির সাম্প্রতিক ঘটনাবলির দিকে তাকিয়ে পুরনো সিপিএম রাজত্বের সেই কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এখানে তৃণমূলের ‘জামা’ পরা শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তে যাওয়া কেন্দ্রীয় দলকে ফেলে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা এবং কর্তব্যরত সংবাদকর্মীদের মেরে, কেড়ে, হুমকি দিয়ে এলাকাছাড়া করার পরে শাসক তৃণমূলের যুক্তি, বিজেপি-শাসিত অনেক রাজ্যেও তদন্তে গেলে এমন ‘আক্রমণ’ হয়। ঘটনাটিকে কেন্দ্রের ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে জনরোষ’ বলেও দাবি করেছে দল। এমনকি, প্রহৃত এক ইডি আধিকারিকের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের খাতায় হিসাব-বহির্ভূত সম্পত্তির পুরনো অভিযোগ আছে বলে তৃণমূল বিবৃতি দিয়েছে। ভাবখানা যেন, ওই অভিযোগের কারণে এই গণপিটুনি তাঁর ‘ন্যায্য পাওনা’!
যাঁর বাড়িতে তদন্তকারীদের ঢুকতে না দেওয়ার জন্য এত তাণ্ডব, সেই শেখ শাহজাহান কত বড় মহাত্মা, তা জানি না। তবে এটা বিলক্ষণ বোঝা যাচ্ছে, তিনি এলাকার ‘ডন’। তাঁর বাহিনী আইনের ঊর্ধ্বে! থানা, পুলিশ ইত্যাদি তাঁর দাসানুদাস। এই শেখসাহেব শুধু উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা পরিষদের ওজনদার সদস্যই নন, তিনি বিবিধ আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে অধুনা জেলবন্দি ‘মন্ত্রী’ জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের বিশ্বস্ত শাগরেদ এবং তাঁর নিজের বিরুদ্ধেও অভিযোগ কম নেই বলে খবর।
সহজেই অনুমান করা যায়, কোনও এলাকায় দলের একাধিপত্য কায়েম রাখতে এবং ভোটের মাঠে ‘খেলা’ দেখাতে এই শাহজাহানরা জমানা বুঝে যে কোনও দলের মুকুটে ‘কোহিনুর’ হতে পারেন। বেশি ‘সুবিধাজনক’ অবশ্যই শাসকের ছত্রছায়া। স্বার্থ এ ক্ষেত্রে উভয়েরই। উপরন্তু পার্টির উপরতলার অনেকের সঙ্গে এই শ্রেণির লোকেদের মোটা অঙ্কের দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কও থাকে। সব মিলিয়ে এঁদের আড়াল করতে চাওয়ার মধ্যে তাই নানা বাধ্যবাধকতা কাজ করে। এই ভাবেই গড়বেতার তপন-সুকুর, শাসনের মজিদ মাস্টার প্রমুখ ছিলেন শাসক সিপিএমের ‘সম্পদ’। তিহাড়ে বন্দি বীরভূমের কেষ্ট মণ্ডল আজও তৃণমূলের চোখে ‘বীর’!
জানতে ইচ্ছে করে, দলনির্বিশেষে ক্ষমতাধরেরা সাধারণ মানুষকে ঠিক কতটা নির্বোধ ভাবেন? যিনি যে দলেই থাকুন, তাঁরা কি মনে করেন, ‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি’ বললেই জগতের চোখে হাত চাপা দেওয়া যায়? কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির অভিযোগ নিশ্চয়ই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। বিজেপি-বিরোধী রাজ্যগুলিতে তদন্তের গতিপ্রকৃতি যতটা আগ্রাসী, সমতুল অভিযোগে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে তা হয় না। বরং পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে বহু বিজেপি নেতা এমন অভিযোগে ‘পার’ পেয়ে যাচ্ছেন, যা অন্যদের বেলায় শাস্তিযোগ্য হয়। সব ঠিক। কিন্তু তার দ্বারা শাহজাহান-কেলেঙ্কারির মতো ঘটনার অভিঘাত কি মুছে যেতে পারে? যা হয়েছে, তা গর্হিত।
এক বার সন্দেশখালির দিকে ফিরে তাকানো যাক। সরেজমিন রিপোর্ট বলছে, সাতসকালে তিনটি গাড়িতে ইডি-র আধিকারিকেরা শাহজাহানের বাড়িতে পৌঁছন। সঙ্গে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী। বাড়ি ভিতর থেকে বন্ধ। ডাকলে কোনও সাড়া মিলছে না। খানিক ক্ষণ ডাকাডাকির পরে তালা ভাঙার চেষ্টা হতেই পিলপিল করে কয়েকশো লোক ছুটে এসে তদন্তকারীদের ঘিরে ধরে বাঁশ, লাঠি, লোহার রড, হকি স্টিক দিয়ে মারতে শুরু করে। সেখানে মহিলারাও ছিলেন। ইডি-র এক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার-সহ দু’জনের মাথা ফাটে। আরও দু’জন গণপ্রহারে আহত।
পাশাপাশি চলল মিডিয়া-পেটানো। ফোটোগ্রাফারের ক্যামেরা কেড়ে ছবি নষ্ট করা হল। অর্থাৎ, মাস্টারমশাই কিছুই দেখলেন না! সাংবাদিকদের তাড়িয়ে এলাকাছাড়া করার সময় হুমকি এল, “এখানে আর এক মিনিটও দাঁড়াবেন না।” দাদা-বাহিনীর আরও ‘নির্দেশ’ শোনা গেল, “বাইরে থেকে কেউ এসে দাদার বাড়ির দিকে গেলেই ফের অ্যাকশন।” অন্য দিকে, দিনভর কলকাতায় বসে তৃণমূলের নেতারা ‘জনরোষ’-এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে লাগলেন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা স্থানীয় পুলিশকে জানিয়ে যাননি বলেই এমন হল।
ঘটনার পরেই কিন্তু শাহজাহান তাঁর পরিবারবর্গ ও দলবল সমেত ‘ফেরার’ হয়ে যেতে পারলেন। পুলিশ দিনের পর দিন তাঁকে ‘ধরতে’ পারে না! তবে তাঁর প্রচারিত ভিডিয়ো-বাণী সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।
বিষয়গুলি পর পর সাজালে কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কী বলতে পারেন? শাহজাহান অতি সুবোধ, সজ্জন, নির্দোষ, শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক? তিনি সর্বদা আইনের অনুশাসনে আস্থাবান? এই প্রশ্ন তাঁদের কাছেও রাখতে চাই, যাঁরা গোটা বিষয়টিকে নিছক ‘জনরোষ’ বলে চালাতে মরিয়া। তাঁদের বিবেক কী বলছে? আজ এটা অন্য কোনও দলের বেলায় ঘটলে এই যুক্তি তাঁরা মানতে পারতেন কি?
প্রশ্ন আরও। শাহজাহান ‘নির্দোষ’ হলে অপরাধীর মতো আড়াল খুঁজতে গেলেন কেন? বাড়ির দরজা খুলে দিলে তাঁর কাছে কি তবে সত্যিই ‘সন্দেহজনক’ কিছু মিলত? যিনি নির্দোষ, তাঁর তো অকুতোভয় হওয়ার কথা! রক্তক্ষয়ী হামলা বাধিয়ে এবং ফেরার হয়ে ‘মান্যবর’ তৃণমূল নেতা শাহজাহান নিজের ‘স্বচ্ছ’ ভাবমূর্তির কী প্রমাণ রাখলেন?
তা ছাড়া, নির্দিষ্ট এলাকায় সাতসকালে লাঠি-রড নিয়ে শত শত লোক ‘নামা’-তে হলে তার আগাম প্রস্তুতি প্রয়োজন এবং যুক্তি বলে, সেটা অবশ্যই ছিল। শুধু এলাকার ‘নিরপেক্ষ’ পুলিশ বোঝাতে চাইছে, তাদের কাছে কিছুরই কোনও ‘খবর ছিল না’! এই পুলিশের কাছে এমনটাই হয়তো প্রত্যাশিত। সন্দেশখালির ঠিক পরেই বনগাঁয় প্রাক্তন পুরপ্রধানের বাড়িতে অভিযানের খবর অবশ্য সেখানকার পুলিশ জানত। আর সেখানেও গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে।
পরিতাপের বিষয়, রাজনীতি এবং রাজধর্মের মাঝখানে ভেদরেখাটি রোজ ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতান্ধতার এটাই স্বাভাবিক ও অনিবার্য পরিণতি। কী বা রাজ্য, কী বা কেন্দ্র— কেউ এই ব্যাপারে কারও চেয়ে কম যায় না। এটা গোটা দেশেরই ছবি। বিলকিস বানোর ধর্ষকেরাও তো বিজেপির রাজ্যে ভোটের আগে যাবজ্জীবন জেল থেকে ‘মুক্তি’ পায়! সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি তা খারিজ করার সময় বলেছে, “গুজরাত সরকার দোষীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।” এই রাজ্যে সে দিনও বিজেপির হাতে মার খেতে দেখা গিয়েছে পুলিশকে। কলঙ্কের কালি কোথায় কম! কিন্তু এক জনকে ‘অধম’ বলতে হলে অন্য জনের তো নিজেকে ‘উত্তম’ প্রতিপন্ন করতে হয়। সেটাই বা হচ্ছে কই!
এই রাজ্যের সন্দেশখালি আপাতত তারই একটি হাতে-গরম উদাহরণ মাত্র। মূল সমস্যাটিকে চিহ্নিত করার চেয়ে জনরোষ, সাম্প্রদায়িক উস্কানি, আক্রান্ত ইডি অফিসারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ
ইত্যাদি প্রচারই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। এটাই ঘোর চিন্তার বিষয়।
রাজনীতি হয়, হোক। কিন্তু রাজধর্মে শিথিলতার স্থান নেই। কেন্দ্র, রাজ্য সব শাসকের ক্ষেত্রেই এটা সমভাবে প্রযোজ্য। রাজনীতির ঘেরাটোপে আইনের শাসনকে নস্যাৎ করে উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া কার্যকলাপ প্রশ্রয় পেতে থাকলে তার পরিণাম ভয়ঙ্কর ও ব্যাপক হতে বাধ্য। বিপাক তখন প্রশ্রয়দাতাদেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy