—প্রতীকী ছবি।
বিহার বিধানসভায় পাশ হল ‘বিহার রিজ়ার্ভেশন অ্যামেন্ডমেন্ট বিল’— অনগ্রসর শ্রেণি (ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস বা বিসি), অতি অনগ্রসর শ্রেণি (এক্সট্রিমলি ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস বা ইবিসি), তফসিলি জাতি ও জনজাতির জন্য সংরক্ষিত আসনের অনুপাত ৫০% থেকে বেড়ে ৬৫% হল।
এ ছাড়াও রয়েছে আর্থিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণির (ইকনমিক্যালি উইকার সেকশন বা ইডব্লিউএস) জন্য ১০% সংরক্ষণ। এই সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে ‘বিহার কাস্ট-বেসড সার্ভে ২০২২’-এর ফলাফল— গান্ধীজয়ন্তীর দিন প্রকাশিত এই সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় যে, বিহারের ১৩.১ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ইবিসি-র অনুপাত ৩৬% এবং বিসি ২৭.১%।
এই সিদ্ধান্তে স্বভাবতই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে— রাজনৈতিক ভাবে তো বটেই, আইনগত দিক থেকেও। বিহারের জনসংখ্যার বণ্টন থেকে স্পষ্ট যে, কোনও রাজনৈতিক দলই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সাহস দেখাবে না। বস্তুত, বিজেপি নিজেদের সংরক্ষণপন্থী হিসাবে দেখাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে— ২০১৯ সালে ১০৩তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তারাই যে ইডব্লিউএস সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল, এ কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে বারংবার। কিন্তু, দেশ জুড়ে এমন জাতিভিত্তিক সমীক্ষা বা জনগণনার কথা উঠলেই তারা পিছপা হয়, আপাতভাবে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার ফলে।
সংরক্ষণ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়ে যে আইনগত বিতর্ক উঠছে, তা-ও সমান তীব্র। বিলটির বিরোধীরা ইন্দ্র সাহনি বনাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র মামলার কথা (যা মণ্ডল কমিশন মামলা নামে সুপরিচিত) উত্থাপন করছেন। ১৯৯২ সালের সেই মামলায় রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নয় সদস্যের বেঞ্চ জানিয়েছিল: “সংরক্ষণ যে-হেতু একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার বা ‘অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন’-এর একটি চরম রূপ, তাই এটিকে অর্ধেকের কম আসনেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। যদিও সংবিধান কোনও নির্দিষ্ট সীমারেখা ধার্য করেনি, কিন্তু যে-হেতু সাংবিধানিক দর্শন আনুপাতিক সমতার বিরোধী, তাই সমতার ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে কোনও গোত্রের সংরক্ষণই ৫০ শতাংশের সীমা অতিক্রম করবে না।” কিন্তু এই একই রায়ে ‘৫০ শতাংশের সীমা’-র একটি ব্যতিক্রমের কথাও উল্লিখিত আছে— যখন সরকার ‘চূড়ান্ত সতর্কতা বজায় রাখে’ এবং ‘একটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রের কথা প্রতিষ্ঠা করতে পারে’, তখন এই ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা উল্লঙ্ঘন করা যেতে পারে। বস্তুত, এই ব্যতিক্রমটি কেন প্রয়োজন, তা ব্যাখ্যা করে সুপ্রিম কোর্ট ভারতের বিপুল বৈচিত্রের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এবং জানায় যে, “এমন হতেই পারে যে, ভারতের কোনও সুদূর ও প্রত্যন্ত প্রান্তের নাগরিকদের, জাতীয় জীবনের মূলস্রোত থেকে দূরে থাকার কারণে, এবং তাঁদের বিশেষ অবস্থার কারণে, পৃথক ভাবে দেখা উচিত, এবং এই কঠোর আইনে খানিক শিথিলতা রাখা উচিত।” এই উদ্ধৃতিটিকে এমন ব্যাখ্যা হতে পারে যে, শুধুমাত্র উত্তর-পূর্ব ভারতের মতো প্রত্যন্ত এলাকার ক্ষেত্রেই এই ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা উল্লঙ্ঘন করা যায়। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই উদ্ধৃতিটিতে কেবলমাত্র একটি ধারণা তুলে ধরা হয়েছে— তা কোনও মতেই এই প্রশ্নটির চূড়ান্ত বিচার নয়। তবে, এ কথাও সত্য যে, গুজরাত, ওড়িশা, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এবং ছত্তীসগঢ়ের মতো রাজ্য এই ঊর্ধ্বসীমার বেশি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে চাইলেও সুপ্রিম কোর্ট তা নাকচ করে দিয়েছে।
পঞ্চাশ শতাংশ ঊর্ধ্বসীমার ক্ষেত্রে আরও নীতিনিষ্ঠ যুক্তি পেশ করে ২০০৬ সালের এম নাগরাজ বনাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সাত সদস্যের বেঞ্চ— জানায় যে, সরকারি চাকরিতে তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত কর্মীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের জন্য প্রকৃত পশ্চাৎপদতার প্রমাণ পেশ করা, প্রশাসনিক কুশলতা রক্ষা করা এবং পরিসংখ্যান পেশ করা জরুরি। যদিও নাগরাজ মামলার পরিপ্রেক্ষিত বিহারের বর্তমান ঘটনাক্রমের চেয়ে আলাদা, কিন্তু এই প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সাত সদস্যের বেঞ্চের একটি পর্যবেক্ষণকে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়: “এ কথা স্পষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে যে, রাজ্যের যদি অতি জরুরি কারণও থাকে... তবুও রাজ্যকে দেখতে হবে যে, সংরক্ষণের ব্যবস্থা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়, অর্থাৎ তা যেন ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম না করে, ‘ক্রিমি লেয়ার’-কে বিপন্ন না করে, বা অনন্ত কাল সংরক্ষণ চালিয়ে না যায়।”
যদিও ইডব্লিউএস সংরক্ষণ সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ৩:২ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এই সংবিধান সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করেছে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে আর্থিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে, এবং তাতে ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা লঙ্ঘিত হয়েছে। একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বিচারপতি মাহেশ্বরী বলেন, “এই আদালতের কোনও রায়কেই এমন ভাবে ব্যাখ্যা করা চলবে না, যাতে মনে হয় যে, কোনও একটি জনগোষ্ঠী বা শ্রেণির জন্য আরও একটি সংরক্ষণের মাধ্যমে ‘অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন’ প্রয়োজন, দেশের সংসদ এ কথা মনে করলেও তার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে না।” কিন্তু এ ক্ষেত্রেও খেয়াল রাখা দরকার যে, ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা উল্লঙ্ঘনের যে যুক্তি বিচারপতি মাহেশ্বরী দিয়েছেন, তাকে তাঁর রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ করতে হবে। তাঁর মত হল, ৫০% ঊর্ধ্বসীমাটি কেবলমাত্র তফসিলি জাতি, জনজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর জাতির সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; আর্থিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ১০% শতাংশ সংরক্ষণ এই সীমার বহির্ভূত এবং অতিরিক্ত।
উল্লিখিত উদাহরণগুলি থেকে স্পষ্ট যে, খুব সুনির্দিষ্ট ব্যতিক্রম বাদে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এখনও ঊর্ধ্বসীমা ৫০ শতাংশই। কিন্তু, ইন্দ্র সাহনি মামলাকে কেন্দ্র করে যে নীতিগত প্রশ্নটি অনিবার্য হয়ে ওঠে, উপরের উদাহরণগুলি থেকে তার সদুত্তর মেলে না। সুপ্রিম কোর্টকে বারে বারেই একটি দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে হয়েছে— সংরক্ষণ ও অন্যান্য অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন কি ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত সমতা ও বৈষম্যহীনতার নীতির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হিসাবে গণ্য? প্রথম দিকে সুপ্রিম কোর্ট এই প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দিত। বস্তুত, সংরক্ষণ আসলে একটি ব্যতিক্রম, এই ধারণা থেকেই ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমার উৎপত্তি। পরবর্তী কালে সংরক্ষণ সংক্রান্ত যাবতীয় মামলায় সেই ঊর্ধ্বসীমাই বিচারের একটি মূল ভিত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। যদিও, ১৯৭৫ সালে কেরল রাজ্য বনাম এন এম টমাস মামলায় সুপ্রিম কোর্ট একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেছিল— সংরক্ষণ সমতার নীতির ব্যতিক্রম নয়, বরং চার বিচারপতির সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বলা হয়েছিল যে, এটি ভারতের সমতার নীতির ‘একটি প্রবল পুনর্বয়ান’।
ফলে, স্বভাবতই ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমাকে অলঙ্ঘ্য বলে বিবেচনা করার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, এবং অনগ্রসরতার ভিত্তি হিসাবে
গোষ্ঠীগত বঞ্চনাই বিবেচিত হবে। ইন্দ্র সাহনি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জাতিগত বঞ্চনাকে সংরক্ষণের ভিত্তি হিসাবে বজায় রাখে বটে, কিন্তু সাধারণ নিয়ম হিসাবে পঞ্চাশ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমার নীতিটি ফিরিয়ে আনে।
তা হলে, বিহারের নতুন সংরক্ষণ নীতির প্রশ্নটি কোথায় দাঁড়াল? সে রাজ্যের জাতিসমীক্ষা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের একাংশ যে পদ্ধতিগত তর্ক তুলেছেন, আপাতত সে প্রসঙ্গে ঢুকছি না। আইনগত দৃষ্টিতে প্রথম প্রশ্নটি উঠবে, বিহার কি ‘প্রত্যন্ত অঞ্চল’ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে? এই রাজ্যের মানুষরা কি ‘দেশের জনজীবনের মূলস্রোতের বাইরে’ আছেন? রাজ্যের প্রকট আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতার কথা মাথায় রেখেও এই দু’টি প্রশ্নের উত্তরেই ‘না’ বলতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন যে, রাজ্যের এই আইন আদালতে গেলে বিহার সরকার ইডব্লিউএস মামলার রায়ের উল্লেখ করে জিততে পারে। যুক্তিটি দাঁড়াবে না— অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপদ শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের কারণটি বিচারপতি মাহেশ্বরীর রায়েই স্পষ্ট।
কিন্তু, যে প্রশ্নটি থেকেই যাবে, তা হল— সংরক্ষণ যদি সত্যিই ভারতের সমতার নীতির ‘একটি প্রবল পুনর্বয়ান’ হয়ে থাকে, তা হলে এই ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমার যৌক্তিকতা কী? মহারাষ্ট্র হোক বা মেঘালয়, অনগ্রসরতা সর্বত্রই আছে। কাজেই, সমতার স্বার্থেই নতুন করে ভাবা দরকার যে, সংরক্ষণের কোনও ঊর্ধ্বসীমা থাকার আদৌ কি প্রয়োজন আছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy