উন্মুক্তপক্ষ: সহজ পাঠ-এর ছবি
সেই আবার এসে পড়ল একটি নতুন বছরের প্রথম দিন। প্রত্যেক বারই যখন নতুন বছরের নতুন দিনটির সামনে দাঁড়াই তখন দু’টি জিনিস মনে পড়ে। এই নতুন দিনটি আসার মানে আমি, যে এই লেখাটি লিখছে এখন, সে আরও একটু পুরনো হয়ে গেল। শুধু কি বয়সের দিক থেকে? না, চিন্তার একটি বিশেষ ধরনের দিক থেকেও। কারণ যে কোনও নতুনের সামনে এসে একটি কবিজীবন মনে পড়ে আমার— তাতেই বুঝি, হ্যাঁ, আমি পুরনোই হচ্ছি। কবিজীবন? কার? রবীন্দ্রনাথের।
এ কথা সত্য বলে অনুভব করেছি অনেক কবিতাচর্চাকারীদের সঙ্গে মিলেমিশে, কথা বলে যে, গত বাহান্ন বছর ধরে যাঁরা কবিতা লিখতে এসেছেন তাঁদের মধ্যে বড়জোর তিন-চার শতাংশের মনে রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে ধারাবাহিক ভাবে পড়বার কোনও আগ্রহ জন্মেছিল। আর বাংলা কবিতা এখন এতই সম্পদশালী, তার ঐতিহ্য এতই সামর্থ্যবান যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা একেবারে না পড়লেও কোনও কবিতালেখকের পক্ষে চমৎকার লিপিকুশলতা দ্বারা মুদ্রণযোগ্য নির্ভুল কবিতারচনা ও কাব্যপুস্তক ছাপিয়ে খ্যাতিলাভ: মোটেই অসম্ভব নয়।
তা হলে আমার রবীন্দ্রনাথের কবিজীবন মনে পড়ে কেন? এই স্বল্প পরিসরে দু’-তিনটে কারণমাত্র নির্দেশ করি। ধরা যাক, ‘সোনার তরী’ নামক কবিতা যে লেখা যায়— সে কথা কি রবীন্দ্রনাথের আগে কেউ ভাবতে পেরেছিলেন? এ কবিতার অন্তর্বস্তু এতই বহুস্তরীয় যে, এ রচনা প্রকাশমাত্র রবীন্দ্রনাথকে আক্রান্ত হতে হয় দুর্বোধ্যতার অপবাদে, সে কথা অনেক দিন ধরেই সবার জানা। আমাদের প্রথম যৌবনে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় একটি ধারাবাহিক রচনা প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘জ্যোতির্ময় রবি ও কালো মেঘের দল’। সে রচনা ও তার লেখক সুজিতকুমার সেনগুপ্ত আজ সম্পূর্ণ বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে গিয়েছেন। কিন্তু আমি, প্রথম ওই রচনাটির মাধ্যমেই জেনেছিলাম ‘সোনার তরী’ বিষয়ে কতখানি দলবদ্ধ ভাবে আক্রমণ ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের উপর। এ রকম গান তখন লেখা হয়েছিল: “আমি লিখছি যেসব কাব্য মানবজাতির জন্যে/ নিজেই বুঝি না তারই মানে বুঝবে কি তা অন্যে”... রেডিয়োর রম্যগীতি অনুষ্ঠানে সে গান নিয়মিত বাজত ষাটের দশকে। এই গান যে রবীন্দ্রনাথকেই ছুরিকাবিদ্ধ করছে সে কথা জানলাম পরে। বাবার মুখে প্রথম শুনেছি ‘সোনার তরী’। বাবার মৃত্যুর পর “যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী” লাইনটি থেকে আমার মনে হত এ নিশ্চয়ই এক শোকের কবিতা। কেননা কবিতা কী করে পড়তে হয় তা তখনও শিখিনি, এখনও জানি না। শুধু অভিজ্ঞতা দিয়ে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখি। অসম্পূর্ণ সেই দেখা। তবে বিস্ময়ে আকুল হই এই ভেবে যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামক রচনাগুচ্ছে এক তরুণ কবি কী ভাবে নতুন ভাষার উদ্ভাবন ঘটালেন বাংলায়। তারই পাশে ভাবি এই একই তরুণের হাতে আসছে মানসী-র মতো কবিতার বই, যে বই সম্পর্কে ছন্দ ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে কাব্যের মহারথীরা স্বীকার করে গিয়েছেন: “এক তুমুল বিপ্লব-ই ঘটালেন রবীন্দ্রনাথ।” এই একই কবির হাতে আমরা পাচ্ছি গীতাঞ্জলি। সেই কাব্য বিশ্বজয় করেছে। পরবর্তী সময়ে নোবেল পুরস্কার পাবেন এমন অন্তত দু’জন শব্দশিল্পী স্পেনের হিমেনেথ এবং ফ্রান্সের আঁদ্রে জিদ অনুবাদ করেছেন সেই গীতাঞ্জলি। একই কর্মস্থলে পাশাপাশি বসতাম বলে ফরাসিভাষাবিদ চিন্ময় গুহের উত্তেজনাময় কণ্ঠে শুনেছি সেই বিবরণ যে কী ভাবে সাঁ জঁ প্যার্স, তখনও কবি হিসেবে তরুণ, সং অফারিংস হাতে ছুটে যাচ্ছেন আঁদ্রে জিদের কাছে এই অনুরোধ নিয়ে যে: “এ কাব্য আপনার হাতে অনূদিত হওয়া প্রয়োজন। কেননা এমন কোনও স্বর নেই আমাদের পাশ্চাত্য কবিতায়।” এই সূত্রে বলা দরকার, সাঁ জঁ প্যার্স-ও নোবেল পুরস্কার পাবেন ১৯৬০ সালে।
অথচ সারা পৃথিবীর অনেক সর্বমান্য কবি-সাহিত্যিক যে গীতাঞ্জলি নিয়ে উদ্বেল, এ কথা জেনেও সেখানেই তৃপ্ত হলেন না রবীন্দ্রনাথ। এল বলাকা। বলাকা-র মতো কোনও কাব্য কি আগে বাংলায় ছিল? শুধু আঙ্গিকের চাক্ষুষ ভাঙা-গড়া নয়, তার বিষয়ের নতুনত্বেও, ছিল? “মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা/ লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা”— কোনও কবি এমন আশ্চর্য নতুন চিন্তার প্রয়োগ তখন আনতে পেরেছিলেন কবিতায়?
এই রবীন্দ্রনাথের হাতেই এক দিকে আমরা পাচ্ছি ‘লেখন’-এর মতো সংহত ছোট কবিতার নতুনত্ব, অন্য দিকে একই কবি আবার রাখছেন কথা ও কাহিনী বইয়ের ভিতর কাহিনিমূলক কাব্যের নিদর্শন। লিপিকা-র পাশে আসছে পূরবী। পূরবী আর একটা বাঁক। লিপিকা-কে অবশ্য কাব্যগ্রন্থ বলে কেউ-কেউ স্বীকার করেন না। মৈত্রেয়ী দেবীকে একান্ত কথোপকথনে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ: “লিপিকা গদ্যকবিতাই।” ১৯৩২ থেকে ১৯৩৬-এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ চলে আসবেন সম্পূর্ণ গদ্যকবিতার পরীক্ষায়। চারটি কাব্যগ্রন্থে তার প্রমাণ রাখবেন।
আজকের দিনে গদ্যকবিতা লেখাটা কোনও আশ্চর্য বিষয় নয়। গদ্যে অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ, সুনীল, উৎপল, শক্তি থেকে ভাস্কর অনেকেই অত্যাশ্চর্য কবিতা উপহার দিয়েছেন পাঠককে। নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ তো এক প্রবল গতিময় ও চিরস্থায়ী গদ্যকবিতাই।
সাতাত্তর বছর বয়সে বড় এক অসুস্থতার পর লিখলেন প্রান্তিক। প্রত্যেকটি কবিতা সংহত ঘনত্বে বাঁধা। গদ্যকবিতার বিস্তারের পর চলে এলেন আবার আত্মসংবরণের লিখন-প্রক্রিয়ায়। তার পরেও এল তাঁর শেষ চারটি কবিতার বই রোগশয্যায়, আরোগ্য, জন্মদিনে ও শেষ লেখা। তত দিনে রবীন্দ্রনাথ, নিজেকে এত বার নতুন করে তোলার পরেও গদ্যকবিতা সম্পর্কে শুনেছেন: ওগুলি ‘গবিতা’। অথচ তিনি যদি প্রথম গদ্যকবিতা লেখার পথ খনন করে না যেতেন, তা হলে পরবর্তী সময়ে বাংলা গদ্যকবিতা এত ঐশ্বর্যময় রূপ নিয়ে দেখা দিত?
সে কথা আজকে আর কেউ ভাবে না। আমি পুরনো হয়ে গিয়েছি বলে ভাবি। ভাবি শেষ বয়সের পথে হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্পর্কে লিখছেন: “আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন”। লিখছেন: “দুঃখের দিনে লেখনীকে বলি লজ্জা দিও না।” অন্য দিকে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ জন, তাঁর একান্তসচিব, যিনি নিজেও কবি, তিনি কী বলে মাঝে মাঝে খোঁচাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথকে? রবীন্দ্রনাথ শুনছেন তাঁর স্নেহভাজন সচিবের মুখে: পার্ল এস বাক বা ন্যুট হামসুন-এর মতো উপন্যাস আমরা কেন পাচ্ছি না আপনার হাতে? ‘গিফট অব দ্য ম্যাজাই’-এর মতো গল্প আপনি লিখছেন না কেন? রবীন্দ্রনাথ চুপ করে থাকছেন। মনে করিয়ে দিচ্ছেন না, রক্তকরবী বা ডাকঘর তোমরা কেউ লিখছ না কেন? ছিন্নপত্র, গল্পগুচ্ছ? কবিতায় বিদেশের কারও তুলনা টানার সাহস পাচ্ছেন না বলে অনুজ সেই সচিব তাঁকে উত্ত্যক্ত করছেন পাশ্চাত্য গল্প-উপন্যাসের দৃষ্টান্ত টেনে আর রবীন্দ্রনাথেরই সঙ্গে ভ্রমণ করছেন এ দেশ ও দেশ। ইনি নিশ্চয়ই দেখেছিলেন আশিতে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথের হাতেই আসবে ‘ল্যাবরেটরি’।
শেষ চারটি কবিতার বইয়ে রবীন্দ্রনাথ যে চলে আসছেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দের একেবারে নতুন একটি রাস্তায়— যে গমন-পথে তাঁর বার্ধক্য, রোগজীর্ণতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সর্বনাশা আরম্ভ সে কথা বোঝার জন্য তাঁর মৃত্যুর পরেও অপেক্ষা করতে হবে অন্তত একচল্লিশ বছর যত দিন না নির্মাণ আর সৃষ্টি বইটি প্রকাশ করবে বিশ্বভারতী— এই গ্রন্থের লেখক কে? তা সকলেই জানেন।
মৃত্যুশয্যায় শুয়েও মুখে-মুখে বলে যাওয়া জীবনের শেষ তিনটি কবিতায় সংশোধন চালিয়ে যাচ্ছেন আত্মসন্দেহদীর্ণ রবীন্দ্রনাথ। অথচ যে অবিসংবাদী কবিত্বচিহ্ন ওই তিনটি কবিতায় জ্বলন্ত, তা যখন আবারও পড়ি আজ— তখন বুঝি নিজেকে বার বার নতুন করে নেওয়া এই কবি এখনও আমার পুরনো হয়ে যাওয়াকে নবীন করে তুলছেন, তুলছেন-ই— প্রত্যেক বছরের প্রথম দিনেই। প্রথম দিনের সূর্য? হ্যাঁ, আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ-ই। কারণ মন তৈরির রেওয়াজ দরকার এবং রবীন্দ্র-কবিতার পাঠ-গ্রহণেই আমার কাছে তা সম্ভব। সঙ্গীতশিল্পী নিয়মিত রেওয়াজ বসেন যাতে রাগ থেকে ভ্রষ্ট না হন গাইবার সময়। সুরচ্যুত না হন। এমন অনেক রাগ আছে যাতে বিশেষ-বিশেষ স্বর লাগে না। মালকোষ যেমন পঞ্চম-বর্জিত। খামাজের আরোহণে রেখাব লাগে না। এ রকম অনেক পাওয়া যায়। কিন্তু এমন কোনও রাগ কি আছে যেখানে ‘সা’ বর্জিত-স্বর? রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে সেই ‘সা’। এই ‘সা’ যেন আমার জীবনকে ছেড়ে না যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy