ধ্বংসলীলা: ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ চলাকালীন রুশ ক্ষেপণাস্ত্রে বিধ্বস্ত এক আবাসনে চলছে উদ্ধারের কাজ। ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩। ছবি: রয়টার্স।
যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু খেলা,
যুদ্ধ মানেই
আমার প্রতি তোমার অবহেলা৷
—নির্মলেন্দু গুণ, ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’
রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ বছর পার করল। যে কোনও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধেরই পরিণাম যা— অপরিমেয় মানবিক ট্র্যাজেডি, বিশেষত ইউক্রেনের পক্ষে ঘটে চলেছে এবং তা ক্রমবর্ধমান। অসংখ্য সেনা (যার মধ্যে রুশ সেনাও আছে) ও ইউক্রেনের নিরপরাধ সাধারণ মানুষের মৃত্যু মিছিল, সে দেশের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির ধ্বংসপ্রাপ্তি, প্রাণভয়ে দলে দলে মানুষের দেশ ছেড়ে যাওয়া ও অন্য দেশের উদ্বাস্তু শিবিরে অস্থায়ী, অনিশ্চিত জীবনযাপন। বাকিদের দেশের মধ্যেই প্রতি মুহূর্তের মৃত্যুভয় নিয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় টিকে থাকা, খাদ্য, জ্বালানি, পানীয় জল প্রভৃতির তীব্র সঙ্কট, ব্যাপক পরিবেশ দূষণ এবং এই রকমই নানা বৈনাশিক শরশয্যায় শুয়ে আছে একটি দেশের চার কোটির বেশি মানুষ— যে জনসংখ্যা বছর বছর (প্রায় ৮ শতাংশ হারে) কমছে! অথচ, যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণ নেই। থামানোর জন্য, শান্তি প্রতিষ্ঠা বা যুদ্ধবিরতির জন্যও কোনও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেই। যুদ্ধের জেরে ব্রিটেন-সহ ইউরোপের বহু দেশ তীব্র জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি, তবু সমঝোতার হদিস নেই। বরং, সঙ্কট জিইয়ে রাখার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রচেষ্টা টের পাওয়া যাচ্ছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনেক ‘ঘর পোড়া গরু’ই এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর (১৯৪৫) থেকে সোভিয়েট রাশিয়ার পতন (১৯৯০) পর্যন্ত রুশ শিবির বনাম পশ্চিমি শিবিরের মধ্যে চলা ঠান্ডা যুদ্ধের ছায়া দেখছেন।
‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ আসলে বিশ্বযুদ্ধের মতো সর্বব্যাপী যুদ্ধ নয়— দু’পক্ষের মধ্যে তীব্র স্নায়ুর লড়াই। সব সময়ই যুদ্ধ ‘হয়-হয়’ এমন একটা ভাব— কিন্তু যা আদতে, সঙ্কট ও টেনশন অতি তীব্র হলেও শেষে দু’পক্ষের নানা পর্যায়ের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বড় যুদ্ধ না ঘটতে দেওয়ার এক জটিল প্রক্রিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি-ইটালি-জাপানের অক্ষশক্তির পতন হওয়ায়, সোভিয়েট রাশিয়া ও আমেরিকার সাহায্যে যুদ্ধ জিতলেও, ব্রিটেন ও ফ্রান্স-সহ ইউরোপের তৎকালীন ঔপনিবেশিক দেশগুলির ‘মিত্রশক্তি’ কার্যত আর্থিক-প্রশাসনিক-সামরিক ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল, যা থেকে তাদের উদ্ধার করতে পশ্চিমের ‘রক্ষাকর্তা’ হিসাবে আমেরিকার অভ্যুদয়। অন্য দিকে, জার্মানির পূর্বাংশ-সহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি হিটলারের দখলমুক্ত করে সোভিয়েট রাশিয়া নিজেই ওই সব দেশে (বিপ্লব ছাড়াই) অনুগত সমাজবাদী ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তাতে প্রমাদ গুনে পশ্চিম ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে নানা জোট গড়ে তোলে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সামরিক জোট— ‘উত্তর অতলান্তিক চুক্তি সংগঠন’ বা ‘নেটো’, যার প্রতিপক্ষ সোভিয়েট জোটের ওয়ারশ চুক্তি। কেবল সামরিক নয়, আর্থিক, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক, মতাদর্শগত (পুঁজিবাদ বনাম সমাজবাদ) প্রভৃতি প্রায় সকল ক্ষেত্রেই গড়ে উঠল দুই ‘মেরু’র প্রতিস্পর্ধী নানা সংগঠন। ভারত, মিশর, পূর্বতন যুগোস্লাভিয়ার মতো দেশ এই জোটের ‘বাইরে’ থাকলেও, দ্বিমেরুবিভক্ত ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-র আখ্যানই হয়ে উঠেছিল বিশ্ব রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি।
‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ চলাকালীন বিশ্বে সর্বব্যাপী যুদ্ধ হয়নি ঠিকই, কিন্তু ওই নামের মধ্যে ‘যুদ্ধ’ কথাটাই তো সবচেয়ে গোলমেলে— যা নীতি হিসাবে ‘শান্তি’র পরিপন্থী। তাই ঠান্ডা যুদ্ধের দীর্ঘ আবহে বিশ্বের সর্বত্র একটা প্রতিযোগিতার স্রোত দুই শিবিরেই বইত। কলকাতার লেখাপড়া ও সংস্কৃতির ভুবনেও তার পরশ রীতিমতো টের পাওয়া যেত। এক দিকে বহুল প্রচারিত পত্রিকা সোভিয়েত দেশ, অন্য দিকে আমেরিকার স্প্যান। এক দিকে রাশিয়ার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গোর্কি সদন তো অন্য দিকে, পশ্চিম জার্মানির ম্যাক্সমুলার ভবন, কিংবা আমেরিকান সেন্টার বা ইউএসআইএস। চূড়ান্ত রেষারেষির সেই ভুবনে আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় মুদ্রিত প্রবলেমস অব কমিউনিজ়ম পত্রিকাটির তাত্ত্বিক এলেম ছিল। মার্ক্সবাদী তত্ত্ব ও বিশেষত তার সোভিয়েট ইউনিয়ন অনুমোদিত প্রয়োগের প্রায় প্রতিটি বিষয়ের পাল্টা যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করত।
১৯৯০-এর দশকে রাশিয়া-সহ পূর্ব ইউরোপে সমাজবাদের পতন তথা সোভিয়েট প্রজাতন্ত্র ভেঙে মধ্য এশিয়া থেকে ইউরোপে বহু ছোট-বড় নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভবে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হয়—আমেরিকা ও পশ্চিমি দুনিয়ার একাধিপত্যে ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা’র সূচনায়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রবলেমস অব কমিউনিজ়ম পত্রিকাটির ইন্তেকাল হয়েছিল। কিন্তু ‘সমস্যা’ ফিরে এল অন্য রূপে— নতুন বিশ্ব জুড়ে সন্ত্রাসী মৌলবাদের দামামা বেজে গেল, যার আগুনে এক দশকের মধ্যে ৯ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের জোড়া টাওয়ার ভেঙে পড়ল। পুঁজিবাদ বনাম সমাজবাদের পুরনো দ্বন্দ্বের পরিবর্তে এল স্যামুয়েল হান্টিংটনের ‘সভ্যতাভিত্তিক সংঘাত’-এর তত্ত্ব, ইসলামি সভ্যতার সঙ্গে বাকি সভ্যতাগুলির মৌলিক সংঘাতই যার প্রতিপাদ্য। এখনকার ইউক্রেন-রাশিয়ার দ্বন্দ্ব, গত দু’দশক ধরে চলে আসা এই ‘সভ্যতার সংঘাত’-এর থেকে ভিন্ন এক আখ্যানের সূচনা করেছে, যার ভিত্তি ধর্মভিত্তিক সভ্যতা নয়— যে সংঘাতের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পুরনো গল্প। সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে ইউক্রেন আলাদা হলেও পুতিনের রাশিয়া চেয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ ও (কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে) বিশিষ্ট ভূরাজনৈতিক অবস্থানের ইউক্রেনে যাতে তার অনুগত সরকার থাকে। একই কারণে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আড়ালে পশ্চিমি দেশেগুলিও চেয়েছে ইউক্রেনে তাদের দিকে থেকে ঢলে-থাকা সরকার। ২০১৪-তে এক ‘সামাজিক বিপ্লব’-এর মধ্য দিয়ে রুশ-বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠা হলে, পুতিন ইউক্রেনের অন্তর্গত কৃষ্ণসাগর অন্তরীপের ক্রাইমিয়া দখল করেন। এখনকার প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কি আরও পশ্চিমপন্থী। তাই, কেবল ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, আমেরিকা ও ‘নেটো’রও পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন। ফলে, ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া বনাম পশ্চিমি শক্তিগুলির সংঘাত আবার নতুন করে ঠান্ডা যুদ্ধের স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে।
কিন্তু যেমনটা দার্শনিক হেগেলের উক্তি একটু পাল্টে মার্ক্স বলেছিলেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি একই ভাবে হয় না— প্রথমটায় যদি ‘ট্র্যাজেডি’ হয়ে থাকে, দ্বিতীয় বার তা হয়ে দাঁড়ায় প্রহসন— তেমনই ইউক্রেন-রুশ দ্বন্দ্ব এক দিকে যখন অতলস্পর্শী সর্বনাশের আবহ রচনা করেছে, অন্য দিকে তার জেরে এক নতুন অর্থনীতিরও উন্মোচন হচ্ছে। অস্ত্র-ব্যবসার বিশ্বজনীন উত্তুঙ্গ অর্থনীতি, যা গত নভেম্বরের মধ্যেই এই ব্যবসার কারবারিদের পকেট কমপক্ষে দুই ট্রিলিয়ন ডলারে ভরিয়ে দিয়েছে। গত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে, আমেরিকার শিকাগো-ভিত্তিক ইন দিজ় টাইমস ম্যাগাজ়িন জানাচ্ছে, ভার্জিনিয়ার সামরিক কোম্পানি, ‘রেথিয়ন’-এর সিইও, গ্রেগ হেস এবং ওয়াশিংটনের নিকটবর্তী মেরিল্যান্ডের প্রতিরক্ষা বিষয়ক কোম্পানি, ‘লকহিড মার্টিন’-এর প্রধান, জিম টেকলেট তাঁদের অংশীদারদের ‘সুখবর’ দিয়ে জানাচ্ছেন যে, গত এক বছরে ইউক্রেন-রুশ দ্বন্দ্বে তাঁরা বিপুল পরিমাণে লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। এই সময়েই, জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের নীতি— বেশি পরিমাণে অস্ত্রনির্মাণ না করার ‘জড়তা’ কাটিয়ে, নতুন করে সশস্ত্রীকরণের জন্য ১০০ বিলিয়ন ইউরো (জিডিপির ২ শতাংশ) বরাদ্দ করেছে, যার অনেকটাই রাশিয়াকে আটকাতে ইউক্রেনের হাতে যাবে। চেক প্রজাতন্ত্র-সহ পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের বহু দেশের অস্ত্রের কারবারিরাও, ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে অব্যবহৃত গুদামঘরগুলি সারিয়ে আবার, ‘নেটো’র মান অনুযায়ী, কালাশনিকভ রাইফেল থেকে বিভিন্ন ক্ষমতার রকেট-লঞ্চার, গ্রেনেড, মর্টার তৈরি করে এতটাই মুনাফা করেছে যে, কারখানায় বাড়তি লোক নেওয়ার বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়েছে।
পশ্চিমে মারণাস্ত্র বানানোর এই কারবার প্রধানত চলে বেসরকারি উদ্যোগে, যাদের সঙ্গে রাষ্ট্র ও তার পরিচালকরা ঘোষিত ও অঘোষিত স্বার্থের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্রব্যবসার ঘাঁটি আমেরিকা, যার ফলে সমাজবিজ্ঞানী সি রাইট মিলস বলেছিলেন, আমেরিকায় আসল ক্ষমতা থাকে ‘শিল্প ও সামরিক জোট’-এর এলিটদের হাতেই। ঠান্ডা যুদ্ধ পেরিয়ে বহু দিন পরে এই শ্রেণির হাসি আবার চওড়া হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়ার বড় যুদ্ধে। তাই বছর পেরোনো এই যুদ্ধ কালকেই থেমে যাবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। মোদ্দা কথাটা বহু দিন আগে শুনিয়েছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির নায়ক ও পরে প্রেসিডেন্ট আইজ়েনহাওয়ার। তাঁর বিদায়ী ভাষণে (১৯৬১) বলেছিলেন, দেশের সমরাস্ত্র নির্মাণ শিল্পকে যদি যথার্থ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে বিশ্বের কোনও-না-কোনও প্রান্তে চিরদিন যুদ্ধ চলতেই থাকবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy