প্রতিপক্ষ? ভীমরাও রামজি আম্বেডকর। মুম্বই, ১৯৪৬। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
সবচেয়ে স্বাভাবিক ছিল দু’পক্ষের মধ্যে মিত্রতা ও ঐক্য— একটি সাধারণ মঞ্চের নির্মাণ। অথচ, যত দিন গেছে, দু’পক্ষের নেতাদের মধ্যে শত্রুতা ও অবিশ্বাস বেড়েছে। দু’পক্ষই যাঁদের নেতা, তাঁরা হচ্ছেন ভারতের সবচেয়ে নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষ। এদের একটি পক্ষ প্রধানত কমিউনিস্ট নামের দলগুলি, যাদের ঘোষিত পথনির্দেশিকা হল মার্ক্সবাদ; আর দ্বিতীয় পক্ষটি হল বিভিন্ন দলিত নেতৃগোষ্ঠী, যাদের ঘোষিত দিকদর্শন হল আম্বেডকরবাদ। অবশ্য ঘোষণা এক জিনিস, আর অনুশীলন অন্য ব্যাপার। যেমন, মার্ক্স ১৮৫৩ সালেই জাতিব্যবস্থাকে ভারতের প্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করেছিলেন— তাঁর ভারতীয় অনুগামীরা ১৯৫৩ সালে এসেও মনে করলেন, আর্থনীতিক ভিত্তি বদলে গেলেই জাতিবিভাজনের মতো উপরিকাঠামোও ভেঙে পড়বে।
বিশ্বাস বিষম বস্তু, মিত্রকে শত্রু করে তুলতে এর জুড়ি নেই। এই বিশ্বাস থেকেই সম্ভবত ভারতীয় মার্ক্সবাদীরা ১৯৩০-এর দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে বি আর আম্বেডকর নামক একাধারে মহাপণ্ডিত এবং দক্ষ সংগঠকের উত্থানকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলেন। তাঁকে করে তোলা হল শত্রুপক্ষের চর! আম্বেডকরের পক্ষ থেকেও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে— ভারতীয় কমিউনিস্টদের সম্পর্কে অশ্রদ্ধা প্রকাশে তিনিও কার্পণ্য করেননি। আম্বেডকরের সঙ্গে কমিউনিস্টদের দ্বন্দ্বের কুফল সে দিনের তুলনায় আজ অনেক বেশি বিষময়। যে আম্বেডকর এক দিন হিন্দু সামাজিক শৃঙ্খলা, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি ও রাজনীতিকেই মনে করেছিলেন ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু, তাঁরই নাম মুখে নিয়ে আজ বিভিন্ন দলিত নেতা ভারতের সবচেয়ে হিংস্র, উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন। আম্বেডকর হিন্দু সামাজিক শৃঙ্খলার বৈশিষ্ট্য হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন ‘অতিমানবের পূজন’কে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি তিনি কতখানি ঠিক ছিলেন— কিন্তু আবার গভীর আক্ষেপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছি, কী ভাবে আম্বেডকরের নামাবলি পরে দলিত নেতারা সেই ভারতীয় ‘অতিমানবের পূজন’-এ মাতোয়ারা! অন্য দিকে, ১৯৩০-এর দশক থেকে কমিউনিস্টরা ভারতীয় শ্রমজীবীদের প্রতিনিধিত্ব অর্জনে যে সাফল্য পেয়েছিলেন, তার যৎসামান্যই অবশিষ্ট। ভারতীয় শ্রমজীবী মানেই জাতিগত ও পরিচিতিগত ভাবে নিপীড়িত। তাই দলিত ও শ্রমজীবীর আন্তঃপরিচয় অভিন্ন। অথচ, নেতৃত্বের বৈরিতা ভারতীয় সেই শ্রমজীবীকে এতটাই বিভাজিত ও দুর্বল করে তুলেছে যে, শাসক পক্ষের কাজটা হয়ে উঠেছে অনেক সহজ। ভারতীয় শ্রমজীবীর বাস্তবতাটিকে তুলে ধরতে চাওয়া এবং তাঁদের মধ্যে ঐক্যের কথা বলা লোকেদের জেলে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই কাজ শেষ, বাকিটা করে দেবে স্বাভাবিক মিত্রদের মধ্যেকার অ-স্বাভাবিক বিভাজন।
কেবল ভারতীয় শ্রমজীবীদের জাতি-শ্রেণিগত উৎসের কারণেই এই বিভাজন অ-স্বাভাবিক নয়। এটা আরও বেশি অ-স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে আরও এক কারণে: কমিউনিস্ট আদর্শ সম্পর্কে আম্বেডকরের বৈরভাবের নিদর্শন পাওয়া যায় না। যেমন, আনন্দ তেলতুম্বডের গবেষণা থেকে জানতে পারি, কমিউনিস্ট নীতি-আদর্শের কোনও কোনও দিক নিয়ে তিনি সন্দিহান ছিলেন বটে, কিন্তু মূলগত ভাবে তিনি কমিউনিস্ট আদর্শ বিষয়ে খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন (দলিত আন্দোলনকে মার্ক্সবাদী-আম্বেডকরবাদী পথে পরিচালিত করার তাত্ত্বিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ভারত-রাষ্ট্রের রোষে পড়ে জেল যেতে হয়েছে তেলতুম্বডে-সহ অনেককে)। মার্ক্সবাদ সম্পর্কে তিনি একটিও কু-বাক্য প্রয়োগ করেননি। শুধু তা-ই নয়, যে বুদ্ধকে তিনি তাঁর চিন্তার দিশারি বলে মনে করতেন, কার্ল মার্ক্সকেও তিনি সেই বুদ্ধ’র পাশে বসিয়েছিলেন। কারণ, তিনি মনে করতেন দু’জনের গন্তব্য ছিল একটাই— মানবমুক্তি। স্তালিন সম্পর্কেও আম্বেডকর শ্রদ্ধাবান ছিলেন।
কমিউনিজ়ম বিষয়ে তাঁর আগ্রহ এতটাই বেশি ছিল যে, তিনি ইন্ডিয়া অ্যান্ড কমিউনিজ়ম নামে একটা বই লেখার পরিকল্পনা করেন। কিছু কাল আগে আনন্দ তেলতুম্বডের একটি দীর্ঘ ও পরিশ্রমী গবেষণা-প্রসূত ভূমিকা-সহ এই অসম্পূর্ণ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। পাণ্ডুলিপি লেখার কাজে তিনি সামান্যমাত্র এগিয়েছিলেন। তিন ভাগে পরিকল্পিত এই বইয়ের প্রথম ভাগের আলোচ্য ছিল কমিউনিজ়ম প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত, দ্বিতীয় ভাগের বিষয় ছিল ভারতে কমিউনিজ়ম প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত, এবং শেষ ভাগের জন্য নির্ধারিত ছিল ভবিষ্যৎ কর্তব্য ব্যাপারে। তিনি কাজ শুরু করেছিলেন দ্বিতীয় ভাগের আলোচনার মধ্য দিয়ে, এর একটি মাত্র অধ্যায় তিনি রচনা করে যেতে পারেন। এ-অধ্যায়ের বিষয় হিন্দু সামাজিক শৃঙ্খলা। তাঁর প্রতীতি জন্মেছিল যে, ভারতীয় সমাজের এই বাস্তবতাকে অনুধাবন না করে এখানকার মানুষদের মুক্তির সংগ্রাম সংগঠিত করা সম্ভব নয়। অপর দিকে তিনি বিশ্বাস করতেন জাতি হচ্ছে আসলে ‘আবদ্ধ শ্রেণি’। জাতি বিভাজনকে তিনি কেবল পরিচিতিগত সমস্যা বলে মনে করতেন না। বরং, একে উৎপাদন-ব্যবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেন (যেটা বর্তমানে প্রথাগত দলিত নেতারা দেখতে চান না)। তৎকালীন কমিউনিস্ট, বিশেষত বম্বে-কেন্দ্রিক কমিউনিস্টদের সঙ্গে তাঁর তফাত হল, তিনি জাতি-ব্যবস্থার বিনাশ ব্যতিরেকে আর্থনীতিক শোষণের বিনাশের কোনও সম্ভাবনাই দেখতে পাননি।
তা সত্ত্বেও ১৯৩০-এর দশকে কমিউনিস্টদের সঙ্গে মিলে কাজ করতে তাঁর দ্বিধা হয়নি। ১৯৩৮ সালে তাঁর ইন্ডিয়ান লেবার পার্টি কংগ্রেস সোশালিস্ট পার্টি-র সঙ্গে মিলে যে বিখ্যাত কিসান অভিযানে যোগ দেয় তাতে কমিউনিস্টরাও ছিলেন, অবশ্য তাঁরা তখন প্রকাশ্যে কাজ করতে পারছিলেন না। একই বছরে ইন্ডিয়ান লেবার পার্টি কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি-র সঙ্গে যৌথ ভাবে এক লক্ষ শ্রমিকের ধর্মঘট আয়োজন করে। তাঁর কর্মজীবনে আম্বেডকর বারংবার যে ব্যাপারগুলো তুলে ধরেছেন, তার বেশির ভাগই কমিউনিস্টদের দাবির সঙ্গে খুবই মেলে— শ্রমিকের ধর্মঘট করার অধিকার, সর্বজনীন শিক্ষার অধিকার, প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় কমানো, গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গেই আম্বেডকরের অবস্থান কমিউনিস্টদের চেয়ে আলাদা তো নয়ই, কোথাও কোথাও উজ্জ্বলতর। দুর্ভাগ্য, তৎকালীন কমিউনিস্টদের মধ্যে কেউ কেউ আম্বেডকরের নেতা হিসাবে উঠে আসাটাকে মেনে নিতে পারেননি— স্বাভাবিক এক মিত্রকে শত্রুতে পরিণত করার দায়টা বহুলাংশে তৎকালীন কমিউনিস্টদের উপরে বর্তায়। আম্বেডকরের নাম নিয়ে কতিপয় দলিত নেতা নিজেদের আখের গোছানোর জন্য দলিত স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সামগ্রিক অস্তিত্বকেও বিপন্ন করে তোলার ভাগীদার হয়ে উঠতে পেরেছে, তার দায়ও কমিউনিস্ট নেতৃত্বের ইতিহাসকে স্বীকার করতে হবে।
সেই স্বীকৃতির সবচেয়ে ভাল উপায়— আমাদের সামনে যে ঘোর বর্তমানকে নামিয়ে আনা হয়েছে, যেখানে সংবিধানের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন, সেই বর্তমানের মোকাবিলা করার জন্য ভারতীয় শ্রমজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করা। এক ‘অতি-মানবিক’ নেতার শাসনাধীনে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিবাদের বিষাক্ত রাজনীতির সঙ্গে জন্মজাত পুঁজিবাদী পথে দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের যে রাজনীতি ভারতে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করে বসছে, তার বিরুদ্ধে ব্যাপক মানুষের সংহতি গড়ে তোলা। ইতিহাস দেখিয়েছে, কেবল একতরফা আর্থিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, অথবা একান্ত ভাবে জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধতার মধ্য দিয়ে মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। আর্থিক দিকটার পাশাপাশি সামাজিক নিপীড়নেরও প্রাণপণ বিরুদ্ধতা করতে হবে। সৌভাগ্যের কথা, সাম্প্রতিক ভারতে, অগ্রণী বিদ্যাজীবীদের চিন্তাভাবনায়, বিশেষত ছাত্রগোষ্ঠীগুলোতে, এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কথাটা জোরালো ভাবে উঠে আসছে। পেরিয়ার-ফুলে-আম্বেডকর’এর পাশাপাশি ভগৎ সিংহের চিন্তা ও কাজ নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। আবার মার্ক্সের রচনাবলি থেকেও নতুন প্রক্রিয়াতে নতুন চিন্তার প্রবাহ তুলে আনার চেষ্টা হচ্ছে। শাসকদের কাছে কমিউনিস্ট চিন্তায় আম্বেডকরের আগমন, বা আম্বেডকরবাদীদের চিন্তায় কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার অতি বিপজ্জনক একটি লক্ষণ। কমিউনিস্ট-আম্বেডকর সংহতিবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি যে রাজনৈতিক ভাবে সুস্পষ্ট, সেটা সবচেয়ে ভাল ভাবে প্রমাণিত হচ্ছে তাঁদের উপর নেমে আসা আক্রমণের মধ্যে দিয়ে। গণতান্ত্রিক ভারতের জন্য, এই মুহূর্তে এই প্রমাণের চেয়ে বড় শিক্ষা আর কিছু নেই।
(ঋণ: বি আর আম্বেডকর: ইন্ডিয়া অ্যান্ড কমিউনিজ়ম, ভূমিকা: আনন্দ তেলতুম্বডে, লেফটওয়ার্ড)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy