বিশেষত ‘শিক্ষিত’ লোকেদের, ‘নারীবাদী’ মেয়েদের আদিখ্যেতা দেখে তাঁরা যারপরনাই বীতশ্রদ্ধ! ফাইল ছবি।
শাহরুখ খানের বক্স-অফিস জয়ী পঠান (ছবিতে একটি দৃশ্য) নিয়ে দর্শকদের আদেখলেপনায় অনেকেই খুব বিরক্ত। বিশেষত ‘শিক্ষিত’ লোকেদের, ‘নারীবাদী’ মেয়েদের আদিখ্যেতা দেখে তাঁরা যারপরনাই বীতশ্রদ্ধ! যদি ভারতের এক নারীবাদীর চোখ দিয়ে দেখা যায়, তা হলে কি ছবিটা উতরোবে? ধরা যাক ডিম্পল কাপাডিয়া অভিনীত চরিত্রটিকে, যিনি দেশের গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত এক প্রাক্তন আধিকারিক। তিনি জন্মদিনের কেক-এ মোমবাতি জ্বালতে বলে বাড়ির পথে বেরোন, কিন্তু আটকে যান অফিসের তথা দেশের কাজে। সহকর্মী মেয়েটি নিমেষে পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে বলে, “আপনার কেক-এর পিস ফ্রিজে রেখে দিতে বলব তো?” অর্থাৎ এমনটাই দস্তুর। যেমন হয় উচ্চপদস্থ পুরুষদের ক্ষেত্রে, তেমনই মেয়েদেরও। ছবিতে এ নিয়ে একটা কথাও বাড়তি বলা হয় না।
ছবির শেষে নায়ক তার বীরত্বের মেডেল এই ম্যাডামের ছবির সামনে রেখে বলে, তিনিই এর যোগ্য অধিকারী, যদিও তিনি প্রাণ দিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, ল্যাবরেটরিতে। নিজের জীবনের বিনিময়ে নিরাপদ করে গেলেন দেশের মানুষের জীবন। পৌরুষের পেশি প্রদর্শন, উন্মত্ত প্রতিহিংসা থেকে দেশভক্তির ধারণাকে সরিয়ে এনে তাকে নিয়মিত কাজের পরিসরে প্রতিষ্ঠা করল ছবিটি। সেই নিষ্ঠাবলয়ে মেয়েদের অন্তর্ভুক্তি সহজ, স্বাভাবিক।
দীপিকা পাড়ুকোনের যৌনতা-উদ্দীপক একটি নাচ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ছবিতে তাঁর পাকিস্তানি এজেন্টের চরিত্রটি যেমন বুদ্ধিমান, তেমনই প্রখর। কাজের স্বার্থে সে প্রেমিককে ধোঁকা দেয়, কিন্তু ছবিতে মেয়েটিকে ‘চরিত্রহীন’ বলে দাগানোর কোনও চেষ্টা থাকে না। নায়ক এবং খলনায়কের যৌন-আবেদন যে নায়িকার চেয়ে কিছুমাত্র কম প্রদর্শিত হয়নি, সেটাও ভোলা চলে না। নায়িকাই বাঁচায় শাহরুখের চরিত্রটিকে, এবং মেয়েটির লড়াই দেখে একটুও অবাক না-হয়ে তারিফ করে পঠান, যেন সেটাই স্বাভাবিক! আবার সে মেয়ে নিজের বিবেকের ডাক শোনার মতো স্বাধীনচেতাও বটে— উচ্চতর আধিকারিক যখন শত্রু দেশে গণহত্যার নির্দেশ দেয়, সে তা মানে না। শরীর, মন এবং বোধের উপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বরং ‘মাচো’ হিরো নিয়ে কিঞ্চিৎ রসিকতা আছে ছবিতে—‘পঠান’ আর ‘টাইগার’, দুই সুপারহিরোর গায়ে-গতরে ব্যথা হয়, হলে পেনকিলার খেতে হয়, জেনে আশ্বস্ত হওয়া গেল।
সক্ষমতা বা সমন্বয়ের বার্তা সারা দেশের কাছে পৌঁছনোর একটা মস্ত বাহন বলিউডের ছবি। আশির দশকে অমর আকবর অ্যান্টনি-র মতো ছবি ছিল সংবিধানের ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’-এর সহজ পাঠ। পঠান দেখতে যাওয়ার পথে অটো চালক সোৎসাহে জানালেন, তিনিও টিকিট কেটে রেখেছেন। এক অধ্যাপক বন্ধু জানালেন, তাঁর মেয়ে এবং বাড়ির পরিচারিকাকে নিয়ে ছবিটি দেখতে যাবেন সপ্তাহান্তে! এ ভাবে পাশাপাশি বসে, সমস্বরে চেঁচিয়ে, নেচে যে ভারতীয়ত্বের উদ্যাপন, তাকে এড়িয়ে গেলে এর পিছনের বড় আখ্যান আমাদের অধরাই থেকে যাবে।
পর্দায় যখন শাহরুখ ‘পঠান’ খান আসে, অথবা সংক্ষিপ্ত আবির্ভাব হয় সলমন ‘টাইগার’ খানের, তখন মুহূর্তে ফেটে-পড়া উন্মাদনা কি শুধুই ভক্তকুলের আকুলতা? না কি বিগত কয়েক বছর যে ঘৃণার চাষ চলেছে ভারতীয় রাজনৈতিক-সামাজিক পরিসরে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ? সর্বহারার প্রতিনিধিত্ব করছে যে ‘অনাথ’ হিরো, তার সাফল্যে তো বরাবরই একাত্ম বোধ করেছে হিন্দি ‘অ্যাকশন’ ছবির দর্শক! ক্ষমতার রাজনীতি চিরকাল একই। কিন্তু কী খাব, কী পরব, কী দেখব, কাকে ভালবাসব, কাকে বন্ধু বলব, কাকে শত্রু— সব কিছুই ঠিক করে দেবে কিছু উদ্ধত, দাম্ভিক লোক, এই দাবি আমাদের মানসিক ভাবে, রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা করে ফেলছিল। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেই চাপ আরও বেশি। ‘লাভ জেহাদ’-এর ধারণা, দলিত-জনজাতি মেয়েদের নির্যাতনকারীদের প্রতি রাষ্ট্রের পরোক্ষ মদত বস্তুত মেয়েদের স্বাধীন সত্তা আরও খণ্ডিত করেছে। একটা অহিংস প্রতিবাদ করতে আমরা অনেকেই কি মুখিয়ে ছিলাম না?
পঠান বলল, ঘৃণার মোকাবিলা কেমন করে করতে হয়, তা আমরাই ঠিক করব। “মুকাবিলা ক্যায়সে হাম করতে হ্যায় ইয়ার/ আব কি বার/ তরিকা হাম বাতায়েঙ্গে” গানটি শুধু তার সুর-ছন্দে মাতায়নি। কথাগুলিও লক্ষ করার মতো— ভালবাসার নেশা চড়ে গেলে শত্রুও গলা জড়িয়ে ধরবে ভালবেসে! এখানেই জিতে গিয়েছে ‘দিলওয়ালে দিওয়ানা’। যে আখ্যানে নারীর স্বাধীনতা স্বাভাবিক, তা আবার ফিরে এসেছে বলিউডে। হিন্দি বাণিজ্যিক ছবিতে ‘ভারত জোড়ো’ বার্তা এনেছে। নায়ক পিতৃপরিচয়হীন, কিন্তু শিকড়হীন নয়— গোটা দেশে তার শিকড় ছড়িয়ে। আফগানিস্তানের এক ছোট গ্রামের যে নিরপরাধ মানুষদের সে রক্ষা করে, সেখানেও এক পরিবারও সে খুঁজে পায়, যেখানে এক মা তাকে ভালবেসে ‘পঠান’ বলে অভিহিত করেন। এই সহজ মানবিকতার কথাই তো বলে ভারতীয় সংবিধান, ভারতীয় সংস্কৃতি। ক্রমে ভুলতে-বসা, ভুলিয়ে দিতে-থাকা সেই সত্যকে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী অবধি পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির বিকল্প এখনও কিছু নেই। সদ্যোজাত ‘পঠান’-কে সিনেমা হলের সামনেই কেউ রেখে গিয়েছিল, অনাথ আশ্রমের সামনে নয়, এতে আর আশ্চর্য কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy