ভারতে জন্মহার দ্রুত কমছে। এক জন প্রজননক্ষম বয়সের মহিলা (সব বয়সের সাম্প্রতিক জন্মহারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে) মোট ক’টি সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম, তা আমরা মোট জন্মহার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর) থেকে বুঝতে পারি। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার (এনএফএইচএস) পঞ্চম দফার পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশের টিএফআর বর্তমানে ২, যা কিনা প্রতিস্থাপন স্তরের (২.১) চেয়েও কম। এই বিশেষ স্তরে পৌঁছে গেলে দেশের জনসংখ্যা পরবর্তী বেশ কয়েক দশক ধরে স্থিতিশীল থাকে, এবং পরে তার আর বৃদ্ধি ঘটে না।
তবেপ্রতিস্থাপন স্তরে জন্মহার পৌঁছলেই দেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধি হঠাৎ থমকে যাবে, এমনটা নয়। আগে জন্মহার আজকের চেয়ে অনেক বেশি ছিল, ফলে সেই সময়ে যাঁরা জন্মেছেন, তাঁরা এক সময় প্রজননের বয়সি হবেন, বিয়ে করবেন এবং সন্তানের জন্ম দেবেন। এই পূর্ববর্তী ভরবেগের ফলে জনসংখ্যা কিছু দিন পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে, ঠিক যেমন ব্রেক কষার পর একটি গাড়ি থামার আগে কিছু দূর এগিয়ে যায়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশিত জনসংখ্যা অভিক্ষেপ রিপোর্ট (পিপিআর) অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০৩৬-এর মধ্যে ভারতের জনসংখ্যা ১২১ কোটি থেকে ১৫২ কোটিতে গিয়ে পৌঁছবে, বার্ষিক গড় বৃদ্ধি হবে ১.০২%। তাই, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা এখন চিন্তার বিষয় নয়— এই জনসংখ্যাকে কী ভাবে কর্মদক্ষ করে তোলা যায়, সেটাই এখন মূল ভাবনার বিষয় হওয়া উচিত।
পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য জন্মহারের স্থানান্তর ঘটেছিল বর্তমান সহস্রাব্দের গোড়াতেই। গ্রামীণ এলাকাগুলিতে ২০০০ সালের আগে-পরে যে রদবদল দেখা দিয়েছিল, শহরে তা ঘটে গিয়েছিল আশির দশকের শেষ ভাগে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের টিএফআর ১.৫, যা ভারতে রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। পিপিআর-এর মতে, বাংলার জনসংখ্যা ৯.১ কোটি থেকে ১০.৩ কোটিতে পৌঁছবে ২০১১ থেকে ২০৩৬-র মধ্যে, গড় বার্ষিক বৃদ্ধি হবে ০.৫২%। উল্লেখযোগ্য বিষয়, কলকাতার ক্ষেত্রে জন্মহারের এই প্রতিস্থাপন স্তর গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের গোড়া থেকেই রয়েছে, তা এখনও অব্যাহত। ১৯৭৪-৮০ পর্যন্ত কলকাতার টিএফআর ছিল ২.০, যেটি ২০১১ সালে কমে গিয়ে হয় ১.২, ২০১৫-১৬ সালে তা দাঁড়ায় ১.১, যা ভারতের সব জেলার মধ্যে সর্বনিম্ন। ঠিক একই সময়কালে মুম্বইয়ের টিএফআর ছিল যথাক্রমে ৩.১, ১.৪ এবং ১.৩। ভারতের অন্যান্য উন্নত বড় শহরের ক্ষেত্রেও ছবিটা একই রকম। এনএফএইচএস-এর ২০১৫-১৬ সালের রিপোর্ট বলছে যে, কলকাতায় একক-সন্তান সম্বলিত পরিবারের অনুপাত ৩৮%, যেখানে মুম্বই, দিল্লি ও চেন্নাইয়ে এই অনুপাত হল যথাক্রমে ২৮%, ২৪% ও ৩৫%। প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক কোন কারণে প্রায় অর্ধশতক আগে কেবলমাত্র কলকাতাতেই প্রজননের হারের এ রকম রদবদল দেখা গিয়েছিল? এবং, ভবিষ্যতে কলকাতা-সহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার চেহারা কেমন হতে চলেছে?
এর উত্তর দিতে হলে ইতিহাসের দ্বারস্থ হতে হয়। পরাধীন ভারতের এক সময়ের রাজধানী ছিল কলকাতা। ঔপনিবেশিক মূল ঘাঁটি হওয়ার দরুন পাশ্চাত্যের হাওয়া ভারতের অন্য শহরগুলির তুলনায় কলকাতার গায়ে আগে লেগেছিল। যদিও সে প্রভাব সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র কলকাতার অভিজাত শ্রেণির মধ্যেই। গবেষকরা প্রমাণ করেছেন যে, ১৯৪৭-৪৯’এর মধ্যে কলকাতার উচ্চবিত্ত সমাজে বিবাহিত মহিলাদের এক-তৃতীয়াংশ গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। সংখ্যায় কম, কিন্তু কৃতী সন্তান প্রতিপালনের ধ্যানধারণা বা ‘গুণমান বনাম পরিমাণ’-এর এই ‘ট্রেড-অফ’ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছিল অভিজাত শ্রেণি থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে। দেশভাগের পর এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়ে উঠল। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা শয়ে শয়ে ছিন্নমূল মানুষ আশ্রয় নিলেন কলকাতায় ও পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে; তাঁদের কাছে দিন গুজরান এবং একটি বা দু’টি সন্তানকে বড় করে তোলাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। অবশ্য তাঁদের লক্ষ্যের নেপথ্যে ছিল আরও দু’টি উদ্দেশ্য— সামাজিক অবস্থানে দ্রুত উন্নতি, আর সেই সঙ্গে সন্তানদের উচ্চশিক্ষা সুনিশ্চিত করা।
পরবর্তী সময়ে ছবিটা খানিক বদলে গেল। পশ্চিমবঙ্গের শহরে ‘গুণমান বনাম পরিমাণ’-এর তুল্যমূল্য বিচারের জায়গা নিল সন্তানদের প্রতি বাবা মায়ের ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’। জীবনে তাঁরা যে সব আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে পারেননি, সন্তানদের মধ্য দিয়ে সে আশ মিটিয়ে নিতে তৎপর হলেন। লক্ষ্য আবারও সেই এক— সামাজিক উত্তরণ। ধরা যাক, রমেশবাবু এক জন সাধারণ সরকারি কর্মচারী। তাঁর একমাত্র সন্তান ইঞ্জিনিয়রিং পাশ করার পর চাকরিসূত্রে আমেরিকার বাসিন্দা। মাস ছয়েকের জন্য সস্ত্রীক রমেশবাবু আমেরিকায় ছুটি কাটিয়ে এলেন। কলকাতায় ফেরার পর আত্মীয়পরিজনদের কাছে সম্ভবত রমেশবাবুর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বা প্রতিপত্তি আগের চেয়ে বেড়ে যাবে।
এ ক্ষেত্রে একটি ব্যাপার লক্ষণীয়— এই আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থের প্রবণতা কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের শহুরে সাধারণ মানুষদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল জন্মহার রদবদলের শেষ পর্যায়ে, এবং তা ঘটেছিল মূলত সামাজিক অনুকরণ ও সামাজিক শিক্ষার হাত ধরে। ঠিক এই কারণেই আমরা দেখতে পাই যে, শহুরে গরিব, নিম্নবিত্ত, স্বল্পশিক্ষিত পরিবারেও সন্তানসংখ্যা সচরাচর এক বা দুইয়ের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। সেই ছেলেমেয়েরা অধিকাংশই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ও চাকরিতে যোগ দেয় শহরের সংগঠিত বা অসংগঠিত ক্ষেত্রে। যদিও প্রতিযোগিতামূলক বাজার হওয়ায় সবার ক্ষেত্রে অবস্থাটা এক রকম হয় না।
তবুও এ কথা জোর দিয়ে বলা চলে যে, অর্থনৈতিক অবস্থান, মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বা জাতি-ধর্মনির্বিশেষে বর্তমান সামাজিক কাঠামোয় একটি বা বড়জোর দু’টি সন্তানই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়ার বিস্তৃতি, পুত্রসন্তানের প্রতি কম পক্ষপাতমূলক আচরণ এবং পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতির সহজলভ্যতা জন্মহারকে সার্বিক ভাবে কমিয়ে আনতে পেরেছে। ভারতের উন্নত শহরগুলিতে এই রদবদল মোটামুটি একই পথ ধরে ঘটেছে, যদিও কলকাতা বা বাংলার শহরাঞ্চলের এ অভিজ্ঞতা অনেক আগেই হয়েছিল এক অভূতপূর্ব সামাজিক ও ঐতিহাসিক যোগসাজশে।
এখন প্রশ্ন, যদি সুদীর্ঘ সময় ধরে কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গে এই প্রবণতা চলতে থাকে, তা হলে কী ঘটতে পারে? পিপিআর অনুযায়ী, ২০৩৬ সালে ভারতের বার্ধক্যপ্রাপ্ত জনসংখ্যা যখন ১৫% হবে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা হবে ১৮% এবং কলকাতার ক্ষেত্রে আনুমানিক ২৫% । ফলে এই হিসাব মাথায় রেখে আমাদের রাজ্যের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। শুধু বয়স্ক মানুষদের শারীরিক সমস্যার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাই নয়, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও আর্থিক স্বাধীনতার দিকেও নজর দিতে হবে।
একটি বহুমুখী পরিকল্পনা প্রয়োজন, যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্তরেও বৃদ্ধদের স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা সংক্রান্ত বিভাগ থাকবে, বয়স্কদের জন্য থাকবে মজবুত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প এবং সর্বোপরি গড়তে হবে বেশ কিছু বৃদ্ধাশ্রম। কারণ, সেই সময় তাঁদের দেখভাল করার জন্য সমাজে কমবয়সিদের উপস্থিতি ভীষণ ভাবে কমে যাবে। ২০১১ থেকে ২০৩৬-এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ১৪ বছর বা তার কমবয়সিদের অনুপাত ২৭.১% থেকে ১৬.৩%-এ নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা, যা কিনা বৃদ্ধদের শতকরা উপস্থিতির চেয়েও কম। রাজ্য সরকারকে হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ভাবনাচিন্তা শুরু করতে হবে শিশুদের বড় করার ক্ষেত্রে বিশেষ সামাজিক সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে। সেই সব পরিবারই এই সুবিধা পাবে, যাদের অন্তত দু’টি সন্তান রয়েছে। ইউরোপ , স্ক্যান্ডিনেভিয়া-সহ বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি বহু দিন ধরেই চলে আসছে।
একটা আশঙ্কা না বলে শেষ করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের এই নিম্নমুখী জনসংখ্যার জন্য ভবিষ্যতে অন্য ভারতীয় রাজ্য, যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি, সেখান থেকে এ রাজ্যে আরও বেশি পরিযাণ ঘটবে। এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা মূলত নগরকেন্দ্রিক অসংগঠিত ক্ষেত্র, ছোট বা মাঝারি সংগঠনে বাংলার শ্রমশক্তির ঘাটতি পূরণ করবেন। বিবিধ রাজ্য থেকে আসা জনগোষ্ঠীর এই পরিযাণ পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক দ্বন্দ্বের জন্ম দিতে পারে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের ভাষা ও সংস্কৃতির পরিসরে।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা : স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy