এই মাসেই ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই মওকায় চটপটে জ্বলন্ত বিষয়গুলির একটা হিসাব নেওয়া যাক।
সে ছিল বড় সুখের দিন। উনিশ শতক। ফ্রান্সের রেল ইঞ্জিন সিটি বাজিয়ে ছুটে চলত দূরদূরান্তের ভুবন কাঁপিয়ে। সে ছিল এক অন্য ভুবনায়ন— ঔপনিবেশিক। আধুনিকতার রাজধানী প্যারিস। মেলায় ফরাসি প্রযুক্তির প্রদর্শনী দেখতে ভিড় জমাতেন দেশ-বিদেশের মানুষ। ১৮৬০-এ ইংল্যান্ডের হাত ধরে ফ্রান্সে এল মুক্ত-দুয়ার অর্থনীতি। ফ্লবেয়ার তাঁর আহাম্মকের অভিধান-এ লিখলেন ‘আমাদের সমস্ত খারাপ জিনিসের কারণ’। এর পর ১৮৬৯— ফ্রান্সের রানির সবুজ সঙ্কেতে মিশরের পোর্ট সইদ থেকে বাণিজ্যিক নৌবহর সুয়েজ় ক্যানাল হয়ে পাড়ি জমাল এশিয়ার বৃহৎ বাজারের উদ্দেশে। এই প্রথম ভুবনায়নের বৈশিষ্ট্য ছিল, কাঁচামালের বিনিময়ে উপনিবেশগুলিতে ইউরোপে প্রস্তুত পণ্যের জোগান।
১৯৬২-তে প্রযুক্তিনির্ভর উচ্চফলনশীল কৃষির উদ্বৃত্ত ক্রেতার হাতে পৌঁছে দিতে সীমান্তের বেড়া ভেঙে দেওয়া হল। সারা ইউরোপ জুড়ে তৈরি হল কৃষিপণ্যের খোলা বাজার। ঊর্ধ্বমুখী পেট্রো-মূল্যের ধাক্কায় ধরাশায়ী ফ্রান্স আঁকড়ে ধরল এক নব্য ভুবনায়ন। মুক্ত বাজারনীতি তার ভরকেন্দ্র। দ্বিতীয় পর্যায়ের এই ভুবনায়নে ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে কাঁচামালের সঙ্গে শিল্পপণ্য বিনিময় চলল।
১৯৮২ থেকে ফ্রান্সের তখ্তে সমাজবাদী ফ্রঁাসোয়া মিতেরঁ। তাঁর আমলেই প্রথম আধুনিকীকরণ হল ফ্রান্সের অর্থনীতির, সুসংগঠিত হল বিশ্বায়িত আর্থিক বাজার। ১৯৮৯-এ বার্লিন প্রাচীরের পতন। পূর্ব ইউরোপ, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলির মতো মার্ক্সবাদের সাবেক দুর্গে মিশেল ফুকোর মরণোত্তর গ্রন্থ যৌনতার ইতিহাস সিংহাসনচ্যুত করল দাস ক্যাপিটাল-কে। কোনও সর্বজনীন লক্ষ্যস্থলের বালাই নেই, আছে শুধু মারাত্মক স্থিতিস্থাপকতা। অনেকটা হাতিয়ারের মতো ফুকোর এই ‘টুলবক্স’। মহা-আখ্যানের ‘গ্লাসনস্ত’ কি বলা যায় একে? বা, খুদে-আখ্যানের বিশ্বায়ন? তৃতীয় এই বিশ্বায়নে আর পণ্যের আমদানি বা জোগান নয়, বিশ্বের কোণে-কোণে সতীদেহের মতো খণ্ড-খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ল উৎপাদন প্রক্রিয়ার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সারা বিশ্ব থেকে যন্ত্রাংশ জড়ো করে বানানো হল পুতুল, ফোন, এরোপ্লেন। এই উৎপাদন-প্রক্রিয়া ভর হল তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর।
প্রায় দু’শো বছর ধরে যে চিত্রনাট্য তিলে-তিলে লেখা হচ্ছিল, তা যেন অন্তিম ক্লাইম্যাক্সে এসে পৌঁছল এ বার। ১৯৯২-তে হল্যান্ডের মাস্ট্রিচ-এ যে চুক্তিপত্রে সিলমোহর পড়ল, জন্ম নিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাস্তবায়িত হল ক্ষুদ্র মুদ্রার রূপ ধরে। ২০০২-এ ছড়িয়ে পড়ল ক্রেতার পকেটে-পকেটে। বিশ্বায়ন কি আসলে ক্ষুদ্রায়ন?
এই বিশ্বায়ন বা ইউরোপায়নে জনসাধারণ কতখানি উপকৃত হলেন? বহু সংস্থা পাট গুটিয়ে পালাল সস্তা শ্রমের দেশে। ‘বি-শিল্পায়ন’-এর ফলে শ্রমনিবিড় শিল্পগুলি উন্নত প্রযুক্তির দৌলতে পুঁজিনিবিড় হয়ে উঠল। বিশ্বায়ন নিয়ে প্রাথমিক উচ্ছ্বাস পর্যবসিত হল গভীর অবসাদে। খণ্ডিত উৎপাদন প্রক্রিয়ার তালে তাল মেলাল খণ্ডিত শ্রম, খণ্ডিত জীবিকা-জীবন।
কর্মচ্যুতির ট্র্যাজেডি নাটক দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এ দিকে কর্মসংস্থান ঘটে দৃষ্টির আড়ালে। ২০০১ থেকে ২০০৭, শুধু উৎপাদন ক্ষেত্রেই ফ্রান্সে কাজ হারিয়েছেন ৮৮ হাজার মানুষ। কিন্তু শুধু ২০১৯ সালেই কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষ। দেখা গিয়েছে, ঠিক বিশ্বায়ন নয়, সমস্যার গোড়ায় রয়েছে প্রযুক্তির অগ্রগতি। ভুলব না, শ্রমিক শ্রেণির দুর্দশা শুরু হয়েছিল ১৯৮০-র দশকেই। চিন থেকে আমদানি বৃদ্ধির কারণে ১৯৯৫ থেকে ২০০৭-এ কর্মচ্যুত হন এক লক্ষ মানুষ, কিন্তু এই কালখণ্ডে পরিবার প্রতি বার্ষিক রোজগার বেড়েছিলও বটে।
বিশ্বায়নের বাজারে চিন বা এশিয়া থেকে আমদানি ১৫%-এর অধিক নয়। ফ্রান্সের আমদানির প্রধান উৎস ইউরোপীয় দেশগুলো (৬০%)। তাই শিল্পোদ্যোগ বাড়ানো চাই, তার জন্য নানা ছাড়, সস্তা শ্রমের জোগান চাই। গত এক দশকে তুরস্ক বা সিরিয়ার অভিবাসীদের দৌলতে ছোট উদ্যোগের ঢল নেমেছে জার্মানিতে। শ্বেতাঙ্গদের থেকে এঁরা অনেক বেশি পরিশ্রমী, সাহসী। তা ছাড়া, এই অভিবাসনের ফলে বার্ধক্যপীড়িত ইউরোপীয় জনসমাজে তারুণ্যের সঞ্চার ঘটেছে। এখন ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের স্বাগত জানাচ্ছেন পোল্যান্ডের নিয়োগকর্তারাও। শূন্য জায়গা ভরাট হচ্ছে।
অর্থাৎ দক্ষিণ, বিশেষত অতি-দক্ষিণপন্থীরা অভিবাসীদের নিয়ে যে গেল-গেল রব তোলেন, তা চূড়ান্ত মিথ্যাচার। বিশ্বায়নের বলি যাঁরা, তাঁরা অতি সহজেই প্রভাবিত হন এ সব গল্পে, এবং বর্ণবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এল মুউব মুউদ তাঁর বই ফ্রান্সে অভিবাসন-এ আসল চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ফ্রান্সে অভিবাসনের হার প্রথম বিশ্বের মধ্যে নিম্নতম। যাঁরা অভিবাসন করছেন, তাঁরা কিছুটা সাংস্কৃতিক ও আর্থিক পুঁজি সঙ্গে নিয়েই দেশে এসেছেন। কেতাবি শিক্ষায় এঁরা গড়পড়তা ফরাসির থেকে এগিয়ে। অতএব, জার্মানির মতো ফ্রান্সকেও অভিবাসনের লাভের গুড় ঘরে তুলতে হবে।
তার জন্য পেশাগত অভিবাসনের নিয়ম আরও শিথিল করতে হবে। অর্থ বরাদ্দ করতে হবে অভিবাসীদের জন্য পরিকাঠামো নির্মাণে। কর্মসংস্থান আরও বাড়বে, অতিমারিতে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অভিবাসীরা সব থেকে বেশি সংখ্যায় গৃহকর্মের সঙ্গে যুক্ত (মোট কর্মীর ৪০%), পুলিশ বা নিরাপত্তাক্ষেত্র (২৮%) এবং নির্মাণক্ষেত্র (২৭%), তার পর রেস্তরাঁ ও হোটেল ব্যবসা (১৭%)। মুশকিল হল, অভিবাসীদের প্রতি সন্দেহ ও বিদ্বেষ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া এত কঠোর করা হয়েছে যে, তাতেই বাতিল হয়ে যাচ্ছেন ৩০% ‘অ-ফরাসি’ কর্মপ্রার্থী। অথচ শ্রমিক আমদানির প্রয়োজন এতটাই যে, অতিমারির সময় গোলায় ফসল তোলার জন্য টিউনিসিয়া ও কর্সিকার মধ্যে বিশেষ উড়ানের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল ফ্রান্সকে।
মুশকিল হল, ফ্রান্সে বেকারদের জন্য সরকার অনুদান দেয় নিয়োগকর্তার মাধ্যমে। অর্থাৎ, কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি কোনও কর্মহীনকে কাজে নিযুক্ত করে, তবে বেতনের একটা অংশ সরকার বহন করে। এই অনুদান হয়তো জনগণের অর্থের অপচয়। বদলে, এই অর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়িত হলে সর্বজনীন মঙ্গল হত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy