আগ্রহী: অর্থমন্ত্রীর বাজেট-ভাষণের সরাসরি সম্প্রচারে মগ্ন দর্শক। ২৩ জুলাই, অমৃতসর। পিটিআই।
২০৪৭ সালটি দু’টি কারণে গুরুত্বপূর্ণ— তার একটি মুখ্য, অন্যটি গৌণ। গৌণ কারণটি হল, সে বছর স্বাধীনতার শতবর্ষ; আর মুখ্য কারণটি হল, সে বছর ভারত ‘বিকশিত ভারত’ হয়ে উঠবে। সেই বিকশিত ভারতের লক্ষ্যে তৃতীয় এনডিএ সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী পূর্ণ বাজেট পেশ করলেন গত কাল। তিনি এই নিয়ে সপ্তম বার এই কাজটি করে মোরারজি দেশাইয়ের রেকর্ড ভঙ্গ করলেন। ওই ২০৪৭ ব্যাপারটি জুড়ে থাকায় একে ‘সুদূরদর্শী’ বাজেট বলতেই হয়, আক্ষরিক অর্থে। কিন্তু সমস্যা হল, ২০২৪-এর বাজেটের মূল্যায়ন যদি ২০৪৭-এর লক্ষ্য সাপেক্ষে করতে হয়, সে ভারী শক্ত কাজ হবে! তাই বাধ্য হয়েই ‘অদূরদর্শী’ আলোচনার চেষ্টা করা যাক।
এক বছরে দু’বার বাজেট। সাড়ে চার মাসের ব্যবধানে সবই আবার করতে হল আচার-বিচার মেনে। অর্থ দফতরের আধিকারিকরা পুনরায় হালুয়া ভক্ষণ সমাপন করে নর্থ ব্লকের আপিসের বেসমেন্টে দুয়ার এঁটে বসলেন অঙ্ক মেলাতে। বাজেট পেশ হলে তবে তাঁরা বহির্বিশ্বের আলো দেখবেন। সত্যি বলতে কী, বাজেট নির্মাণের এই বিশেষ আচারটি নিয়ে আমার বেজায় কৌতূহল। বেসমেন্টে ওই ক’টা দিন আটক অবস্থায় তাঁদের কেমন লাগে, ইত্যাদি গুরুতর বিষয়ে ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে বাজেটের অঙ্কগুলো আর মাথায় নিতে পারি না। কিন্তু বাজেট আলোচকের দায়িত্ব যে প্রধানত বাজেটের বিশ্লেষণ, তা ভুললে চলে না। মার্ক টোয়েন নাকি বলেছিলেন (এমন অনেক কথাই মার্ক টোয়েনের নামে চালানো হয় যা তিনি বলেননি), ভোট দিয়ে সত্যিই যদি কিছু বদলানো যেত তা হলে কি আর ওরা ভোট দিতে দিত! বাজেট আলোচনা সম্পর্কেও বোধ হয় একই কথা বলা যায়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে নির্মলা সীতারামন যখন অন্তর্বর্তী বাজেটটি পেশ করলেন, নির্বাচন মহোৎসবের ঢাকের কাঠি তখন পড়তে চলেছে। তাঁর প্রত্যয়ী বক্তৃতায় স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, তাঁর দল বিজেপি যে তুমুল ভাবে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরছে, সে বাবদে তিনি নিশ্চিত। ক্ষমতায় এল তাঁর দল, কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নয়। দুই শরিককে ডাইনে-বাঁয়ে নিয়ে চলতে বাধ্য হল দল, এবং অঘটন না ঘটলে আগামী চারটি বাজেটেও শরিক-জোড় ঘাড়ের উপরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকবে। সীতারামনের বাজেট-বক্তৃতায় অনেকটা জায়গা জুড়ে বিহার এবং অন্ধ্রপ্রদেশের উল্লেখ স্পষ্টতই এই বাধ্যবাধকতার চিহ্ন বহন করছে। রাস্তাঘাট-সেতু থেকে কাশীর ধাঁচে মন্দির করিডর— বিহারের ভাগ্য আপাতত ঊর্ধ্বগামী। আর ওই রাজ্যদ্বয়ের নামোচ্চারণ মাত্রই বিরোধী সদস্যদের থেকে যে রকম প্রতিক্রিয়া আসছিল, তা পরিবর্তিত পরিস্থিতির খানিক আন্দাজ দিচ্ছিল। ধরে নেওয়া যায় যে, সংসদের বাজেট অধিবেশনের অবশিষ্ট দিনগুলিতে যথেষ্ট নাটকীয়তা থাকবে।
সলতে পাকানোর কাজটি হালুয়া বিতরণের দিনকয়েক আগে থেকেই চলছিল। সপ্তাহ দুয়েক আগে আচমকা জানতে পারলাম, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া-র এক রিপোর্ট বলছে, গত দশ বছরে ১৮ কোটি মানুষ কাজ পেয়েছেন, ফলে বেকারত্বের হার নিম্নগামী। কর্মনিয়োগ এবং বেকারত্ব বিষয়ে যাঁরা কিঞ্চিৎ খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা তো তাজ্জব! রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তো এ কাজ করার কথা নয়। দেখা গেল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক-নিয়োজিত গবেষকরা আসলে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে তথ্য নিয়েই আপন মনের মাধুরী মিশায়ে এমন রিপোর্ট রচনা করেছেন। কর্মনিযুক্তি যে বেড়েছে, তা মিথ্যা নয়। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, আম আদমি যাকে ‘চাকরি’ বলে বোঝে, এ তেমন কাজ নয়। প্রধানত স্বনিযুক্তি বেড়েছে, আর বেড়েছে কৃষি-পরিবারে মহিলাদের পারিবারিক উদ্যোগে অংশগ্রহণ। এই কঠিন সত্যটির উপরে স্বনামধন্য রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে দিয়ে খানিক চুনকাম করে চেষ্টা হল বোঝানোর যে, বেকারত্বের সমস্যা আসলে তেমন সমস্যা নয়।
বাজেট করে যে অনেক চাকরি সৃষ্টি করা যায়, এমন অবাস্তব চিন্তা সম্ভবত কেউই করেন না। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব নিয়ে সরকার ভাবছে না, এই অভিযোগ বাজেটকালে উঠে আসেই। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট দিয়ে সে অভিযোগ প্রশমনের উদ্যোগের পর সীতারামনের বক্তৃতায় কোথাও কর্মহীনতার সমস্যাকে আর সমস্যা বলে উল্লেখ করতে হয় না। কিন্তু যুবা-বয়সিদের মধ্যে কর্মনিযুক্তির সম্ভাবনা বাড়াতে একগুচ্ছ প্রকল্পের ঘোষণা করেন তিনি, যা পাঁচ বছর জুড়ে চলবে। দু’লক্ষ কোটি টাকা সে বাবদে বরাদ্দও করা হয়েছে। যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে দক্ষতা ও নিয়োগযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলতে এ ধরনের প্রকল্পের প্রয়োজন নেই, এমন কথা কেউই বলবেন না। কিন্তু এ সবই অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে জোগানের দিকের নীতি। দক্ষ কর্মীর জোগান থাকলে উৎপাদন তখনই বাড়বে, যখন উৎপন্ন পণ্যের জন্যে যথেষ্ট চাহিদা থাকবে। এই চাহিদা আবার নির্ভর করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উপর। আগেই উল্লেখ করেছি, কয়েক কোটি মানুষের যে ধরনের কর্মনিযুক্তি হয়েছে, তা থেকে তাঁদের এমন আয় হতে পারে না, যা দিয়ে যথেষ্ট পণ্য কেনা যায়। সীতারামনের সাতটি বাজেটেই একটি মতাদর্শ আশ্চর্যজনক ভাবে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে গেছে— তা হল, চাহিদার অভাবজনিত সমস্যা বলে কিছু হয় না।
একটা আন্দাজ ছিল, এ বারের বাজেট হবে ‘জনমুখী’। কিন্তু এমন জনমুখী হবে না, যাকে বোদ্ধারা বলেন ‘জনমোহিনী’। আয়কর কাঠামোয় একটু টুসকি দিয়ে, ‘স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন’-কে ৫০ হাজার থেকে ৭৫ হাজারে তুলে বলা হল মাস মাইনের চাকুরেদের বৎসরান্তে ১৭,৫০০ টাকা সাশ্রয় হবে। হবে হয়তো! কিন্তু বিনিয়োগকারীদের জন্য কিঞ্চিৎ খারাপ খবর রয়েছে। পুঁজি থেকে লাভের উপর কর বেড়েছে। স্বল্পকালীন লাভের উপর কর ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২০ শতাংশ, আর দীর্ঘকালীন লাভের উপর ১০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে সাড়ে বারো।
ভেবেছিলাম এ বার পুঁজির মালিকদের উপরে দাক্ষিণ্য বাড়তে পারে, কারণ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের লাভ থেকে ২.১১ লক্ষ কোটি টাকা এখন সরকারের তহবিলে। এমন আশাতীত আয় হলে সুবিধাপ্রদান পুঁজির দিকে ঝোঁকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা হয়নি দেখে স্বস্তি হল। তবে এই অতিরিক্ত রাজস্বের কথাটি সীতারামন একেবারেই এড়িয়ে গেছেন।
বাজেট-দিবসে সারা দিন চ্যানেলে চ্যানেলে যে আলোচনা চলে, তা পুরোটাই হয় অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনে। অনেকে অবশ্য বক্তৃতা না শুনেও চলে আসেন এবং জোরালো বক্তব্য পেশ করেন। কিন্তু প্রায় কেউই ‘বাজেট অ্যাট আ গ্ল্যান্স’-এ প্রদত্ত সংখ্যাগুলি উল্টে দেখার সময় পান না। বাজেট-দিবস অতিক্রান্ত হলে তো আর সে দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজনই পড়ে না। অথচ গল্পের অনেক উপাদান সেখানেই মজুত থাকে। যেমন, গত বছরের বাজেটে সরকারের মোট খরচ যা ধরা হয়েছিল, এ বার তা থেকে বেড়েছে মাত্র সাত শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হারকে যদি হিসাবে রাখি, তা হলে প্রকৃত বৃদ্ধি সামান্যই। আর এই মোট সরকারি ব্যয় জাতীয় উৎপাদন/আয়ের ১৫ শতাংশেরও কম। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এই হার ভারতের থেকে বেশি। ২০৪৭-এ ‘বিকশিত’ ভারত দেখতে চাইলে এই হারকে যে সেই মতো বেড়ে চলতে হবে, তার স্বীকৃতি কোথাও দেখি না। আবার খরচের হিসাবের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যে, গত বছরের বাজেটে মোট খরচ যতটা ধরা হয়েছিল, তার থেকে অন্তত ষাট হাজার কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। সংসারে বাজেটের থেকে খরচ কম হওয়াটা কাঙ্ক্ষিত হলেও দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে তা বলা যায় না। বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের পুরো অর্থ খরচ না হওয়াটা কম-বেশি সব বাজেটে থাকে। কিন্তু শতাংশে বৃদ্ধির হিসাবগুলো কষতে গেলে বরাদ্দ নেব, না বাস্তবায়িত ব্যয়কে ধরব— এই বিবেচনাটি গুরুত্বপূর্ণ।
‘বাজেট সেশন আমাদের গণতন্ত্রের গৌরবময় যাত্রার অন্তিম গন্তব্য’, পরশু সংসদের বাজেট অধিবেশনের সূচনায় বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কী যে এর অর্থ, তা কে বলে দেবে! তার মানে কি বাজেটে উপনীত হয়ে গণতন্ত্রের যাত্রা সমাপ্ত? তার পর না-গণতন্ত্রের যাত্রা? কবিগুরুর সাহায্য নিয়ে বলতে হয়, ‘কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy