বিপর্যয়: ১৬৬৫ সালে লন্ডনে ‘দ্য গ্রেট প্লেগ’-এর সময়ের ছবি। সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স
কোভিড-১৯’এর সঙ্গে আমাদের বসবাসের প্রায় দু’টি বছর অতিক্রান্ত। করোনার দাপটে বিশ্ব জুড়ে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে ঘটে গেছে ওলটপালট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আমরা অনেকেই গত দু’বছর যাবৎ সেমিনারের বদলে ওয়েবিনারে অভ্যস্ত হয়েছি। শিক্ষকসমাজ আর ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষে না থেকেও লেখাপড়ায় অংশ নিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে নানা বিষয়ের মতো শিক্ষার ভবিষ্যৎ কী, সেই অজানা অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় আক্রান্ত সবাই। শ্রেণিকক্ষে ফেরার পথ তৈরি হলেও ‘ডিজিটাল ডিভাইড’-এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এই ভাইরাস দৈনন্দিন জীবনকেও প্রভাবিত করেছে। কী ভাবে স্পর্শ করব, (বা করব না), সামাজিক ব্যবহার কেমন হবে— সব কিছু কত বদলে গিয়েছে! প্রশ্ন করা যায় যে, এমনটা কি এই প্রথম হল? রোগজীবাণুর আক্রমণে এ রকম বিরাট পরিবর্তন কি অতীতে কখনও ঘটেছিল? কোভিড-১৯’এর প্রাথমিক ধাক্কার সময় গত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি বা স্প্যানিশ ফ্লুয়ের চর্চা হচ্ছিল। রোগ প্রতিরোধের কিছু পন্থার সাদৃশ্য সবাইকে চমৎকৃত করত। সেই মাস্ক-এর ব্যবহার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, থিয়েটার বন্ধ এই সব! উনিশ শতকের শুরু থেকে কলেরা অতিমারির সময়ে এবং আরও পিছিয়ে গেলে জানা যায় কোয়রান্টিন কী ভাবে সংক্রমণের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করেছে। এ তো গেল কিছু বাহ্যিক মিলের কথা যাকে চট করে চিহ্নিত করা যায়। আর একটু গভীর ভাবে অতীত নিয়ে ভাবলে বোঝা যায়, চোখে দেখা যায় না এমন আণুবীক্ষণিক মাইক্রোব কী ভাবে মানুষের ইতিহাসের নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে উঠেছিল বার বার। ইতিহাসের পরিবর্তনে অতিমারি কী ভাবে কাজ করেছে, তা ভাবলে এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’ রক্তের ভিতরে অবিরাম খেলা করে!
প্রসিদ্ধ গ্রিক ইতিহাসবিদ থুকিডিডিস তাঁর দ্য হিস্ট্রি অব দ্য পেলোপনেশিয়ান ওয়ার-এ ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আথেন্সের ভয়াবহ প্লেগের বর্ণনা দিয়েছেন। কী ভাবে প্লেগ উত্তর আফ্রিকা থেকে আথেন্সে বিস্তার লাভ করল, তার সঙ্গে ডাক্তারদের লড়াই এবং ডাক্তারদের মধ্যে মৃত্যুর ব্যাপকতা (করোনার কথা মনে করিয়ে দেয় না কি?)— এ সবের অসাধারণ বিবরণ দিয়েছেন থুকিডিডিস।
পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দের প্লেগ ইউরোপের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল। পঞ্চম শতকের শেষের দিকে পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের ‘পতন’ হলেও পূর্ব দিকের বাইজ়ান্টাইন সাম্রাজ্য টিকেছিল আরও কিছু সময়। ৫২৭ থেকে ৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাইজ়ান্টাইন সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন প্রবল পরাক্রমশালী প্রথম জাস্টিনিয়ান। তাঁর শাসন সংস্কার, আইনব্যবস্থাকে সাজানোর জন্য কোড জাস্টিনিয়ানের প্রবর্তন ইত্যাদি ইতিহাস মনে রেখেছে। তাঁর সময়ে উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন জুড়ে বাইজ়ান্টাইন সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল। ৫৪২ খ্রিস্টাব্দের আগে জাস্টিনিয়ানের সৈন্যবাহিনী পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের বেশ কিছু অংশ বিভিন্ন জার্মান জনজাতির হাত থেকে পুরোপুরি উদ্ধার করেছিল। রোম সাম্রাজ্যের সুবর্ণযুগের পুনরুত্থানের সম্ভাবনাও যেন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ৫৪২ সাল থেকে সব পাল্টাতে শুরু করল। প্লেগের বাহক ইঁদুরেরা বাইরে থেকে আমদানি শস্যের সঙ্গে রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করে এই সোনালি স্বপ্নের অবসান ঘটাল। প্লেগ এক পুরনো দুনিয়াকে ধ্বংস করে নতুন জগতের সূত্রপাত করল। মধ্য এশিয়া, ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে অতিমারির চেহারা গ্রহণকারী প্লেগ ধনী, শক্তিশালী বা দরিদ্র কাউকে রেহাই দেয়নি! গ্রামের পর গ্রামের মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে প্রতি দিন পাঁচ থেকে দশ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছিল। জাস্টিনিয়ান স্বয়ং আক্রান্ত হলেও প্রাণে বেঁচে যান।
পরের প্রায় দু’শো বছর জুড়ে মাঝে মাঝেই প্লেগের আবির্ভাব। মারণরোগে জনসংখ্যা হ্রাসের পরিণতি হল খাদ্য সঙ্কট ও দুর্ভিক্ষ। বাইজ়ান্টাইন সাম্রাজ্যের শক্তিক্ষয়ে এবং ইউরোপের ইতিহাসে ধ্রুপদী যুগের অবসান ও পরবর্তী যুগের সূত্রপাতে বিরাট ভূমিকা ছিল অতিমারির।
এর পরেও প্লেগের আরও বিধ্বংসী ভূমিকা অপেক্ষা করছিল। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত প্লেগের ভয়াবহ তাণ্ডব দুনিয়াকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল।
১৩৪৭-এর শরতের সুন্দর এক দিনে সিসিলির বন্দরে প্রবেশকারী বারোটি জাহাজের নৌবহর দেখে মানুষ শিউরে উঠলেন। জাহাজভর্তি মৃতদেহের স্তূপ! যে ক’জন বেঁচে তাঁরাও রক্তক্ষরণে মৃতপ্রায়। মানুষের সঙ্গে জাহাজে বাহিত হয়ে এসেছিল প্লেগের জীবাণুবহনকারী ইঁদুর বাহিনী। এ ভাবেই ইউরোপে ব্ল্যাক ডেথ-এর আগমন, যার মরণকামড়ে পৃথিবীর বিরাট অঞ্চল জুড়ে তৈরি হয়েছিল মৃত্যু উপত্যকা। ইউরোপের কৃষিনির্ভর সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়ায় এই ব্যাধি বেশ বড়সড় ভূমিকা নিয়েছিল। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে ইউরোপের যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, তাঁদের বেশির ভাগই সমাজের প্রান্তিক মানুষ বা ভূমিদাস। তাঁদেরই শোষণের উপরে দাঁড়িয়ে ছিল সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি। জনসংখ্যার হ্রাসের ফলে দেখা দিল শ্রমের জোগানের সমস্যা। ভূস্বামীরা প্রমাদ গুনলেন যখন দেখলেন, যে ভূমিদাসরা মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করছিলেন এত দিন, কাজের শর্ত নিয়ে তাঁরা দর কষাকষির সুবিধে ও জোর পাচ্ছেন! সে যুগের শেষ প্রান্তে সামন্ততান্ত্রিক আর্থসামাজিক ক্ষমতার কাঠামোর বিন্যাসকে প্লেগ এ ভাবেই বিপর্যস্ত করেছিল ও তার অবসানকে প্রায় সুনিশ্চিত করতে সাহায্য করেছিল— এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে।
স্মল পক্সের ইতিহাসও কম চমকপ্রদ নয়। ষোড়শ শতাব্দী থেকে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল এই রোগ।
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পরে ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে নতুন বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই শুরু হল। এই আগ্রাসী যুদ্ধ জেতায় সাম্রাজ্যবাদীদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল নিঃশব্দ ঘাতক মারাত্মক রোগজীবাণু। এর সাহায্যে অতিমারি ও মহামারির বিস্তার ঘটিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পরাভূত করেছিল নতুন বিশ্বের বাসিন্দাদের। আজকের পরিভাষায় বলা চলে ‘বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’! ১৫১৯ সালে স্পেনের আবিষ্কারক ও বিজেতা হার্নান কর্টেজ়ের নেতৃত্বে পাঁচ-ছ’শো জনের নৌবহর মেক্সিকোতে প্রবেশ করে। সেখানে অ্যাজ়টেক সাম্রাজ্যের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী আর বিপুল জনবল ছিল। অথচ সহজেই ও অল্প সময়েই স্পেনের বিজেতারা মেক্সিকো এবং উত্তর আমেরিকা মহাদেশের উপরে আধিপত্য বিস্তার করে। এর জন্য কিন্তু বিরাট সামরিক সংঘর্ষের প্রয়োজন হয়নি, জয় এসেছিল প্রধানত মারণরোগের হাত ধরে। স্পেন থেকে আগত সৈন্যবাহিনীর জনৈক সদস্যের শরীরে বাহিত হয়ে ‘ওল্ড ওয়ার্ল্ড’-এর গুটিবসন্তের জীবাণু প্রবেশ করেছিল ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’-এ। সেখানে মানুষের শরীরে ওই অচেনা রোগকে প্রতিরোধের ক্ষমতা ছিল না! মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দাবানলের মতো সংক্রমণ ছড়াল এবং মেক্সিকোর এক-চতুর্থাংশ অধিবাসীর মৃত্যু হল। স্পেনের রাজা প্রথম চার্লসের কাছে ‘আনন্দসংবাদ’ গেল, ইন্ডিয়ানদের নিকেশ করার জন্য দয়ালু ঈশ্বর মহামারি পাঠিয়েছেন!
ষোড়শ শতাব্দীতে পেরু আর ইনকা সাম্রাজ্য ও সভ্যতার পতনেরও অন্যতম কারণ ছিল ভয়াবহ গুটিবসন্তের আক্রমণ। অষ্টাদশ শতাব্দীতেও প্রধানত গুটিবসন্তের বিস্তারের ফলে উত্তর আমেরিকার উপরে ইউরোপের আধিপত্য বিস্তারও সহজ হয়েছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৭৭০-এর দশকে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা জনজাতিদের দমনের জন্যে ইচ্ছাকৃত গুটিবসন্তের সংক্রমণ ঘটিয়েছিল। শোনা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রিটিশ সৈন্যরা গুটিবসন্তের রোগীদের ব্যবহৃত কম্বল বিতরণ করেছিল আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের মধ্যে! রোগাক্রান্ত জনজাতিদের পঞ্চাশ শতাংশ মৃত্যুবরণ করে। খালি চোখে দেখা যায় না যাকে, ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার তার কী অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা! সত্যি, কোভিড-১৯ পরবর্তী দুনিয়াও তো এক রকম আর থাকবে না!
কী ভাবে বার বার সাম্রাজ্যের পতন, সমাজ বা অর্থনীতির গতি পরিবর্তন বা সাম্রাজ্যবাদের উত্থানে রোগের জীবাণু নির্ধারক উপাদান হয়ে উঠেছে— ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। বলা চলে যে মানুষের ইতিহাস শুধু মানুষের দ্বারা লেখা হয়নি, জীবাণুও এর ভাগীদার! ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজ স্বচক্ষে যা দেখছি, তাতে আমাদেরও কি সেই উপলব্ধি হচ্ছে না? ভবিষ্যতে যখন অতীতের দিকে ফিরে তাকানো হবে, প্রাক্-করোনা এবং করোনা-পরবর্তী দুনিয়াকে দুই স্বতন্ত্র যুগ বলে চিহ্নিত করেই হয়তো ইতিহাসের বিশ্লেষণ করা হবে।
ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy