—ফাইল চিত্র।
কচুরিপানাকে সবাই জঞ্জাল ভাবে, কিন্তু জিনিসটা আগাগোড়াই কাজের। আগা খায় গরুতে, আর শিকড় পচিয়ে সার হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার টোনা মৌজার একটি জৈব খামারে দেখা গেল, কুড়ি-পঁচিশটা দিশি গরু খচমচ করে চকচকে সবুজ পাতা চিবোচ্ছে। তাদের গোবর, আর কচুরিপানার শিকড় জড়ো করে রাখা রয়েছে। ওগুলো যাবে জমিতে। শস্যের বর্জ্য (তুষ, খড়) যায় হাঁস-মুরগির খাদ্যে। হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা হয় মাছের খাদ্য। কিছুটি নষ্ট হয় না এই অনন্ত পুষ্টিচক্রে। খামারে তৈরি হয় ছানা, ঘি, মাছ, মাংস, শস্য, ফল, আচার-জেলি, পশুখাদ্য, ভেষজ ওষুধ-সহ আড়াইশো রকমের পণ্য। খাঁটি জৈব ফসল।
সম্প্রতি ভারত থেকে রফতানি করা মশলা সিঙ্গাপুর, হংকং খারিজ করতে হইচই পড়ল। ভারতের আনাজ, ফল, চিংড়ি প্রায়ই ফেরত পাঠায় ইউরোপ, আমেরিকা। পরীক্ষায় নাকি অতিরিক্ত রাসায়নিক, অ্যান্টিবায়োটিক মেলে। আমাদের বাজারে তেমন পাহারাদার কই? স্বাস্থ্যের আশায় হয়তো শসা-লেটুস চিবোচ্ছেন, এ দিকে শরীরে ঢুকছে নিষিদ্ধ কীটনাশকের মারাত্মক বিষ। চাষিও ফতুর রাসায়নিক সার কিনতে কিনতে। অতিরিক্ত ইউরিয়ায় আঁট, অনুর্বর হচ্ছে মাটি।
এ সবই জানা কথা, কিন্তু খাদ্যরসিক বাঙালির জীবনচর্যায় কথাগুলো এলেবেলে। নিরাপদ খাদ্য আর সুস্থায়ী চাষের জায়গা সেমিনার আর রিসার্চ পেপার। সব রাজ্য অবশ্য এমন নয়। সিকিম একশো শতাংশ জৈব চাষ করছে। অন্ধ্রপ্রদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে রাসায়নিক-মুক্ত চাষে পৌঁছনোর নীতি নিয়েছে, সে রাজ্যে ছ’লক্ষেরও বেশি চাষি প্রাকৃতিক উপকরণে চাষ করছেন। কর্নাটক দশ শতাংশ জমিতে জৈব চাষের লক্ষ্য নিয়েছে। উত্তরাখণ্ড তার দশটি ব্লককে ‘জৈব’ বলে ঘোষণা করেছে।
আর পশ্চিমবঙ্গ? এ রাজ্যে জৈব চাষের ইতিহাস দীর্ঘ, কিন্তু তা প্রধানত অসরকারি উদ্যোগের ইতিহাস। কর্পোরেটদের লাভ-সর্বস্ব সংস্কৃতি, আর ফড়ে-মহাজনের খপ্পর থেকে কৃষি, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যকে উদ্ধার করতে দু’দশক আগে এগিয়ে এসেছিলেন অর্ধেন্দুশেখর চট্টোপাধ্যায়, উদয়ভানু রায়ের মতো বিজ্ঞানমনস্ক জনসংগঠকরা। এনজিও, কিংবা বেসরকারি সংস্থা তৈরি করে তাঁরা দিশি বীজে, কম জলে, চাষির আয়ত্ত বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। অনেক চাষি নিজেদের উদ্যোগেও জৈব চাষ করছেন। উৎসাহী আধিকারিকরা সাহায্য করছেন তাঁদের।
জৈব ফসলের স্বাদ আর স্বাস্থ্যগুণ, দুই-ই ভাল, তা গৃহস্থও বোঝেন। কিন্তু শপিং মলে দুটো জবা ফুলের মতো ফুলকপির দাম এক কেজি মুরগির সমান। এক জৈব চাষি জানালেন, সুপারমার্কেট তাঁকে ধানের যে দাম দেয়, ক্রেতাকে তার আড়াই গুণ দামে বিক্রি করে, মাশরুম তিন গুণ দামে। তুলনায় সাশ্রয়ী বিপণনের মডেল জৈব হাট, তবে এ রাজ্যে সেগুলোর সংখ্যা হাতে-গোনা। তুলনায় লাভজনক ‘হোম ডেলিভারি’— খেত থেকে গৃহস্থের ঘরে খাদ্য সরাসরি এলে সত্তর-আশি শতাংশ লাভ থাকে চাষির। কিন্তু এ ব্যবস্থা প্রধানত বৃহত্তর কলকাতাতেই কাজ করে।
তবে কি জৈব ফসল বিলাসিতা? ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ যদি নীতি হয়, তা হলে সকলকে সুলভে নিরাপদ খাদ্য জোগাতে হবে। অথচ, জৈব চাষ হয় কতটুকুই বা? ‘সিন্ধুতে বিন্দু’ বলতেও লজ্জা করে। ২০২২-২৩ সালের আর্থিক সমীক্ষা বলছে, জৈব ফসলের চাষ হচ্ছে ৫৯ লক্ষ হেক্টর জমিতে, যা দেশের মোট কৃষিজমির মাত্র চার শতাংশ। এ রাজ্যে কৃষকবন্ধু ভাতা পাচ্ছেন এক কোটিরও বেশি চাষি, তাঁদের মধ্যে জৈব চাষি কুড়িয়ে-বাড়িয়ে কুড়ি হাজার হতে পারে। জৈব চাষ প্রসারের কোনও লক্ষ্যমাত্রা নেয়নি পশ্চিমবঙ্গ।
বরং সরকারি পাল্লা যেন ঝুঁকে বিপরীতে। কেন্দ্রীয় সরকার এ বছর বাজেটে দেড় লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ করেছে রাসায়নিক সারে ভর্তুকির জন্য। জৈব চাষের উপকরণ জোগানের জন্য বরাদ্দ সে তুলনায় ছিটেফোঁটা। সে টাকাও ধার্য রয়েছে খাতায়-কলমে, রাজ্যগুলো না চাইলে মিলবে না। পশ্চিমবঙ্গ সে টাকার জন্য দরবার করবে, তার সম্ভাবনা কতটুকু? এ রাজ্যে কৃষি প্রযুক্তি সহায়কের পদ শূন্য থাকছে। সারের ডিলারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তাঁরাই চাষিদের কৃষির পরামর্শ দেন। কী পরামর্শ তাঁরা দেবেন, সহজেই অনুমেয়। এখন চাষিদের নিজস্ব কোম্পানিগুলিকেও (ফার্মার্স প্রোডিউসার্স কোম্পানি) সারের ডিলারশিপ দিচ্ছে সরকার। এ সবই বস্তুত রাসায়নিক চাষকে উৎসাহ দেয়। কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার মুখে পরিবেশ সুরক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বলছে, সরকারি প্রকল্প আর বাজেট বরাদ্দ বলছে অন্য কথা।
এটা হতাশাজনক, তবে এখনও এই অনাস্থাই বৃহৎ চিত্র। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৩০ সালের মধ্যে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার অর্ধেক করার উদ্দেশ্যে আইন পাশ করতে চেয়েছিল গত বছর। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে সেই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বেশি ভোট পড়ে। এই ফলকে বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থার স্বার্থের কাছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের পরাজয় বলে দেখছেন অনেকে। ভারতেও জৈব চাষ নিয়ে অনেক সংশয়। জৈব চাষে উৎপাদন কি কমবে? খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে? যত গোবর চাই, তত গরু কই? চাষ লাভজনক হবে কী করে?
উদয়ভানু রায় ও তাঁর সহযোগীদের তৈরি টোনার জৈব খামার, যাকে রাজ্য সরকার ‘মডেল’ মনে করছে, তা একটি লাভজনক বেসরকারি সংস্থা হিসাবে কাজ করছে ২০০৪ সাল থেকে। এখানে ৪২ জন চাষি পূর্ণ সময়ে নিযুক্ত, পিএফ-সহ মাসিক বেতন পান। শেয়ার হোল্ডাররা বছরে অন্তত বারো শতাংশ লাভ পাচ্ছেন। এটা সম্ভব হচ্ছে চাষের সব উপকরণ তৈরি থেকে প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন— এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি চাষিদের অধীনে থাকার জন্য। উদয়ভানুবাবুর মতে, রাজ্যের প্রতিটি ব্লকে জৈব চাষের উপযোগী প্রাণিসম্পদ যথেষ্ট রয়েছে। জৈব চাষে অপচয় কমবে, উৎপাদক ও ক্রেতার মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি না থাকায় লাভ থাকবে চাষির, তৈরি হবে আস্থার সম্পর্ক।
চিন্তা করলে স্পষ্ট হয়, প্রশ্নটা শেষ অবধি প্রযুক্তি-প্রকৌশলের নয়, আদর্শের। ব্যক্তির সঙ্গে সমাজ, আর সমাজের সঙ্গে পরিবেশের যে সংযোগ, গান্ধীবাদী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এলা ভট্ট তাকে বলেছিলেন ‘অনুবন্ধ’। মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে তার ভোগ্যবস্তুর, আর সেই দুইয়ের সঙ্গে পরিবেশের যে নিরবচ্ছিন্ন চক্র, তার মধ্যে ব্যক্তির অবস্থান কোথায়, সে সম্পর্কে সচেতন হওয়াই এর মূল কথা। এলার মতে, ‘অনুবন্ধ’ কার্যকর করার উপায়— যেখানে বাস, তার ১০০ মাইলের মধ্যে মানুষকে নিয়ে এমন এক ‘কমিউনিটি’ তৈরি করা যায় যাতে দৈনন্দিন প্রয়োজনের জোগান দিব্যি হয়ে যায়। বিদেশেও পরিবেশ ও স্বাস্থ্য আন্দোলন স্থানীয় কৃষি উৎপাদন ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেয়।
পরিবেশ-বান্ধব, স্বাস্থ্য-বান্ধব চাষের আসল চ্যালেঞ্জটি সম্ভবত এই বিকল্প সমাজ-বন্ধনের ধারণাতেই। জৈব চাষের চারটে প্রকল্প খাড়া করে গরুর হস্টেল তৈরি করা যায়, চাষি কোম্পানিকে তেল-ঘি, জ্যাম-জেলি বানানোর ট্রেনিং দেওয়া যায়, হিমায়িত গাড়িও বিলি করা যায়। কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতির রাশ যেখানে মধ্যস্বত্বভোগীর হাতে, যেখানে রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে চায় মানুষে-মানুষে সংযোগের একমাত্র সেতু, সেখানে দরিদ্রের স্বায়ত্ত, স্বনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা তৈরি করতে চাই অন্য এক রাজনীতি। সুস্থ মাটি, সুস্থ মানুষ সেই বিকল্প রাজনীতির ফসল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy