আজ শ্রীশ্রীমা সারদার ১৭১তম জন্মদিন। —ফাইল চিত্র।
তাঁকে নিয়ে লেখা খুব সহজ নয়। আপনজনের কথা কেমন করে বলব? তিনি নিজে বলেছেন, “মনে ভাববে, আর কেউ না থাক, আমার একজন ‘মা’ আছেন।” মা বলতে আমরা বুঝি নিখাদ নিঃস্বার্থ ভালবাসা, যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে, দোষ-গুণ সাংসারিক অবস্থার ঊর্ধ্বে। তাই তিনি সকলের ‘মা’, বিশ্বজননী। তাঁর শ্রেণি, গোত্রের বিচার নেই।
বরং যে সন্তান দুর্বল, তার দিকেই মায়ের টান বেশি। স্বামী সারদেশানন্দ লিখছেন, মায়ের বাড়িতে কুলি, মজুর, পাল্কি-বেহারা, ফেরিওয়ালা, মেছুনি-জেলে, যে-ই আসুক, সকলেই তাঁর পুত্র-কন্যা; সকলে ভক্তদের মতোই স্নেহ-আদর পায়। যে-কোনও উপলক্ষেই আসুক, জলখাবার মুড়ি-গুড় না হলে অন্তত একটু প্রসাদী মিষ্টি, জল পাবেই। আর সেই সকরুণ স্নেহদৃষ্টি, যা ইহকাল-পরকালে আর ভুলতে পারবে না। যদি বা বিস্মরণ হয়, দুঃখে-কষ্টে পড়লেই মনে হবে অভয়াকে, আর মনে পড়বে তাঁর অভয়বাণী, কৃপাদৃষ্টি!
সমাজে যারা অবহেলিত, কিংবা কোনও অপরাধ করে ফেলার জন্য লোকের চোখে হেয়, মায়ের স্নেহ থেকে তারাও বঞ্চিত হত না। কথামৃতকার শ্রীম-র ছাত্র ছিলেন বিনোদবিহারী সোম, পরে নাম হয় ‘পদ্মবিনোদ’। সঙ্গদোষে তিনি পানাসক্ত হয়ে পড়েন। গভীর রাতে নেশা করে শ্রীমায়ের বাগবাজারের বাড়ির পাশ দিয়ে বকতে বকতে পদ্মবিনোদ চলে যেতেন। এক রাতে ভিতর থেকে কোনও আওয়াজ না পেয়ে পদ্মবিনোদ নেশার ঝোঁকে গান ধরলেন, “উঠো গো করুণাময়ী খোলো গো কুটির দ্বার, আঁধারে হেরিতে নারি হৃদি কাঁপে অনিবার।” গানের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের জানলার দরজা খুলে গেল। পদ্মবিনোদ তা দেখে আনন্দে বলে উঠল, “উঠেছ মা? ছেলের ডাক শুনেছ? উঠেছ তো পেন্নাম নাও।” বলে তিনি রাস্তায় গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। তার পর রাস্তার ধুলো মাথায় তুলে নিয়ে চলতে চলতে গান ধরলেন, “যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে, (মন) তুই দেখ আর আমি দেখি আর যেন কেউ নাহি দেখে,” আবার সঙ্গে সঙ্গে আখর দিলেন, “আমি দেখি, দোস্ত না দেখে।” (পদ্মবিনোদ সারদানন্দজিকে ‘দোস্ত’ বলে ডাকতেন।) পর দিন এ ভাবে মাকে ঘুম থেকে ওঠানোয় সবাই আপত্তি করতে মা বললেন, “ওর ডাকে যে থাকতে পারিনে।”
যে তাঁর কাছে এসে পড়ত, আশ্রয় চাইত, মা তাঁদের অকাতরে ভালবাসতেন, আশ্রয় দিতেন। গাঁয়ের এক বৃদ্ধা মাঝি-বৌ দীর্ঘ দিন পরে মায়ের কাছে এসেছেন। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, তাঁর রোজগেরে ছেলেটি মারা গেছে। শুনে মা ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগলেন। যাঁর গলার স্বর কখনও শোনা যায় না, তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে দেখে সেবক সাধুটি ব্যস্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তিনি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন— দুই মা-ই সন্তান শোকে কাঁদছেন, কার সন্তান বোঝা যাচ্ছে না। পরে একটু শান্ত হয়ে মা দরিদ্র মাঝি-বৌকে এক মাথা তেল ও মুড়িগুড় দিলেন। যাওয়ার সময় বললেন, “আবার এসো মাঝি-বৌ।”
জয়রামবাটী অঞ্চলের মুসলমান ডাকাত আমজাদ। মায়ের প্রতি তার বিশেষ ভক্তি। এক বার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এক ঝুড়ি লাউ নিয়ে সে জয়রামবাটীতে মায়ের কাছে এসে হাজির হল। এত দিন আসেনি কেন, মা প্রশ্ন করতে আমজাদ বিনা দ্বিধায় বলল, সে গরু চুরির দায়ে ধরা পড়েছিল। মা সহানুভূতির সুরে বললেন, “তাই তো ভাবি, আমজাদ এত দিন আসে না কেন?” এই আমজাদকে খাওয়ানোর সময়ে পরিবেশনকারিণী নলিনীদিদি দূর থেকে খাবার ছুড়ে দিলে মা তাঁকে তিরস্কার করেন। আমজাদের উচ্ছিষ্ট স্থান মা নিজে পরিষ্কার করছেন দেখে নলিনীদিদি জাত যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করতে মা উত্তর দিলেন, “আমার শরৎ (স্বামী সারদানন্দজি) যেমন ছেলে, এই আমজাদও তেমন ছেলে।”
মা কিন্তু শুধুই স্নেহময়ী জননী নন, পথপ্রদর্শক, গুরুও। তাঁর সন্তানরা আদর্শ জীবন যাপন করুক, পরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাক, এই দিকে তাঁর সজাগ দৃষ্টি। যারা সংসারী, তারা কী ভাবে চলবে সে শিক্ষা দিচ্ছেন নিজের জীবন দেখিয়ে। তেমনই যারা সংসার-ত্যাগী, তাদের জন্যও তাঁর বিশেষ দৃষ্টি। তাঁর ভাষায় তারা ‘দেবশিশু’। মা বলতেন, “আমি মা কিনা সন্ন্যাস নাম ধরে ডাকতে প্রাণে লাগে।” কিন্তু প্রয়োজনে কঠোর হতেও তিনি দ্বিধাবোধ করতেন না। এক বার তাঁর এক ত্যাগী-সন্তান সন্ন্যাসের পবিত্র ব্রত ভঙ্গ করে অনুতপ্ত হন। মা তাঁকে বলেছিলেন, “তোমার সব অপরাধ আমি ক্ষমা করেছি, তুমি আমার সন্তানই থাকবে, কিন্তু ব্রতভঙ্গকারীর কোনও প্রায়শ্চিত্তেই সন্ন্যাসী-সঙ্ঘে স্থান হতে পারে না।” যে ভুল করেছে, মাতৃসুলভ স্নেহ দিয়ে তার ভুল দেখিয়ে দিয়েছেন, ভুল সংশোধন করতে উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু ভুল ‘ভুল’ নয়, কখনও তা বলেননি। দুর্বলকে ক্ষমা করেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, চেয়েছেন সে দুর্বলতা জয় করুক, তার পথও বলে দিয়েছেন। কিন্তু স্নেহান্ধ হয়ে দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি স্নেহময়ী ছিলেন, স্নেহদুর্বলা ছিলেন না।
বিদায় নেওয়ার কয়েক দিন আগে সারদা দেবী নিজমুখে বলেছেন, “যারা এসেছে, যারা আসেনি, যারা আসবে, আমার সকল সন্তানদের জানিয়ে দিয়ো মা, আমার ভালবাসা, আশীর্বাদ সকলের উপর আছে।” তিনি আমাদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, মা বলে ডাকলে তিনি আমাদের ফেরাতে পারবেন না। তিনি আমাদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে আরও ভালবাসতে শেখান, তাঁর নিজের আদর্শে আমাদের আরও সেবামুখী করে তুলুন, এই প্রার্থনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy