Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Indian Education System

‘ভাগ্যিস লেখাপড়া করিনি’

অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মুখে লেখাপড়া না করতে পারার আক্ষেপ শুনেছি বহু বার, কিন্তু এই প্রথম এক জনকে সেটাকে সৌভাগ্যের দ্যোতক বলে দাবি করতে দেখে চিন্তায় পড়লাম।

An image of Boys

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

তূর্য বাইন
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২৩ ০৪:২৬
Share: Save:

মাস কয়েক আগে উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনে আলাপ হয়েছিল ছেলেটির সঙ্গে। মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কার আশেপাশে কোনও গ্রামে বাড়ি। রাজমিস্ত্রির ঠিকাদার, ইদ উপলক্ষে কানপুর থেকে বাড়ি ফিরছিল। পড়াশোনা মাধ্যমিক পর্যন্ত। তার হাত ধরেই সেখানে এলাকার অন্তত শ’দেড়েক ছেলের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের কারও মাসিক আয় হাজার পঁচিশেকের কম না। সঙ্গের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, ওর চাচাতো ভাই, এম এ পাশ। দীর্ঘ দিন বেকার, এখন ওর অধীনে জোগাড়ের কাজে ঢুকেছে। তার পরই ওর স্বগতোক্তি, ভাগ্যিস বেশি লেখাপড়া করিনি!

অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মুখে লেখাপড়া না করতে পারার আক্ষেপ শুনেছি বহু বার, কিন্তু এই প্রথম এক জনকে সেটাকে সৌভাগ্যের দ্যোতক বলে দাবি করতে দেখে চিন্তায় পড়লাম। শিক্ষান্তে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তার কারণে ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে দেশের বিজ্ঞান, সাহিত্য কিংবা দর্শনচর্চার ভবিষ্যৎ কী হবে?

শঙ্কাটা যে অমূলক নয়, অচিরেই তা টের পাওয়া গেল। বর্তমান শিক্ষাবর্ষে এ রাজ্যের কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিগুলিতে পড়ুয়ার অভাবে বহু সিট খালি পড়ে আছে। গত ২৬ জুলাই জানা গেল, রাজ্যের কলেজগুলিতে ৫৮ শতাংশ সিট খালি। উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রে খবর, গোটা রাজ্যে ৪৫৪টি স্নাতক স্তরের কলেজের মোট আসন সংখ্যা ৯ লক্ষ ৪ হাজার ৩৭৯। তার মধ্যে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ৩ লক্ষ ৭৭ হাজার। শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলিতে ফাঁকা আসনের সংখ্যা হাজার চল্লিশেক। ফাঁকা আসনের মধ্যে সংরক্ষিত আসন প্রায় ৩০ হাজার। কলকাতার বেশ কিছু নামী কলেজে অঙ্ক, রসায়ন, পদার্থবিদ্যায় এত কম ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছেন যে, কোর্স চালানোই সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে শিক্ষা দফতর থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে যে সব কলেজে আসন শূন্য আছে, সেখানে ৩১ জুলাইয়ের পরিবর্তে ৩১ অগস্ট পর্যন্ত ছাত্র ভর্তির সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।

অনস্বীকার্য, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আসন পূর্ণ না হওয়ার এই প্রবণতা কিন্তু শুধু এ রাজ্যের সমস্যা নয়, গোটা ভারতের চিত্রটা একই রকম হতাশাব্যঞ্জক। ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ভারতে শুধুমাত্র এঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে প্রায় ৪ লক্ষ ২১ হাজার আসন শূন্য ছিল। ২০২৩ সালের ৪ অগস্ট সেন্ট্রাল সিট অ্যালোকেশন বোর্ড-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রথম রাউন্ড কাউন্সেলিং-এর পরেও ১১,২৯৫টি সিট খালি রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে এই অবস্থার পিছনে অন্যতম কারণ হল চাহিদার সঙ্গে জোগানের বৈষম্য।

রাজ্যেও হয়তো এই জোগান-চাহিদার অসাম্যের তত্ত্বটি কিছুটা প্রযোজ্য। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, ছাত্রসমাজের একাংশ উচ্চশিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে আরও কিছু কারণ। এক বর্ষীয়ান অধ্যাপকের মতে, প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় এ রাজ্যের কলেজগুলিতে অনেক বেশি সিট বাড়ানো হয়েছে। অনেকেই দুষছেন জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী অনার্স-সহ স্নাতক কোর্স তিন বছরের পরিবর্তে চার বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত করাকে। ছাত্রছাত্রীরা গতানুগতিক কোর্সে এই দীর্ঘ সময় ব্যয় করার পরিবর্তে ম্যানেজমেন্ট বা অন্য পেশা-সহায়ক কোর্সে দ্রুত পড়া শেষ করে চাকরি পেতে চাইছে।

আবার অনেকের মতে, স্নাতক বা স্নাতকোত্তরে অধিকাংশ বিষয়ের উপযুক্ত বাংলা পাঠ্যপুস্তকের অভাব এবং পাঠদানের মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ হারাচ্ছে। তবে সিংহভাগ শিক্ষাবিদের মতে, পড়াশোনার শেষে চাকরি পাওয়ার অনিশ্চয়তাই মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। শিল্পবন্ধ্যা এ রাজ্যে বেসরকারি চাকরির সুযোগ খুবই কম। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে স্কুল এবং কলেজে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষাও একেবারেই অনিয়মিত। নিয়োগের পরীক্ষার সব ক’টিতেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, অভিযোগগুলি আদালতে বিচারাধীন থাকায় নিয়োগ বিলম্বিত হয়েছে। যোগ্যকে বঞ্চিত করে ঘুষ দিয়ে বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অযোগ্যদের চাকরি পাইয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ রাজ্যে শিক্ষিত যুবসমাজের সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় ভরসার জায়গা ছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশন। কিন্তু রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে এখন সস্তায় চুক্তিভিত্তিক কর্মীর মাধ্যমে কাজ চলে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলি অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। সরকারি কর্মী নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিরুদ্ধেও একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ। এমনকি ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষাতেও কারচুপির একাধিক অভিযোগ, যা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে মেধা কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনও ভূমিকা নেই, এই এখন জনগণের ধারণা।

এই চরম নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র স্কলারশিপের নামে কিছু আর্থিক সাহায্য কিংবা ঋণ পাওয়ার প্রলোভনে ছাত্রসমাজকে উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এই সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেতে হলে উচ্চশিক্ষায় সংস্কারের পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে নিয়োগব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা আশু প্রয়োজন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy