কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ফাইল চিত্র ।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি বাজেটের সমালোচনায় একটি সাধারণ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সেটি হল, এই বাজেটে সামাজিক ক্ষেত্রগুলিকে অপেক্ষাকৃত ভাবে অবহেলা করে পুঁজি বিনিয়োগের উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক ক্ষেত্রগুলি যে অবহেলিত হচ্ছে, তার প্রতিফলন হিসাবে দেখা যাচ্ছে কর্মনিযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে গ্যারান্টি প্রদানের বিষয়টির ক্রমাবনতি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে স্থবির নীতি গ্রহণ। যখন দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট বয়সের ছেলেমেয়েদের এক-পঞ্চমাংশ তাদের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারছে না, প্রাথমিক অথবা কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির হাল বছরের পর বছর অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে এবং গ্রামীণ শ্রমমূল্য প্রাক-অতিমারি পর্বে যা ছিল, সেখানেই থমকে রয়েছে, তখন এই সমালোচনার দিকে নজর দিতেই হয়।
এই সমালোচনার উত্তর খুঁজতে বসলে ২০২২-’২৩-এর ‘ইকোনমিক সার্ভে’-র দিকে তাকাতে হয়, যেখানে উপরে বর্ণিত সব কিছুই লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং সেই সঙ্গে এই পর্যালোচনা জানাচ্ছে যে, সম্পূর্ণ ছবিটিকে সাদায়-কালোয় দেখা যায় না। এর মধ্যে বিভিন্ন বর্ণালি খেলা করছে। এই পর্যালোচনা থেকে জানা যায়, সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের সাধারণ ব্যয় (কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়কে একত্রে ধরতে হবে) সামগ্রিক সরকারি ব্যয় এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে বাড়তির দিকেই ছিল। ২০১৫-’১৬ এবং ২০২২-’২২ অর্থবর্ষের মধ্যবর্তী পর্বে (বাজেটে উল্লিখিত আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী) জিডিপি-র অংশ ৬.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৮ শতাংশে পৌঁছয়। (পর্যালোচনা ৮ শতাংশের পরিসংখ্যান দিচ্ছে, কারণ এতে সাম্প্রতিক মূল্যের নিরিখে জিডিপি-র হিসাব করা হয়নি)। এই বৃদ্ধির মধ্যেই স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে স্থবিরতাই দেখা গিয়েছে।
এর ফল যা দাঁড়ায়— স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কিছুটা গতি দেখা যায় এবং পরিশুদ্ধ পানীয় জল ও বিদ্যুতের সংযোগসম্পন্ন বাড়ির সংখ্যা বাড়ে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই পরিসংখ্যান কিছুটা তামাদি, কখনও কখনও উল্লিখিত পরিসংখ্যানগুলি পরস্পর-বিরোধীও বটে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ‘স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম’-এর রিপোর্টে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ২৮টি বলে উল্লিখিত রয়েছে। সেখানে ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’ (এনএফএইচএস) ২০১৯-’২১ পর্বে এই হারটি দেখাচ্ছে ৩৮.৪। কোনটিতে আপনি বিশ্বাস রাখবেন? চলতি কথা, ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে উল্লিখিত ‘ফলাফল’ সব সময় মুক্ত সমীক্ষায় উঠে আসা ‘ফলাফল’-এর সঙ্গে না-ও মিলতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর প্রায় সর্বজনীন দাবি সত্ত্বেও এনএফএইচএস জানাচ্ছে, উন্নততর শৌচাগার ৬৫ শতাংশের বেশি গৃহে পৌঁছয়নি। ‘উজ্জ্বলা’ প্রকল্পের যাবতীয় গুণাবলি স্বীকার করেও বলা যায়, রান্নার গ্যাস বা দূষণহীন জ্বালানি মাত্র ৪৩ শতাংশ পরিবারে পৌঁছেছে।
এই সব উল্লেখের বিষয়টিই এমন। এক দিক থেকে দেখলে অতীতের সঙ্গে তুলনা করে একে ‘প্রগতির লক্ষণ’ বলে সহজেই ধরে নেওয়া যায়। আবার অন্য দিকে আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে দেখলে তেমন কিছুই মনে হয় না। মাঝেমধ্যেই এর মধ্যে সমস্যা দেখা দেয়। ‘ইকোনমিক টাইমস’-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে সঞ্জীব সান্যাল ঐকান্তিকতার সঙ্গে দেখাচ্ছেন যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র শিশুদের ‘স্টান্টিং’ (দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি) এবং ‘ওয়েস্টিং’ (বিশেষ সময়পর্বের মধ্যে নেওয়া অপুষ্টিজনিত পরিসংখ্যান) সংক্রান্ত হিসাব এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র দ্বারা উৎপাদন-শ্রমে নিয়োজিত মহিলার পরিসংখ্যান বেশ গোলমেলে। ভারতের ক্ষেত্রে প্রথমটি যথেষ্ট বেশি এবং দ্বিতীয়টি আশ্চর্যজনক ভাবে কম।
যাই হোক, এ কথা মনে রাখা দরকার যে, জাতিপুঞ্জের মানবোন্নয়ন সারণি বা ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ (এইচডিআই)-এ বহু বছর ধরেই ভারতের স্থান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তেমন ইতরবিশেষ কিছু ঘটেনি। এ থেকে এমন সিদ্ধান্তে আসাই যায় যে, ভারত অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় এমন অবস্থানে রয়েছে, যা ভালও নয় আবার খারাপও নয়। কিন্তু অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি ভারতের থেকে অনেকটাই কম। এইচডিআই-তে ভারতের নিজস্ব উন্নয়নের হার এই শতকের দ্বিতীয় দশকে বিগত দুই দশকের তুলনায় কমে গিয়েছিল। ভারত ক্রমাগত মানবোন্নয়নের ‘মধ্যম’ স্তরে থমকে থাকে। মানবোন্নয়নের বর্তমান হার বজায় থাকলে ‘উচ্চ’ স্তরের চৌকাঠ ডিঙোতে (যা ইতিমধ্যে ভিয়েতনাম করেছে) এ দেশের চলতি দশকের বাকি অংশ লেগে যাবে। এ থেকে মনে হতে পারে যে, যেখানে বেশ কিছু সরকারি প্রকল্প কায়ক্লেশে সাফল্য পেয়েছে, সেখানে সার্বিক ছবিতে কোনও উল্লেখযোগ্য উল্লম্ফন দেখা যায় না।
সমীক্ষায় উল্লিখিত বিভিন্ন ‘ডেটা প্ল্যাটফর্ম’-এর নির্মাণের কথা এ ক্ষেত্রে বলতেই হয়, যাদের উপর ভিত্তি করে নানা রকমের সরকারি প্রকল্পের রূপায়ণ ঘটে। আধার (কেন্দ্র ও রাজ্যের এক হাজারেরও বেশি প্রকল্পের টাকা যার মাধ্যমে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢোকে) এবং ‘ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস’ বা ‘ইউপিআই’ (এটিও যথেষ্ট মাত্রায় সফল) বাদ দিলে অসংগঠিত ক্ষেত্রে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়, ডিজিটাল বাণিজ্য ইত্যাদিতে শ্রমদানকারীদের নথিভুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই সব ক্ষেত্র থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান (পণ্য ও পরিষেবা কর বা জিএসটি প্রদানের জন্য নথিভুক্তদের প্রায় দ্বিগুণ) ব্যবসার আকার-আকৃতি ও বৃদ্ধির প্রবণতা সম্পর্কে জানার জন্য ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ দিতে কাজে লাগে। কিন্তু কেউই এই সব ‘ফলাফল’-এর প্রমাণ দেখতে চান না। এই সব ‘মেটা ডেটা’য় জনগণের হাত পৌঁছয় বলেও মনে হয় না। উদাহরণ হিসেবে এ প্রশ্ন রাখা যায় যে, ই-শ্রম প্ল্যাটফর্মে নথিভুক্ত হলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ২৮ কোটি ৫ লক্ষ শ্রমিক কী আদৌ উপকৃত হবেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy