যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ফাইল চিত্র।
উৎসব নয়, উচ্চশিক্ষায় শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে দেশে প্রথম রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এ রাজ্যের অন্যতম শতাব্দী প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সঙ্কট এখন চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। এই প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান এবং সাহিত্যচর্চার উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ স্বীকৃতি পেয়ে চলেছে ধারাবাহিক ভাবে। ফলে, এই মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনটনে আক্রান্ত হওয়ার দুঃসংবাদ শুধু যাদবপুরের নয়, তা গোটা রাজ্যের শিক্ষা পরিচালনায় অশনি সঙ্কেত।
ইতিমধ্যে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনীদের কাছে অর্থ-সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। তবে প্রাক্তনীদের থেকে সংগৃহীত অনুদান প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী পরিকাঠামো গড়ায় কিংবা বৃত্তি চালু করার মূলধন হিসাবে বিবেচিত হলেও, সেটি নিত্যদিন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার প্রত্যাশিত আয়ের সূত্র হতে পারে না। অপ্রতুল সরকারি বরাদ্দের সঙ্কট কেবল যাদবপুর-কেন্দ্রিক নয়, বরং রাজ্যের কমবেশি সার্বিক সঙ্কটেরই সাধারণ চিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মূলত রাজ্য সরকারের আর্থিক অনুদান-নির্ভর। সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মী-আধিকারিকদের বেতন-ভাতা, পেনশনের খরচের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় চক-ডাস্টার থেকে শুরু করে জল, কল, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট— এমন দৈনন্দিন খরচের সিংহভাগ বহন করে রাজ্যের সরকারই। সরকারের এমন ব্যয়ভার বহন কোনও ভাবেই সরকারি বদান্যতার অংশ নয়। বরং, সেটি নিতান্তই সংবিধান নির্দেশিত পথে সরকারের সামাজিক দায়বদ্ধতা। যাদবপুরের আজকের জগৎজোড়া স্বীকৃতির মূলে রয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠন এবং গবেষণার মান। আর, এমন গুণমান বজায় রাখতে বিশেষ প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো নির্মাণ এবং তার মানোন্নয়ন। বিশেষত, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি পাঠের পরিকাঠামোর নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ যথেষ্ট ব্যয়বহুল। গবেষণার মানের নিরন্তর উন্নতি না ঘটাতে পারলে, প্রতিষ্ঠানের মান ধরে রাখা কার্যত অসম্ভব। আর, প্রতিষ্ঠানের মানের অবনমন ঘটলে ভাল ছাত্র, ভাল শিক্ষক কিংবা গবেষক মেলা ভার। তখন চক্রাকারে প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের পথে যাওয়াটাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
এক দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, লাইব্রেরি, এবং এ সবের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়। প্রতিষ্ঠানের বয়সের ভার, পাঠ্যক্রম এবং পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক কারণেই বেতন বহির্ভূত ব্যয় বাড়ে, অথচ সরকারি বরাদ্দ কমতে থাকে। দুই দশক আগে এই ব্যয় বরাদ্দের ফর্মুলা নিয়ে গঠিত এক উচ্চ পর্যায়ের রাজ্য সরকারি কমিটির সুপারিশ ছিল, প্রতি বছর নিদেনপক্ষে দশ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধির। কিন্তু এখন বৃদ্ধি দূরস্থান, বরাদ্দ কমে চলেছে সেই হারে। রাজ্যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওবিসি সংরক্ষণের লক্ষ্যে এক ধাক্কায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়ার আসন সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল বিপুল হারে। প্রতিশ্রুতি ছিল, এই বৃদ্ধির ধাক্কা সামলাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাড়তি বরাদ্দ করা হবে প্রতি বছর। কিন্তু গত আট বছরে সে গুড়েও বালি।
পাশাপাশি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের দায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপরেও বর্তায়। সেই দায় পালনে দেশের সরকার ব্যর্থ। সম্প্রতি দেশের নতুন শিক্ষা নীতি প্রকাশ হয়েছে, কিন্তু মনে রাখতে হবে দেশের শিক্ষাখাতে কখনও জাতীয় আয়ের ছয় শতাংশ বরাদ্দ হয়নি। দেশের উচ্চশিক্ষার মোট বাজেট বরাদ্দের পঞ্চাশ ভাগ খরচ হয় আইআইটি, আইআইএম, আইসার-এর মতো শ’খানেক প্রতিষ্ঠানে, যেখানে দেশের মাত্র তিন শতাংশ পড়ুয়া ভর্তি হয়। বাকি দেশ জুড়ে থাকা হাজার হাজার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ৯৭ শতাংশ পড়ুয়াদের জন্য বরাদ্দ বাকি পঞ্চাশ শতাংশ।
কেন্দ্রের বর্তমান সরকারের আমলে পরিকল্পনা কমিশন তুলে দিয়ে ‘নীতি আয়োগ’ চালু করার সবচেয়ে বড় মাসুল গুনেছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের কেন্দ্রীয় বরাদ্দ বঞ্চনায়। প্রতিটি পরিকল্পনার মেয়াদকালে পাঁচ বছর জুড়ে কেন্দ্রীয় অনুদানের যে টাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পেত, তা কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় অনুদানের এই অর্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিকাঠামো, স্কলারশিপ, ফেলোশিপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা-মূলক প্রকল্পে ব্যবহার হত। কেন্দ্রের নিয়মিত অর্থ বরাদ্দের পথ বন্ধ হওয়ার পর ‘রুসা’র মতো এককালীন মেয়াদি প্রকল্পের অনুদান সাময়িক চালু করে কোভিডের মাঝ পর্বে আচমকা বন্ধ করা হল। ফলে, বিপুল সংখ্যার পড়ুয়া-গবেষক নতুন করে অর্থ-সঙ্কটের বলি হলেন। এমনকি, সারা দেশে যাদবপুরের মতো দশটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বিশেষ ‘উৎকর্ষ কেন্দ্র’ হিসেবে নির্বাচিত করার পরও সেগুলির বাড়তি অনুদান জোটেনি। দুর্ভাগ্য, এমন তালিকায় এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেই উৎকর্ষ কেন্দ্রের মর্যাদা পেল, যেটি তখনও ভূমিষ্ঠই হয়নি!
এই প্রেক্ষিতে নতুন করে উঠে আসছে যাদবপুরের মতো প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের ফি বৃদ্ধির বিষয়। কোনও সন্দেহ নেই যে, দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের গড় টিউশন থেকে হস্টেল কিংবা পরীক্ষার ফি অনেকটাই কম এই প্রতিষ্ঠানে। ফলে, এমন বিসদৃশ ফি কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন, তা অস্বীকার করা যায় না। সরকারি ভর্তুকির প্রয়োজন কেবলমাত্র সমাজের প্রান্তিক মেধাবী পড়ুয়াদের শিক্ষার জন্য। কখনওই সেটা সম্পন্ন পরিবারের পড়ুয়াদের তেলা মাথায় তেল ঢালার লক্ষ্যে নয়। কিন্তু পড়ুয়া কিংবা অভিভাবকদের উপর শিক্ষার দায় চাপানোর আগে অনেক বেশি দায়বদ্ধতার নজির গড়তে হবে দেশ কিংবা রাজ্য সরকারের। অন্যথায়, দায়সারা ঢঙে সরকারি বরাদ্দ সরকারি প্রতিষ্ঠানের পিছিয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করবে। বিপদ সেখানেই।
কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy