ব্রিটেনের নয়া প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক। ফাইল চিত্র ।
ব্রিটেনের সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস অনুশোচনার লেশমাত্র না রেখে ‘কম কর, বেশি বৃদ্ধি’-র প্রকল্পটির বেশ খানিকটা বদনামই করে গেলেন বলে মনে হচ্ছে। এ কথা কার্যত সত্যি যে, আয়করের হার আর অর্থনীতির বৃদ্ধির মধ্যে কোনও সুস্পষ্ট সম্পর্কই নেই। সাধারণ ভাবে দেখলে পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় উন্নত অর্থনীতির দেশগুলিতে করের হারও বেশ উঁচু তারে বাঁধা। অনেক সময় সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশের আশপাশে। ব্রিটেনের সর্বোচ্চ আয়করের হার ৪৫ শতাংশ, যা অন্যান্য ইউরো-ভিত্তিক অর্থনীতির দেশগুলির গড় হিসাবের থেকে খুব কিছু বেশি নয়। বরং বলা যায়, আমেরিকা আর জাপানের চেয়ে খানিক বেশি। এগিয়ে থাকা অর্থনীতির দেশগুলির মধ্যে (সিঙ্গাপুরের মতো দেশ বাদ দিলে) কেবল কানাডার সর্বোচ্চ আয়কর হার লক্ষণীয় ভাবে কম (৩৩ শতাংশ)। পুর্ব এশিয়ার অধিক আয়ের দেশগুলির (দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ান) সর্বোচ্চ আয়কর হার ইউরোপীয় গড়েরই কাছাকাছি। অথচ তাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার মোটেই এক রকম নয়।
এর মধ্যে লক্ষণীয় প্রবণতা হল— সমৃদ্ধতর অর্থনীতির দেশগুলিতে করের হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ, তারা জনকল্যাণকর কর্মসূচিতে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে। উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলিতে সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি তুলনামূলক ভাবে কম থাকায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সাপেক্ষে সরকারি ব্যয়ও অনেক কম। এ থেকেই বোঝা যায় যে, পুর্ব এশিয়ার সফল মধ্য-অর্থনীতির দেশগুলির সরকারি বাজেট অল্প এবং জিডিপি-র নিরিখে দেখলে অন্য অর্থনীতির তুলনায় তাদের ঘাটতির পরিমাণও কম। এমনকি, অত্যন্ত সফল দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ তার জিডিপি-র এক চতুর্থাংশের সমান (যেখানে ফ্রান্সের মতো দেশ, যার অর্থনীতিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট, সেখানে এই পরিসংখ্যান ৬০ শতাংশ) এবং ঘাটতির পরিমাণ মাত্র ২.৮ শতাংশ।
দক্ষিণ কোরিয়ার এই উদাহরণের প্রতিফলন কমবেশি দেখা যায় মালয়েশিয়া, তাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স এবং ভিয়েতনামের মধ্যে। তুলনায় ভারতের সরকারি খরচ অনেক বেশি, জিডিপি-র এক তৃতীয়াংশ। ভারতের ঘাটতির পরিমাণও বেশ খানিকটা বেশি (কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে দেখলে প্রায় ১০ শতাংশ)। সরকারি ঋণের জায়গা থেকে দেখলেও বিষয়টি একই রকম লাগবে— কোরিয়ার ঋণ তার জিডিপি-র অর্ধেকেরও কম, সেখানে ভারতের ঋণের পরিমাণ তার জিডিপি-র ৮৫ শতাংশেরও বেশি। তাইওয়ানের সরকারি ব্যয় তার জিডিপি-র সাপেক্ষে দক্ষিণ কোরিয়ার থেকেও কম, পাশাপাশি তার ঋণের পরিমাণও লক্ষণীয় ভাবে কম।
এ থেকে এমন মনে হতেই পারে যে, সর্বোচ্চ করের হার নয়, সরকারি ব্যয়ের পরিমাণই এ ক্ষেত্রে আসল ভূমিকা পালন করে। এই সূত্রে মনে পড়তে পারে দীর্ঘকাল আগে তামাদি হয়ে যাওয়া মার্গারেট থ্যাচার এবং রোনাল্ড রেগনের সরকারি ব্যয় নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই যে, ব্রিটেন বা অন্য কোনও এগিয়ে থাকা দেশ কি কর হ্রাস করতে এবং সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ কমাতে গণকল্যাণমুখী বাজেটে (ধরা যাক, গণস্বাস্থ্য পরিষেবায় কাটছাঁট) সঙ্কোচন আনবে? সাম্প্রতিক ও ভূতপূর্ব, দুই আমেরিকান প্রেসিডেন্টই নতুন নতুন উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে সরকারি ব্যয়কে বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে গিয়েছেন। ঋষি সুনকও তাঁর তরফে বেশ কিছু ব্যয়সাপেক্ষ প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তিনি কী ভাবে সেই অসাধ্যসাধন করবেন, তা কারও জানা নেই। বিরাট ঘাটতি এবং বিপুল পরিমাণ সরকারি ঋণ (কখনও ভারতের চাইতেও বেশি) ঘাড়ে নিয়ে এমন সব ব্যয়সাপেক্ষ প্রতিশ্রুতি খুব সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশের পক্ষেও পালন করা হয়তো আর সম্ভবই নয়। এর বিকল্প হিসেবে যা রয়েছে, তা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ‘আত্মহনন’, অথবা দু’টিই। এর কোনও একটিকেই ট্রাস বেছে নিয়েছিলেন।
তা হলে প্রশ্ন, ভারত ঠিক কোনখানে দাঁড়িয়ে? পুর্ব এশিয়ার দেশগুলির (জাপান ও চিন ছাড়া) সঙ্গে তুলনা করে দেখলে ভারতের জিডিপি-র তুলনায় সরকারি মালিকানায় থাকা সংস্থার পরিমাণ বিশাল। তা সত্ত্বেও এ দেশের যে কোনও দিকেই গণ পরিষেবার গুণগত মান অত্যন্ত খারাপ এবং প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ও যথেষ্ট নয়। এ থেকে এমন ভাবনার উদয় হতেই পারে যে, ভারতের সরকারি ক্ষেত্র আসলে খুবই ছোট। কিন্তু বাস্তব প্রশ্ন হল, কী উপায়ে পুর্ব এশিয়ার দেশগুলি অনেক কম বাজেটে ভারতের থেকে উন্নততর কর্মসূচি রূপায়ণ করে? এমনকি, বাংলাদেশও তুলনামূলক ভাবে আর্থিক বৃদ্ধির হারকে বজায় রাখতে সমর্থ এবং অনেক ক্ষেত্রেই সে দেশের সামাজিক উন্নতির সূচকগুলি অধিকতর ভাল। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশে করের হার কম এবং বাজেটও ভারতের অর্ধেক। কার্যত বাংলাদেশের বাজেট সে দেশের জিডিপি-র মাত্র ১৫ শতাংশ এবং সরকারি ঋণের পরিমাণ জিডিপি-র ৩৪ শতাংশ।
তা হলে কি ভারতের সরকারি ব্যয় আসলে বেশ খানিকটা বাড়িয়ে বলা? যতখানি বলা হয়, সেই পরিমাণ কখনই প্রদান করা হয় না? পাশাপাশি, এ-ও মনে রাখতে হবে যে, সব থেকে বেশি সমস্যায় দীর্ণ মধ্য-আয়ের অর্থনীতির দেশগুলিতে সরকারি ব্যয় বিপুল, ঘাটতি বিপুল এবং ঋণের পরিমাণও বিপুল। সেই সঙ্গে সমান তালে সেই সব দেশে দুর্নীতিও ব্যাপক। এমন দেশের সব থেকে স্পষ্ট উদাহরণ হল ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। এমন উদাহরণের সঙ্গে যাতে এক পঙক্তিতে বসতে না হয়, সে ব্যাপারে ভারতের সচেতন থাকা প্রয়োজন। সম্ভবত অর্থমন্ত্রক অথবা নীতি আয়োগ এ ব্যাপারে বিশদ দৃষ্টি রাখতে পারে। যাতে সরকারি ব্যয় যথাযোগ্য ভাবে সম্পন্ন হয়, সরকারি পরিষেবার মানের উন্নতি ঘটে এবং প্রয়োজন অনুসারে তার প্রসারও ঘটে।
এই সব কাজ করতে গিয়ে কত টাকা বাঁচানো সম্ভব এবং কী কী বিষয় সরকার নিশ্চিন্তে বেসরকারি সংস্থার হাতে দিতে পারে, সে অন্য প্রসঙ্গ। কোনও কোনও জায়গায় আন্তর্জাতিক মাপকাঠি ব্যবহার করলে বোধ হয় এমন সব ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া সম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy