বহুলপ্রচারিত সর্ষের তেলের বিজ্ঞাপনে শোনা যায়, খাঁটি বাঙালিকে চেনা যায় ঝাঁঝে। এই ঝাঁঝ খাঁটি সর্ষের তেলের। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সর্ষের তেল-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম এমন গতিতে বেড়ে চলেছে যে, বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে সারা দেশের মানুষ চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করেছেন।
দীপাবলির প্রাক্কালে ‘সলভেন্ট এক্সট্র্যাক্টর অ্যাসোসিয়েশন’ ঘোষণা করেছিল, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে তারা তেলের দাম কমাচ্ছে। লিটার প্রতি দাম কমবে ৫ থেকে ৭ টাকা। বছরখানেক আগেও যে তেলের দাম ছিল লিটার প্রতি ১০০ থেকে ১১০ টাকা, সেটা কলকাতা-সহ রাজ্যের বহু জায়গায় যখন ২১৫ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তখন লিটারে ৫ থেকে ৭ টাকা কমলে সাধারণ মানুষের কতটা সুরাহা হবে, তা নিয়ে তর্ক হতেই পারে। কিন্তু তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ, সংবাদসূত্র অনুযায়ী এ ব্যাপারে কেন্দ্র সরকার নাকি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল এবং শেষমেশ সরকারকে ওই বেসরকারি বণিক সঙ্ঘের বদান্যতার উপর নির্ভর করতে হয়েছে। সুতরাং, বুঝতে অসুবিধে হয় না, ইতিমধ্যে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য দেশের নামজাদা গুটিকয় পুঁজিপতি বাণিজ্যিক সংস্থার হাতে ভোজ্য তেলের দাম নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি চলে গেছে।
কিন্তু সমস্যা হল, গত এক বছরে দাম যে শুধু সর্ষের তেল-সহ ভোজ্য তেলেরই বেড়েছে তা নয়। চাল, গম, সব রকমের ডাল, আলু, পেঁয়াজ, এক কথায় যে যে জিনিস ছাড়া গৃহস্থের হেঁশেল অচল, সব ক’টিরই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। অথচ করোনাকালে দেশ তথা রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আয় তো উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে বটেই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে জীবিকাও হারিয়েছেন বহু মানুষ। ফলে নাভিশ্বাস উঠেছে আম জনতার।
তবে এমনটা যে ঘটতে চলেছে, তা অনুমান করা গিয়েছিল ২০২০-র ৫ জুন দেশ জুড়ে ‘অত্যাবশ্যক পণ্য আইন (সংশোধন), ২০২০’ কার্যকর হওয়ার সময়েই। এই সংশোধনীর ফলে খাদ্যশস্য, খাদ্যবীজ, তৈলবীজ, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ ও আলুকে অত্যাবশ্যক পণ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। অত্যাবশ্যক পণ্য আইন, ১৯৫৫ অনুযায়ী এত দিন পর্যন্ত সরকারের হাতে ওই পণ্যগুলির নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে যে ক্ষমতা ছিল, সরকার এই সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা স্বেচ্ছায় পুঁজিপতিদের উৎসর্গ করেছে। চক্ষুলজ্জার খাতিরে কয়েকটি শর্ত রাখা হয়েছে। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বা ভয়ানক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া এখনও সেই নিয়ন্ত্রণ আরোপ সরকারের হাতেই। কিন্তু সে অনেকটা ভাবের ঘরে চুরির মতো। কোনও পণ্যের মজুতের ঊর্ধ্বসীমা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মাপকাঠি হিসাবে গত ১২ মাসের এবং গত ৫ বছরের গড় মূল্যের মধ্যে যেটি কম হবে সেটিকে ভিত্তি ধরে, উদ্যানজাত পণ্যের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি এবং পচনশীল নয়, এমন কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিকে ধরা হয়েছে। শুধু এমনটা ঘটলেই সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে বটে, তবে সব ক্ষেত্রে নয়। ব্যতিক্রম আগেই উল্লিখিত। খাদ্য প্রক্রিয়াকারক, ভ্যালু চেন পার্টিসিপেন্ট এবং রফতানিকারকরা এই নিয়ন্ত্রণ থেকে ছাড় পাবেন। সম্ভাব্য সুবিধাভোগী কারা, তা সলভেন্ট এক্সট্র্যাক্টর অ্যাসোসিয়েশন-এর সদস্য-তালিকা দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে।
অত্যাবশ্যক পণ্য আইন, ১৯৫৫ সংশোধনের যুক্তি হিসাবে বলা হয়েছিল, এটি শুধু কৃষকদের জন্যই নয়, উপভোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের জন্যও ইতিবাচক পদক্ষেপ। এতে হিমঘরগুলিতে বিনিয়োগ বাড়বে, খাদ্য সরবরাহ আরও আধুনিক হবে, দামে স্থিতিশীলতা আসবে, প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সৃষ্টি হবে। বিনিয়োগ হয়তো কিছু বেড়েছে। কিন্তু তার সুফল না পেয়েছেন কৃষকরা, না উপভোক্তারা। আর দামের স্থিতিশীলতা? মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
অনেকে বিষয়টি আড়াল করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির দায় চাপাচ্ছেন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির উপর। বিষয়টা অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো। কোনও পণ্যের খুচরো দাম পরিবহণ খরচের উপর অবশ্যই কিছুটা নির্ভর করে। কিন্তু কতটুকু? ২০২০-র ১ অক্টোবর কলকাতায় ডিজ়েলের দাম ছিল লিটার প্রতি ৭৪.০২ টাকা, যা বাড়তে বাড়তে ২০২১-এর ৩০ অক্টোবর ছুঁয়েছিল ১০০.৮৪ টাকা। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে ডিজ়েলের দাম বেড়েছিল প্রায় ২৮ শতাংশ। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায়, কোনও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের খুচরো দামের শতকরা ১০ শতাংশ হল পরিবহণ খরচ, তা হলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে ওই জিনিসটার দাম মাত্র ২.৮ শতাংশ বাড়ার কথা। অথচ বাস্তবে কী ঘটেছে, সকলেই জানেন। সম্প্রতি কেন্দ্র ডিজ়েল ও পেট্রলের দাম লিটারপ্রতি যথাক্রমে ১০ টাকা ও ৫ টাকা করে কমিয়েছে। জিনিসপত্রের দামের উপর এর কোনও প্রভাব পড়ে কি না, সেটাই এখন দেখার।
এ বছর ১২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট অত্যাবশ্যক পণ্য আইন (সংশোধিত), ২০২০-সহ ২০২০-তে পাশ হওয়া তিনটি কৃষি আইন কার্যকর করার উপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে। তা সত্ত্বেও চাল, ডাল, গম, তৈলবীজ-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামের নিয়ন্ত্রণ কেমন করে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতেই রয়ে গেল, ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্নের ফেরিওয়ালাদেরও কেন তাঁদের কাছে নতজানু হতে হল, সেই রহস্য উদ্ঘাটিত হওয়া প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy