যুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে। এটাও জানা যে, শত্রু প্রবল শক্তিধর। কিন্তু, সামনে দাঁড়িয়ে মূলত যার উল্টো লড়াই করার কথা, তারই বিশেষ হেলদোল নেই— এমন ছবিই যেন উঠে এল জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সদ্যপ্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক রিপোর্ট থেকে।
আইপিসিসি-র সতর্কবার্তা: এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণগুলিকে সামলাতে না পারলে চলতি দশক ও ত্রিশের দশকে পৃথিবী গভীর সঙ্কটে পড়তে চলেছে। রিপোর্ট আরও জানাচ্ছে যে, আগামী দিনে জলবায়ু বিপর্যয় সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দেবে শহরগুলিতে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়, যার মধ্যে রয়েছে কলকাতা-সহ একাধিক ভারতীয় শহর।
নতুন রিপোর্টটি আসলে নতুন কিছু নয়। ২০০৯ সাল থেকেই একের পর এক বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন জানিয়েছে, কী ভাবে পৃথিবী ক্রমেই স্বখাতসলিলে ডুবতে চলেছে। সময়ের সঙ্গে প্রতিবেদনগুলির ভাষা তীব্রতর হয়েছে মাত্র। যেমন গত অগস্টের রিপোর্টকে আইপিসিসি ‘লাল সঙ্কেত’ বললেও সাম্প্রতিক রিপোর্টকে ‘ভয়ঙ্কর সতর্কবার্তা’ বলে সাবধান করেছে। বিশ্ব জুড়ে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও তার ফলে উষ্ণতা ক্রমেই বাড়ছে; সমুদ্রের জল ক্রমেই ফুঁসে উঠছে; বাড়ছে সাইক্লোন, বন্যা; এবং এমন নানা বিপদের কারণে ক্রমেই বাড়ছে জমি, জীবিকা ও ঘর হারানো মানুষের সংখ্যা। অথচ বিশ্বের তাবড় নেতারা এই প্রসঙ্গে নীরব।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, প্রাক্-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ইতিমধ্যেই প্রায় ১.১ ডিগ্রি গড় তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে, এবং হয়তো ত্রিশের দশকেই তা ১.৫ ডিগ্রি ছাড়াবে; ২০৪০ সালের মধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন বিপন্ন অঞ্চলকে— যার মধ্যে অবশ্যই সুন্দরবন, কলকাতা-সহ রাজ্যের একটা বড় অংশ পড়ছে— হয়তো একই সঙ্গে একাধিক জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত সমস্যার ধাক্কা সামলাতে হবে, যেমনটা হয়েছিল আয়লা বা ইয়াস ঝড়ের ক্ষেত্রে, যখন তীব্র সাইক্লোনের সঙ্গে প্রচণ্ড বন্যার যুগলবন্দি সুন্দরবনকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল; প্রকৃতির তাণ্ডবের কাছে হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য হয়েছিল কলকাতাও। মনে রাখা প্রয়োজন, তীব্র জলবায়ু সঙ্কটে যাঁরা পড়তে চলেছেন, তাঁদের বড় অংশই গরিব— এমন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই।
রিপোর্ট জানাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু যুদ্ধে সবচেয়ে বিপন্ন হতে চলেছে সমুদ্রের ধারে বা কাছাকাছি অবস্থিত শহরগুলি। মুম্বই, চেন্নাই, ভুবনেশ্বরের মতো শহরের সঙ্গে কলকাতাও বিপন্ন শহরগুলির মধ্যে সামনের সারিতে রয়েছে। রিপোর্টে মোট এগারো বার কলকাতার কথা বলা আছে। বলা আছে জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষ করে স্থানীয় উষ্ণায়ন কমাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গাছের সংখ্যা আমপান ঝড়ের কারণে শহরে অনেকটাই কমে গেছে। রিপোর্ট জানাচ্ছে, বিপর্যয় থেকে মৃত্যুর আশঙ্কা পৃথিবীর যে আটটি বড় শহরে সবচেয়ে বেশি, তাদের অন্যতম হল কলকাতা— দেশের মধ্যে একমাত্র। জানাচ্ছে, পৃথিবীর যে শহরগুলিতে তীব্র খরার সম্ভাবনা প্রবল তারও অন্যতম কলকাতা— একই সঙ্গে বন্যা ও ঝড়ের ফলে জলোচ্ছ্বাসের তালিকাতেও কলকাতা উপরের সারিতে। পাশাপাশি রিপোর্ট জানাচ্ছে, জলবায়ু যুদ্ধে টক্কর দেওয়ার জন্য শহরের কাছে এখনও তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই।
আমরা ঢাল তরোয়াল ছাড়া নিধিরাম সর্দার হব, না কি জলবায়ু যুদ্ধে সৈনিক? ‘আমরা’ মানে শহরে যারা থাকি, যারা শহরকে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে নিয়েছি, সবাই— কিন্তু অবশ্যই প্রধান দায়িত্ব রাজ্য সরকারের, বিশেষ করে কলকাতা পুরসভার। দ্বিতীয় বার কলকাতা শহরের দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমান মহানাগরিক বার বার পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন। প্রয়োজন এখনই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনার, এবং তার পর যত দ্রুত সম্ভব শহরের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে জড়িয়ে নিয়ে সে পরিকল্পনা রূপায়ণের; ঠিক যেমন যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে কোভিডের সঙ্গে লড়াই চলেছে বা চলছে। প্রয়োজন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার, পেট্রল-ডিজ়েলে চলা গাড়ি বন্ধ করা থেকে জলা ভরাট বা গাছ কাটা বন্ধ, সব ক্ষেত্রেই— কাগজে বা বক্তৃতায় নয়, মাঠে নেমে। যে শহর গত ষাট বছরে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে পৃথিবীতে সর্বোচ্চ; সেখানে গাছ বাড়ার বদলে গত এক দশকে ত্রিশ শতাংশ কমে যাওয়া ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না কেউই।
এক দিকে যখন শহরগুলিতে জলবায়ুর ধাক্কা বাড়ছে, অন্য দিকে তখন মানুষ গ্রামাঞ্চল ছেড়ে ইতিমধ্যেই শহরগুলির দিকে ছুটে আসছে, ফলে বিপদ আরও বাড়তে চলেছে। কলকাতাকে সে বিপদের কথাও মাথায় রাখতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy