—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
মাথায় দুই ঝুঁটি বাঁধা বালিকাকে বাবুদার রিকশায় তুলে দিয়ে মা-বাবা নিশ্চিন্ত। বাবুদা মেয়েকে ঠিক স্কুলে পৌঁছে দেবে। বালিকার যত আবদার তার চালক ‘কাকু’র কাছে। একটা লজেন্স, কারেন্ট নুন, এমনকি আইসক্রিম পর্যন্ত মিলে যায় তাঁর বদান্যতায়। ক্রমশ বালিকা যৌবনে পা দেয়। চাকরি পায় নিজের এলাকাতেই। তখনও ‘কাকু’ ভরসা। নিয়ে যাওয়া-আসা তো আছেই, পথে রিকশা দাঁড় করিয়ে মিষ্টি বা ওষুধ কেনা, টুকটাক বাজার করা ইত্যাদি চলতে থাকে। রিকশাচালক এই ‘কাকু’ ওরফে বাবুকে কেউ ‘আপনি’ বলে না। ‘তুমি’ বা ‘তুই’-এর ভালবাসা তত ক্ষণই বজায় থাকে, যত ক্ষণ ভাড়া কমের মধ্যে থাকে। একটু বেশি চাইলেই সওয়ারের মুখ হাঁড়ি। বাবুদা কিন্তু নির্বিকার। রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা আর মাঝেমধ্যে ভাড়া পেতে তাঁর বারো-তেরো ঘণ্টা কেটে যায় প্রত্যহ। বন্ধ দোকানের ঝাঁপের নীচে দুপুরের আহার সারেন খানদশেক রুটি দিয়ে। তার পর রিকশার সিটেই কুণ্ডলী পাকিয়ে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুম। যাত্রীর মাথার ঢাকায় ফুটো দেখা দিয়েছে কয়েকটা। বর্ষার আগে সামনের পর্দা চাই একটা। বল বেয়ারিংও বদলাতে হবে। অনেকগুলো টাকার মামলা। রোদে চাঁদি ফেটে যায় বাবুদার। বর্ষায় ভিজে কাক। অনেক রাতে বাড়ি ফেরার পথে কয়েক চুমুক সস্তার তরল চাই। ওটুকু না হলে বাঁচা যায় না। ইদানীং বয়স হচ্ছে। শরীরে এই ভয়াবহ শ্রম সয় না। রাতে জ্বর আসে। টোটো চালু হতে যাত্রী কমে দশ ভাগের এক ভাগ হয়ে গিয়েছে। ও দিকে বাড়িতে স্ত্রী, সন্তান মিলিয়ে পাঁচ-পাঁচটি পেটের দায়। টলতে টলতে মাঝরাতে বাড়ি ফেরেন বাবুদা। আবার ভোর চারটে থেকে শুরু হবে কালকের লড়াই।
রিকশাচালক বাবু অথবা বাবুদা কিংবা বাবুকাকা কেবল এক জন ব্যক্তি নন, ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্রে প্রত্যহ প্রচণ্ড কায়িক শ্রম করা এবং পরিবর্তে প্রাপ্য মজুরির অনেকখানি কম পাওয়া লক্ষ-কোটি শ্রমিকের এক জন। বাবুদা ‘মে দিবস’ জানেন কি না, জানা নেই। তবে তাঁর শ্রম-সময় ক্রমশ বাড়তেই থাকে। এক সময়ের রমরমা আজ অতীত। তা ছাড়া অটো এবং টোটোশাসিত যান-জমানায় কমতে থাকে আয়। আমরা মনসুর মিয়ার ঘোড়া নিয়ে আপ্লুত থাকি। কবীরের বাঁশুরিয়া ভ্যানচালক বা ক্লিনারকে নিয়ে গান গাই। কাকুর জীবননাট্যেও কিন্তু যন্ত্রণার মোচড় কিছু কম নেই। কারণ তাঁরও ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ একটি কথাই বলে— “বাবু, হামি গরিব আদমি!”
শহরের রিকশাচালক বাবুদা হয়তো আসলে অন্য কোনও গ্রাম বা প্রদেশ থেকে কিশোর বয়সে চলে এসেছেন। নামমাত্র ভাড়ায় মাথা গুঁজে, সস্তার আহার সেরে বেশির ভাগ আয় পাঠিয়ে দেন দেশের বাড়িতে। হয়তো দূরের কোনও ভূমিহীন কৃষক পরিবার থেকে অথবা কাছের কোনও বন্ধ কারখানায় অনন্ত অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে এসেছেন রিকশা চালাতে। এই কাজ করতে করতে সাহিত্য, চলচ্চিত্র, ছবি সর্বত্র তিনি শহরের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তাঁর ‘গরিব’ কান্না-ঘাম-রক্তে আমাদের সংস্কৃতির ক্যানভাসে অনেক যুগান্তকারী মুহূর্ত আঁকা হয়েছে। সে ভিক্টোরিয়ার সামনে হোক, কিংবা হাওড়া ব্রিজে বা বড়বাজারের ট্রাম রাস্তায়। বাবুদা আর তাঁর রিকশা যেন এই বাংলা, এই দেশ হয়ে উঠেছে বহু দশকের অভ্যাসে, অপমানে, অক্লান্ত ছুটে চলায়।
১৮৬০ সালে জাপান চড়েছিল ‘জিনরিকিশা’য়। প্রথম যুগের ‘রিকশা’। দুটো বড় চাকা আর টানার জন্য লম্বা দুই হাতল। দেখতে দেখতে চিন-সহ এশিয়ার বহু দেশ (বিশেষত সিঙ্গাপুর), পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা-সহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রেই ছড়িয়ে পড়ে এই সহজ, দু’চাকার মানুষ দ্বারা মানুষ টানা যান। পরে যন্ত্রচালিত গাড়ি চলে আসায় ধীরে ধীরে রিকশার দিন বিগত হয়। পাল্কির ইতিহাস ম্লান করে ভারতে রিকশা আসে উনিশ শতকের মধ্যভাগে। মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত মানুষ পথ চলার শ্রম বাঁচানোর জন্য সস্তা একটি বাহন পেয়ে যান। বৃদ্ধ, অসুস্থ, শিক্ষার্থী, গৃহবধূ সকলের প্রিয় যান হয়ে ওঠে রিকশা। কলকাতায় মানুষকে রিকশা ভাড়া করতে দেখা যায় ১৯১৪ সাল নাগাদ। এ সবই ছিল হাতেটানা রিকশা। যাত্রী এবং বোঝার ভার একাই টেনে চলতেন চালক। তাঁর অনুচ্চারিত আর্তনাদ যেন ঘণ্টার শব্দ হয়ে বেজে উঠত। ২০০৬ সাল থেকে হাতেটানা রিকশা সরিয়ে ফেলতে উদ্যোগী হল কলকাতা। অবশ্য মফস্সল এলাকায় তত দিনে সাইকেল রিকশা আসর জমিয়ে দিয়েছে। দু’চাকার বদলে এ বার এল তিন চাকা। চালকের গল্প কিন্তু বদলাল না। আর বর্তমানে অটো-টোটোর দাপটে সেই গল্প আরও করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। যে রিকশাচালক ধারকর্জ করেও টোটো কিনতে পারেননি, তাঁর পক্ষে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
রাস্তার মোড় কিংবা শনি মন্দিরের পাশে কিছু রিকশা স্ট্যান্ড হয়তো আছে, কিন্তু রিকশাচালকের নিরাপত্তা, স্থায়ী আয় অথবা ভবিষ্যতের কোনও সুবন্দোবস্ত নেই। প্রায় ১৪৫ বছরের পুরনো পেশা আজও সংগঠিত ক্ষেত্রের নিরাপদ আশ্রয়ে আসতে পারেনি। বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু পদক্ষেপ হয়েছে, কোথাও কোথাও ‘রিকশা ব্যাঙ্ক’ হয়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের অন্যান্য শ্রমিকের মতো হয়তো সামান্য সরকারি সাহায্য মিলেছে।
কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এই আয়োজন নেহাতই অপ্রতুল। ভারতে যদি আশি-নব্বই লক্ষ রিকশাচালক থাকেন, বেশির ভাগই কিন্তু রিকশা ধার নিয়ে চালান। ২০০৯ সালে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, পঁচানব্বই শতাংশ চালকেরই নিজের রিকশা নেই। আয়ের প্রতি পঁচাত্তর টাকায় তখন মালিককে দিতে হত পঁচিশ টাকা। ২০২২ সালে দিল্লির ৩০৫ জন রিকশাচালককে নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছিল ‘এসপিএসএস’। দেখা যায়, তাঁদের একষট্টি শতাংশই শারীরিক ভাবে অসুস্থ। তিয়াত্তর শতাংশ নানা রকম অবমাননার শিকার। এই চিত্র যে আজকের দিনেও খুব ব্যতিক্রমী, তা নয়। ‘বাবুদা’দের শেষ দিনগুলো খুব কষ্টে কাটে। হয়তো বিনা চিকিৎসায়, হয়তো হাসপাতালের বারান্দায়। সওয়ার বালিকা তরুণী হয়, প্রৌঢ় হয়, বৃদ্ধ হয়। ‘কাকু’র স্মৃতি তাকে মোটেই বিচলিত করে না। মনে রাখারও তো একটা সীমা আছে!
‘গানওলা’ প্রশ্ন তোলেন, ‘এ কিশোর পারবে কি এই বোঝা টানতে?’ প্রশ্নের মতো উত্তরও সহজ। কিশোর মুক্ত ঘুড়ির খোয়াব ভুলে রিকশা টেনে চলবেই। কারণ ওই রিকশার চাকায় তার অভাবের সংসারটি বাঁধা আছে। তার পর সে যুবক হবে, সংসারী হবে। ফের সেই সংসারের দায় রিকশায় চাপিয়ে সে নিজের চুল পাকিয়ে ফেলবে। সময় বদলাবে, রাস্তা বদলাবে, যাত্রী বদলাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy