Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Samir Bagchi

সবার জন্য বিজ্ঞানচেতনা

সদ্যপ্রয়াত সমর বাগচী প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক না হয়েও বিজ্ঞানকে ভালবেসে, প্রকৃতিকে ভালবেসে, মানুষকে ভালবেসে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষকেরও শিক্ষক।

An image of Samar Bagchi

সমর বাগচী। —ফাইল চিত্র।

অরিন্দম রাণা
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩ ০৬:০৭
Share: Save:

আশির দশকের গোড়ায় যাঁদের কৈশোর কেটেছে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই মনে করতে পারবেন দূরদর্শনের কোয়েস্ট অনুষ্ঠানটিকে। বিজ্ঞানের সূত্রগুলো সাধারণ দৈনন্দিন জিনিসপত্রের সাহায্যে পরীক্ষানিরীক্ষা করে শেখা কত সহজে সম্ভব, এই অনুষ্ঠানটি আমাদের শিখিয়েছিল। শিখিয়েছিলেন সদ্যপ্রয়াত সমর বাগচী (১৯৩৩-২০২৩)— প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক না হয়েও বিজ্ঞানকে ভালবেসে, প্রকৃতিকে ভালবেসে, মানুষকে ভালবেসে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষকেরও শিক্ষক।

বিজ্ঞানচেতনার প্রসারকে তিনি নিজের জীবনের অঙ্গ করেছিলেন। হয়তো চলেছেন কোথাও বিজ্ঞানের কর্মশালায় প্রদর্শনী করতে। পাশে বসা সহযাত্রী কিশোর বা কিশোরীটিকে যেচে আলাপ করে বুঝিয়ে দিলেন গতিজাড্যের কথা, সম্বল নিজের গলায় ঝোলানো চশমাটি। আবার পাড়ার দোকানে কিছু কিনতে গিয়ে দোকানির ১০০ গ্রামের বাটখারাটি নিয়ে এক নিউটন বলের ধারণা দিলেন ওই দোকানে খাতা কিনতে আসা কোনও ছাত্রকে। ওঁর একটি বড় ব্যাগ ছিল, উনি বলতেন ‘কাকের বাসা’। কী ছিল না তাতে! যাবতীয় ফেলে দেওয়া বস্তু, শিশিবোতল, প্লাস্টিকের নানা ভাঙাচোরা জিনিস, গ্রামের মেলায় কেনা খেলনা— সব ঠাঁই পেত সে কাকের বাসায়। সমরবাবু এই সব ফেলে দেওয়া আপাততুচ্ছ জিনিসে দেখতেন বিজ্ঞানের বিস্ময়। বিশেষত আমাদের দেশজ খেলনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞানের সাধারণ সূত্রগুলি নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরায় তাঁর ছিল অনাবিল আনন্দ।

জন্ম বিহারের পূর্ণিয়ায়। স্কুলের লেখাপড়া দুমকা ও মুঙ্গেরে। ম্যাট্রিকের সময় পিতৃবিয়োগ, তার পর থেকে কলকাতায় বসবাস। স্কটিশ চার্চ কলেজে বি এসসি পড়ার সময়ে তাঁর মধ্যে যে পরিবর্তন তিনি অনুভব করেন, সেই স্মৃতি তিনি বার বার বিভিন্ন প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেন। বলতেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ডি পি রায়চৌধুরীর কথা। তাঁর ক্লাসে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে পাঠদান তাঁর মনে চিরস্থায়ী হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকের অনর্গল আবৃত্তি তাঁকে অনুপ্রাণিত করে; যে কোনও আড্ডায়, কর্মশালায় প্রিয় কবি অরুণ মিত্র, জীবনানন্দ দাশ, ইয়েটস ও রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি তিনি স্মৃতি থেকে বলতেন তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে। আর তিনি বলতেন তাঁর এক বামপন্থী আত্মীয়ের কথা, যাঁর সাহচর্যে তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে।

বি এসসির পর তিনি ধানবাদ স্কুল অব মাইন্সে ভর্তি হন। কিন্তু, সেই পেশায় যাওয়া হল না শেষ পর্যন্ত। ফুটবল খেলতে গিয়ে শিরদাঁড়ায় চোট পেলেন, অস্ত্রোপচার হল। খনির চাকরিতে শারীরিক সক্ষমতা বাধা হয়ে দাঁড়াল। হঠাৎই কাগজে কলকাতার বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজ়িয়মের বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন পাঠান। সেই চাকরি তাঁর জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। ক্রমে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের নির্দেশক পদে উন্নীত হন। এই সংস্থাকে শুধুমাত্র এক কারিগরি শিল্পের সংগ্রহশালায় আটকে না রেখে, মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের ভাবনা অনুযায়ী তিনি একে এক শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। ওঁর প্রচেষ্টায় এখানে ছাত্রছাত্রীদের অবাধ বিচরণ, খুশিমতো পরীক্ষার মাধ্যমে কৌতূহল নিরসন ও আপন সৃষ্টিভাবনাকে প্রয়োগ করার সুযোগ। ক্রমে সর্বভারতীয় স্তরে বিজ্ঞান সচেতনতা প্রসারের আন্দোলন গড়ে ওঠে ওঁর মতো আরও কিছু উদ্যোগী মানুষের সহযোগিতায়। শুধু বাংলায় নয়, দেশের সব প্রান্তেই বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ে তোলা, বিজ্ঞান মেলার আয়োজন, কলকাতার আদলে কারিগরি বিজ্ঞান সংগ্রহশালা গড়ে তোলা এবং সর্বোপরি যে কেউ বিজ্ঞান সচেতনতা প্রসারের সামান্য চেষ্টা করলেই তাঁর পাশে দাঁড়ানো— এই সব কর্মকাণ্ডের পিছনে গত চল্লিশ বছরে এই একটি সদাহাস্যময় অক্লান্ত মানুষকে পাওয়া নিশ্চিত।

দূরদর্শনের কোয়েস্ট অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও পরিবেশনায় অগ্রণী ভূমিকা নেন তিনি। সারা দেশ জুড়ে এই অনুষ্ঠানের বিপুল জনপ্রিয়তা ও অভিনবত্ব তাঁকে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করে। সেই সম্মান তাঁকে আরও দায়িত্বসচেতন, কর্মোদ্যোগী করেছিল। জীবনসায়াহ্নেও বার বার বলতেন, “অনেক কাজ পড়ে আছে হে, আমি এ ভাবে শুয়ে থাকলে শেষ করব কবে?”

যা জানতেন, উজাড় করে দিতেন; যা জানতেন না, তাও নিজে পরিশ্রম করে খুঁজে বার করে যার প্রয়োজন তাঁকে উদ্যোগ নিয়ে জানিয়ে আসতেন। তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, এমন প্রত্যেকেরই এ রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। শিশুকিশোরদের মধ্যে যাতে অন্য প্রাণীদের প্রতি সম্মান ও ভালবাসা জাগে, তার জন্য তৈরি করেছিলেন পোষ্যদের নিয়ে ক্লাব। অনাথ শিশুদের মধ্যেও আনন্দের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসে সক্রিয় হন। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে সন্ধেবেলা অনন্ত আকাশের চালচিত্রে চিনিয়ে দেন অসংখ্য নক্ষত্র, যেন তারা সব তাঁর ঘরের পাশের প্রতিবেশী। আবার সঙ্গীতের আসরেও তাঁর উপস্থিতি, সে নিয়েও তিনি সরস আলোচনায় মেতে উঠতেন।

পরিবেশ রক্ষায় পথে নেমে হেঁটেছিলেন মেধা পটকরের পাশে; পঁচাশি বছর বয়সে পৌঁছেও মানবাধিকার রক্ষায় মিছিলে পা মেলান সবার সঙ্গে। বার বার বলতেন, “আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের হাতে এ কোন পৃথিবী তুলে দিয়ে যাব আমরা?” পরিবেশের কথায়, মানুষের কথায়, সমাজ প্রসঙ্গে বার বার তাঁর কণ্ঠে বেজে উঠত তাঁর অন্তরের বিশ্বাস তাঁর প্রিয় কবি অরুণ মিত্র ও জীবনানন্দের ভাষ্যে।

গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথে ছিলেন সম্পূর্ণ নিমজ্জিত, সম্পৃক্ত। লিখেছেন প্রচুর, যার বেশিটাই ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ছোট-বড় পত্রপত্রিকায়। কত জনকে কত রকম ভাবে উৎসাহ দিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। বিজ্ঞানকে পেশা করা হোক বা না হোক, দৈনন্দিন জীবনচর্যায় বিজ্ঞানোচিত আচরণ এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলবে, এই ভাবনার শরিক হোক প্রত্যেকে, এটাই ছিল এই আমৃত্যু যুবকের স্বপ্ন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy