লোকসভায় যখন তাঁর তৃতীয় বাজেট পেশ করছেন নির্মলা সীতারামন, সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি জানাচ্ছে, দেশে বেকারত্বের হার প্রায় ৬.৫ শতাংশের ধারেকাছে ঘোরাফেরা করছে। গত মাসের শেষেই সরকারি হিসেব মতে অন্তত এক কোটি কুড়ি লক্ষ লোক, যাঁরা পূর্ণমাত্রায় কর্মক্ষম, কাজ হারিয়েছেন। এর বিপ্রতীপে দেশের প্রথম পঞ্চাশটি সংস্থার সম্পদের বহর বেড়েছে ৩ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি।
অসংগঠিত ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত লকডাউন এবং অতিমারি তছনছ করে দিয়েছে জীবন ও জীবিকা। জনতার সামূহিক স্মৃতিশক্তি সচরাচর দুর্বল হয়। ফলে এই গল্পটি বিশ্বাস করানো খুবই সহজ যে, অর্থনীতির বেহাল অবস্থার জন্য অতিমারিই কেবল দায়ী। যেন, যত কাণ্ড ওই করোনাতেই। কিন্তু দেশের অর্থব্যবস্থাকে যাঁরা নিয়মিত নজরদারিতে রাখেন, তাঁরা সবাই জানেন যে, গলদ ছিল গোড়াতেই।
২০১৯-এর ৩০ মে দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন নরেন্দ্র মোদী। এর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই প্রকাশ করা হয় জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার চেপে রাখা তথ্যপঞ্জি। সরকারি ভাবেই সে দিন স্বীকার করা হয়, সাড়ে চার দশকের ইতিহাসে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ সীমা (৬.১ শতাংশ) ছুঁয়েছে। এর সাড়ে ছয় মাস পর ২০১৯-এর নভেম্বরের মাঝামাঝি জানা গেল, ১৯৭৩ সালের পর প্রথম বারের মতো দেশে মানুষজনের মোট উপভোগের বহর কমে গিয়েছে।
অর্থনীতির ছাত্র মাত্রই জানেন যে, যাঁর আয় যত কম, তাঁর আয়ের তত বেশি অংশ যায় দৈনন্দিনের খরচাপাতি মেটাতে। অর্থাৎ, সাধারণ ভোগ্যপণ্যের প্রধান ক্রেতা কিন্তু তাঁরাই, যাঁদের হাতে আয় খুব কম। আমাদের জাতীয় নীতি-নিঘাটয়মের ইচ্ছাকৃত ভ্রান্তির জন্য বেশ ক’বছর ধরেই অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলতর শ্রেণি এবং নিম্নবিত্তদের রোজগার ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে। যাঁরা খরচাপাতি করেন বলেই অর্থনীতির চাকা গড়ায়, তাঁদের আধুলিতেই যদি টান পড়ে তা হলে জিডিপি-ই বা বাড়বে কী ভাবে?
সরকার এবং এর মতাদর্শে বিশ্বাসী অর্থশাস্ত্রীরা মনে করেন যে, যেন তেন প্রকারেণ জিডিপি বাড়াতে পারলে, বা বাড়ছে এমন বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু এই জিডিপি-র অঙ্কেও যে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। জিডিপি-র বৃদ্ধির হার মাপা হয় বছরওয়াড়ি হিসেবে। এক বছর যদি বেশি খারাপ হয়, তা হলে পরের বছর ঈষৎ বাড়লেই বৃদ্ধির হারে উল্লম্ফন মনে হবে। যেমন বলা হচ্ছে, চলতি বছর জিডিপি-র আকার ৭.৭ শতাংশ কমে গেলেও কুছ পরোয়া নেই। আগামী বছরই তা বাড়বে ১১ শতাংশ হারে। কোভিড-জয়ী ‘পরাক্রান্ত’ অর্থনীতির লক্ষ্যপথ হচ্ছে ইংরেজি বর্ণমালার ‘ভি’ অক্ষরটির মতো। আর কে না জানে, ভি থেকে ভিক্টরি! তা এই বিজয়ের উতরোলের মধ্যে কে আর আঁক কষে দেখছে যে, গত বছরের ১০০ যখন নীচে নেমে এসে ৯২.৩-এ দাঁড়ায়, সেখান থেকে ১১ শতাংশ বৃদ্ধি হলেও আগামী বছরের শেষে ওই সংখ্যা পৌঁছবে ১০২.৪৫-এ। অর্থাৎ, ২০১৯-২০’র তুলনায় ২০২১-২২’এ নেট বৃদ্ধির হার হবে একুনে ২.৪৫ শতাংশ।
তার মানে, এই বিকাশের গল্পটিও দাঁড়াচ্ছে না। অথচ, বাজেটের যাবতীয় সংখ্যা তো নির্ভর করছে এর উপরেই। পুরো বাজেটেই রয়েছে নানা ফাঁক এবং ফাঁকি। আগামী বছরের জন্য প্রস্তাবিত মোট ব্যয়বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ৩৪ লক্ষ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। গত বার এই অঙ্কটি ছিল ৩০ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি। অর্থাৎ, বৃদ্ধির হার ১৪.৫ শতাংশের কাছাকাছি। এতে মূলধনী খাতে বরাদ্দ বেড়েছে দেড় লক্ষ কোটি টাকার মতো। এই অঙ্কটি আমাদের জাতীয় আয়ের এক শতাংশেরও কম। অর্থাৎ, দীর্ঘমেয়াদি বা নিদেনপক্ষে, মাঝারি মেয়াদেও অর্থনীতিতে উৎপাদনক্ষমতা তৈরি করার কোনও স্পষ্ট অভিপ্রায় নর্থ ব্লক থেকে উঁকি দিল না।
ভয়ঙ্কর বেকারত্ব, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও দারিদ্রের প্রেক্ষাপটে উচিত ছিল সম্পদ বিতরণের ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের বাস্তুতন্ত্র নির্মাণ করা। গ্রাম এবং শহরে নিশ্চিত রোজগারের ক্ষেত্র ও প্রকল্প তৈরি করা। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ নিযুক্তি নিশ্চয়তা প্রকল্পে কাজ পাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন ৫৩ শতাংশ অতিরিক্ত দেশবাসী। গত মে মাসে এই প্রকল্পে নির্মলা নিজেই ৪০ হাজার কোটি টাকার বাড়তি সংস্থান করেছিলেন। সব মিলিয়ে করোনাকালে এক কোটি কুড়ি লক্ষ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য মনরেগা-র দ্বারস্থ হয়েছিলেন। প্রয়োজন ছিল সমজাতীয় একটি প্রকল্প শহরাঞ্চলের জন্য বাজেটে প্রস্তাব করা হবে। কারণ কর্মহীনতার ধাক্কাটা সজোরে পড়েছে নগর এলাকাতেই।
রাজকোষ ঘাটতি তো বছর শেষ হওয়ার আগেই গত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। প্রস্তাবিত রাজকোষ ঘাটতিও ৬.৮ শতাংশ রাখা হয়েছে। তাতে দোষের কিছুই নেই। কিন্তু অতিরিক্ত সম্পদ আহরণে জনগণের সম্পদ বেচে ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকার প্রস্তাব ছাড়া উদ্ভাবনী কোনও পদক্ষেপ নজরে এল না।
এক দিকে যখন ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন, অন্য দিকে তীব্রতর হচ্ছে সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য, তখন অনায়াসে এ বছরটির জন্য অতি-ধনীদের থেকে বাড়তি আয়কর সংগ্রহ করাই যেত।
প্রচারমাধ্যমে যে গগনচুম্বী প্রত্যাশা প্রত্যক্ষ করলাম, তার বিপরীতে এক ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিটের বাজেট বক্তৃতার পরে মহাকবিকেই মনে পড়ছে। ‘মাচ আডো অ্যাবাউট নাথিং’ আর কাকে বলে।
অর্থনীতি বিভাগ, কাছাড় কলেজ, শিলচর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy