—প্রতীকী ছবি।
রাজনীতিতে মেয়েদের উত্থান কঠিন। পৃথিবীর বহু দেশেই নেতা হিসাবে মহিলাদের গ্রহণযোগ্যতা এখনও কম। দলের মতাদর্শগত অবস্থান যা-ই হোক, তার অন্দরে গুরুত্ব আদায় করে নিতে একটি মেয়েকে আজও অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। রাজনীতি হল বাইরের জগৎ, ঘরের মহিলাদের এ সব বিষয়ে নাক গলানো অনুচিত— বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ভারতে এমন মত পোষণ করেন বহু মানুষ। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী, লিঙ্গসাম্যের নিরিখে ১৪৮টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১২৯তম। এর একটা বড় কারণ আইনসভায় মেয়েদের প্রতিনিধিত্বের শোচনীয় পরিসংখ্যান।
১৯৫৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থীদের তিন শতাংশেরও কম ছিলেন মহিলা। ২০২৪-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশের আশপাশে। বর্তমানে লোকসভায় নির্বাচিত সাংসদদের মধ্যে মহিলা ৭৪ জন, শতাংশের হিসাবে যা ১৩.৬, ২০১৯-এর তুলনায় সামান্য কম। লোকসভা নির্বাচনে মেয়েদের জন্য আসন সংরক্ষণ নিয়ে বিতর্ক চলছে বহু কাল ধরেই। বস্তুত, লোকসভা ও বিধানসভায় এক-তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, এই মর্মে ২০২৩ সালে একটি আইনও পাশ হয়। তবে হাতেকলমে সেই আইনের প্রয়োগ এখনও বিশ বাঁও জলে। আগে জনগণনা হবে, এবং সেই অনুযায়ী হবে ডিলিমিটেশন— লোকসভা ও বিধানসভার আসনসংখ্যা পুনর্নির্ধারণ। কোন জায়গা কোন নির্বাচনী কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত হবে, তা-ও ঠিক হবে তখন। কোন আসনগুলি সংরক্ষিত হবে, তা জানা যাবে এত কাণ্ডের পরে। আগের বার ডিলিমিটেশন কমিশন রিপোর্ট দিতে সময় নিয়েছিল পাঁচ বছর। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ২০২৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও মহিলাদের আসন সংরক্ষণের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
সংসদে গেলেও মহিলারা বিশেষ মুখ খোলেন না, এই মত অনেকের। নারীবাদী অর্থনীতিবিদ বীণা আগরওয়ালের গবেষণা কিন্তু দেখিয়েছে, আশেপাশে যথেষ্ট সংখ্যক মহিলা থাকলে বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে, প্রশ্ন করতে এবং নেতৃত্ব দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তাঁরা। আর একটি প্রচলিত ধারণা, মহিলারা যদি বা মুখ খোলেন, রাজনীতি-অর্থনীতির মতো কঠিন বিষয়ে সচরাচর ঢোকেন না। বড় জোর নারী ও শিশুকল্যাণ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বা স্বাস্থ্যের মতো ‘সফট’ বিষয়েই তাঁরা আটকে থাকেন। অথচ, সংসদের আলোচনা এবং প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে গবেষক সাদিয়া হুসেন দেখিয়েছেন যে, বিদেশনীতি, স্বরাষ্ট্র, রেল এবং পরিকাঠামোর মতো ‘হার্ডকোর’ বা কঠিন বিষয় পুরুষদের তুলনায় মহিলা সাংসদদের বক্তব্যে বেশি উঠে এসেছে। তাঁদের অনেকেই বরং ‘মহিলা-সাংসদ’, এই পরিচয়ে আটকে থেকে শুধু ‘মহিলা-ইস্যু’ নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন।
মনে রাখতে হবে, মুখ খোলার সুযোগ মহিলারা সহজে পান না, দস্তুরমতো লড়াই করে আদায় করে নিতে হয়। সুবক্তা হিসাবে বামপন্থী নেত্রী মণিকুন্তলা সেনের খ্যাতি ছিল। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষের দিকে দলের সদস্য-সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সংসদে কথা বলার সময় নিয়ে টানাটানি শুরু হয়, এবং তাঁর নামটি দলের বক্তার তালিকা থেকে প্রায়শই বাদ পড়ে যেতে থাকে। ১৯৬০-৬১ সালের একটা বছরে তিনি বক্তৃতা করার সুযোগ পেয়েছিলেন সাকুল্যে সাত মিনিট। খানিক অভিমানের সুরেই তিনি লিখেছেন, “এ নিয়ে কাউকে আমি অনুরোধও করতে যাইনি। বরং কোনও কাজ যখন নেই, তখন ঘণ্টাছয়েক সভায় বসে থেকে নিশ্চিন্ত মনে বেরিয়ে আসতাম।” অনুমান করে নেওয়া যায় যে, সাদিয়া যাঁদের কথা লিখেছেন, তাঁরা আজ নিজেদের মুখ খোলার অধিকার সম্পর্কে আর একটু সঙ্কোচহীন।
আর একটি ভ্রান্ত ধারণা হল, জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব পেয়েছেন যে সব মেয়ে, তাঁদের বেশির ভাগই রাজনীতিক বাবা বা স্বামীর হাত ধরে এই ক্ষেত্রে পা রেখেছেন। অতএব তাঁরা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেহাতই বোড়ে— তাঁদের ক্ষমতায় বসিয়ে সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করা তাই অসম্ভব। গবেষণা বলছে, কয়েকটি ক্ষেত্রে তেমন ঘটনা ঘটলেও সার্বিক চিত্রটি মোটেই সে রকম নয়। আশার কথা এই যে, এত সব ভুল ধারণা সত্ত্বেও দীর্ঘ টালবাহানার পরে শেষ পর্যন্ত আইনসভায় মহিলাদের আসন সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইনটি পাশ করা গিয়েছে।
গবেষকেরা অবশ্য বলেন যে, আসন সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপৃর্ণ একটি পদক্ষেপ হলেও, এটা করে ফেলতে পারলেই যে সমস্ত গোল চুকে যাবে, তা নয়। রাজনীতিতে যে মেয়েরা নেতৃস্থানে পৌঁছন, তাঁদের বড় অংশই ‘এলিট’ বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের। মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ বিলটি অনেক দিন পর্যন্ত পাশ করানো যায়নি, কারণ সমাজবাদী পার্টি বা রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মতো অনেক দলই মনে করত যে, সংরক্ষণের পুরো সুবিধাটাই পাবেন উচ্চবর্ণ হিন্দু মহিলারা। বস্তুত, ১৯৫২ থেকে এখনও পর্যন্ত সংসদে পৌঁছনো মুসলমান মহিলার সংখ্যাটি কুড়ির আশপাশে, যা হতাশাজনক ভাবে কম। এমনকি, পাঁচ বার লোকসভায় কোনও মুসলমান মহিলা সদস্যই ছিলেন না। বর্তমান আইনটি বলবৎ হলে তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনের এক-তৃতীয়াংশ থাকবে মহিলাদের জন্য। প্রান্তিক মেয়েদের দাবিদাওয়া-চাহিদা সংসদে তুলে ধরতে যে তাঁদেরই প্রতিনিধিত্ব দরকার, তা বুঝতে এবং স্বীকার করতেই আমাদের এতটা সময় লাগল।
এক জন পুরুষ ভোটে দাঁড়ালে তাঁকে আর্থিক সাহায্য করতে সহজেই এগিয়ে আসে তাঁর পরিবার। মেয়েদের অভিজ্ঞতা তেমন নয়। ১৯৭৪ সালে ফুলরেণু গুহ, মণিবেন কারা, বীণা মজুমদার-সহ দশ জনের একটি কমিটি তাদের রিপোর্টে লেখে এই কথা। পুরুষ সর্ব ক্ষণের কাজ হিসাবে রাজনীতিকে বেছে নিয়েছেন, স্ত্রী চাকরি জুটিয়ে সংসার চালাচ্ছেন, এ গল্প সুপরিচিত, উল্টোটা অনেক ভেবেও মনে পড়ে না। কমিটির রিপোর্টে এ-ও বলা হয় যে, ভোটে দাঁড়ানো মেয়েদের সম্পর্কে অশ্লীল কথা বলা হয়, লিঙ্গহিংসার মুখে পড়তে হয় অহরহ।
এত সব লড়াইয়ের পরে সংসদে যে মেয়েরা পৌঁছতে পেরেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা কেমন? ৩৯টি দেশের ৫৫ জন মহিলা সাংসদের সাক্ষাৎকার নেয় ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন নামের এক আন্তর্জাতিক সংস্থা। ২০১৬ সালের সেই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ৮২% বলেছেন, তাঁরা সংসদে মানসিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। ২২% বলেছেন যৌন হিংসার কথা। অনেকেই জানিয়েছেন সংসদ কক্ষের ভিতরেই অপমানজনক এবং ‘সেক্সিস্ট’ কথা নিয়মিত শুনতে হয়। সংবাদমাধ্যমে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে নিয়ে অশালীন যৌনগন্ধী মন্তব্যের ঝড় উঠতে দেখেন প্রায়ই। খুন, ধর্ষণ, প্রহারের হুমকিও পান অনেকে। পুরুষ সহকর্মীর অযাচিত মনোযোগ বিব্রত করে প্রতিনিয়ত। ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে মহিলা-প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কুমন্তব্য ভয়ঙ্কর স্তরে পৌঁছেছিল। ‘ট্রোল প্যাট্রোল ইন্ডিয়া’ শীর্ষক একটি গবেষণা দেখায় যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলা রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে টুইটারে দৈনিক গড় বিদ্বেষোদ্গার হয় সবচেয়ে বেশি।
মণিকুন্তলা সেন লিখেছিলেন, বরিশাল থেকে কলকাতায় আসার পর রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ে দেখতেন যুবা-প্রৌঢ় নির্বিশেষে পুরুষেরা কানের কাছে বিড়বিড় করে ‘অসভ্য কথা’ বলে যেত; তার সবটা যে সব সময়ে বোঝা যেত, তা নয়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে তারা হাঁটার গতি বাড়িয়ে চলে যেত। এই উপদ্রবের নাম তাঁরা দিয়েছিলেন, ‘বিড়বিড় সমস্যা’। মণিকুন্তলা আক্ষেপ করেছেন, একটা দুটো অভদ্র লোক রাস্তায় বিরক্ত করলেই তখন গায়ে জ্বালা ধরে যেত। পরে, বিশেষ করে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময়ে আরও অনেক মেয়েকে অনেক বড় অপমানের মুখে পড়তে দেখেছিলেন তিনি। সে অপমানের কোনও চটজলদি প্রতিকার তাঁর জানা ছিল না। রাস্তার অসভ্য পুরুষদের মোকাবিলা করা ছিল তুলনায় সহজ। পা থেকে জুতোটা খুলে রুখে দাঁড়ালেই তারা পড়িমরি করে পালাত।
মণিকুন্তলা সোশ্যাল মিডিয়া দেখেননি, কালে কালে যা হয়ে উঠেছে লিঙ্গ-হিংসার অন্যতম ক্ষেত্র। সেখানে অশ্লীল কথা বলতে বা ছড়াতে আর বিড়বিড় করতে হয় না কাউকে। নামহীন, মুখহীন, বিচ্ছিন্ন মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে ছড়াতে থাকে ঘৃণা আর বিদ্বেষ। সংখ্যাগুরুত্বের কুৎসিত বীভৎসাই তাদের ক্ষমতার উৎস। সত্যিকারের ক্ষমতার আসনে যত বেশি মেয়ে যত দ্রুত পৌঁছবেন, ততই এই বিষের কারবার গুরুত্ব হারাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy