গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শুধু ভারতেই নয়, কোভিড-আক্রান্ত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই মাস্ক পরতে নারাজ নাগরিক নীতি নির্ধারকদের বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এমনকি, স্বজনের মৃত্যু থেকে শিক্ষা নিয়েও কোভিড বিধি পালন করতে অনেকে নারাজ। চ্যালেঞ্জটা এখানেই। জীবনযাপনকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করা। যদি আমরা সবাই বাধ্য হতাম, তা হলে অবশ্য এই প্রশ্ন অবান্তর হয়ে যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি। তাই নীতি নির্ধারকদের কাছে এখন প্রশ্ন— অবাধ্যকে বাধ্য করার রাস্তা ঠিক কী।
কোভিডের প্রথম ছোবলের সময়ই অবশ্য নীতি নির্ধারকরা ধরে নিয়েছিলেন, সাধারণ মানুষ কথা শুনবে না। কারণ, কোভিডের ছোবল যে কত জীবন-হরক তা কেউ বুঝবে না। অন্তত প্রাথমিক ধারণাটা তা-ই ছিল। তাই জীবিকা-হরক লকডাউন চালু হল বিশ্বজুড়ে। কোথাও খুব কড়া। কোথাও বা কোমল। কিন্তু যা জীবন কাড়ে তা পেটের ভাতও কাড়ে। আর যা জীবিকা কাড়ে তা এক অর্থে কেড়ে নেয় জীবনও।
কোভিডের এই অতিমারি যখন আমাদের জীবন ও জীবিকা হরণ করতে ব্যস্ত, তখন সাধারণ আলোচনার পরিসরও কিন্তু উপচে যাচ্ছে কী করা উচিত এবং কী করা হচ্ছে না সেই জল্পনায়।
আলোচনা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঠিক কতটা নাগরিকের প্রাত্যহিকতায় নিজেকে আরোপ করতে পারে। এক নাগরিক মাস্ক না পরে যদি আর এক নাগরিকের সংক্রমণের কারণ হয়ে ওঠে, তা হলে কোন নাগরিকের স্বার্থ দেখবে রাষ্ট্র? যে কারণ তার, না যে আক্রান্ত, তার? যে বা যারা সংক্রমণ ছড়ানোর দোষে দোষী তাকে বা তাদের ঠেকাতে প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণের। আর সেই নিয়ন্ত্রণ সার্বিক। ফলে যে নিয়ম মানতে রাজি, তাকেও সেই নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। একজন দোষ করবে আর সেই দোষের শাস্তি ভোগ করতে হবে যে দোষী নয় তাকেও! এ কেমন বিচার?
আলোচনার এই পথে হেঁটে দিশা খোঁজা নীতি নির্ধারকদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, এই জাতীয় যুক্তির লড়াইয়ে ঢিল ছোড়াছুড়ির বাইরে কোনও নির্দিষ্ট এবং কার্যকর সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যে যায় না, তা আমাদের অভিজ্ঞতাই স্পষ্ট করে দিয়েছে।
তাই বিশেষজ্ঞরা এর সমাধান খুঁজতে গিয়ে সমস্যাটাকে এই ভাবে সামনে রাখছেন। বিশ্বজুড়ে করোনার সংক্রমণ ছড়ানোর চরিত্র একই। আর সেই জায়গা থেকে বিশ্বজুড়েই করোনার লড়াইয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মত নিয়ে সব দেশেই একই রকম বিধিনিষেধের পথে আমরা হেঁটেছি। কিন্তু তাতে সাময়িক স্বস্তি মিললেও বিধিনিষেধ পালনের ক্ষেত্রে সমাজ জুড়েই একই ক্লান্তি এবং অনীহা। সে ভারতই হোক বা ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হোক বা বা অন্য কোনও দেশ। তা হলে সমস্যাটা কোথায়? মানুষ কেন এত হারিয়েও কোভিড বিধি মানতে নারাজ? ভুলটা কোথায়?
সেই ভুলের খোঁজেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের আঙিনা পেরিয়ে নীতি গবেষকরা মনুষ্যচরিত্র খুঁজতে বসেছেন। তাঁরা বলছেন, করোনা ঠেকাতে সবাইকেই মাস্ক পরতে হবে। দেখতে হবে যাতে বন্ধ ঘরে অনেক মানুষ এক সঙ্গে না থাকেন ইত্যাদি। আর এ সব আমরা কর্তব্য হিসাবে জানি। কিন্তু তা পালন করার ধর্মটা মানছি না। সেখানেই আসছে নৃতাত্ত্বিক ভাবনার প্রশ্ন।
আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার বা বিশ্বব্যাঙ্ক এখন নৃতত্ত্ববিদদের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলছেন নীতি নির্ধারকদের। উঠে আসছে এবোলা প্রসঙ্গ। কোভিডের শুরুতে কিন্তু এবোলাও আলোচিত হয়েছিল। তবে তা হয়েছিল সংক্রমণ ছড়ানোর দক্ষতা ও ক্ষমতার আলোচনার পরিসরে। এবার এবোলা উঠে এসেছে কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের প্রেক্ষিতে। নীতি গবেষকরা আলোচনায় মেতেছেন— এবোলা ঠেকাতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল আর তার মধ্যে কোনটা সাফল্য আনতে সাহায্য করেছিল। এই আলোচনা থেকেই করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে নীতি নির্ধারণে নৃতাত্ত্বিকদের গুরুত্ব উঠে এসেছে।
আগে দেখা যাক এবোলা ঠেকাতে কী করা হয়েছিল। করোনার মতোই আফ্রিকার আক্রান্ত অঞ্চলের মানুষদের বলা হচ্ছিল নিজেদের বাঁচাতে কী কী করা উচিত। কিন্তু স্বজন এবং স্বজনের মৃত্যুতেও মানুষ বিধি মানতে নারাজ। কেন মানুষ ঠেকেও শিখছে না, তা খতিয়ে দেখা শুরু হল। দেখা গেল আফ্রিকার বিভিন্ন গ্রামে মানুষের জীবনযাপনের চরিত্র ভিন্ন। উপর থেকে যে ভাবে বিধির বিধান চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সবার জন্য এক ভাবে, সেখানেই তৈরি হচ্ছে সঙ্ঘাত। বিধি যদি জীবনযাপনের সঙ্গে এক সুরে না বাজে, তা হলে তো মানুষ তা নিজের মতো করে আঁকড়ে ধরতেই চাইবে না!
ভাবুন তো করোনার লকডাউনের কথা। সেই লকডাউনের কারণে যে ভাবে পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফেরার জন্য উদ্ভ্রান্তের মতো রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন সপরিবারে এবং তাঁদের যে অবর্ণনীয় কষ্ট, তার মূলে যে নীতি-অজ্ঞতার বিরাট দায় ছিল, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। একই সঙ্গে সেই শ্রমিকদের মধ্যে অনেককে অঞ্চল এবং স্থানীয় সমাজভেদে নিজেদের গ্রামে ফিরেও অচ্ছুত হয়ে থাকতে হয়েছে। আবার কেউ হয়ত সংক্রমণে ছড়ানোর কারণ হয়ে উঠেছেন। কোনও গ্রাম আবার তাদের ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে কোনও দ্বিধা না করলেও গ্রামের স্কুলে নিভৃতবাসে রেখেছে। যাতে সংক্রমণ নিয়ে এলে তা গ্রামের অন্যদের মধ্যে না ছড়ায়। আর বর্তমান কোভিড-ঝড় তো আমরা প্রত্যক্ষই করছি। যার মূলে রয়েছে শীতের ছুটিতে বেলাগাম কোভিডবিধি উপেক্ষা-করা উৎসবমুখিতা। অর্থাৎ বিধি এক হলেও তার মর্ম বোঝায় একটা ফারাক থেকেই গিয়েছিল। এবোলার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। এবোলার ক্ষেত্রে গ্রামে গ্রামে যখন স্থানীয়রা নিজেদের মতো করে সংক্রমণ রোখার চেষ্টা করছেন, নিভৃতবাসের ব্যবস্থা করছেন, তখন পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্র তাকে এবোলাবিধির বিরোধিতা হিসাবে পড়ে খড়্গহস্ত হয়ে উঠেছিল। সেই জীবনযাপন বিরোধী নীতিই আবার মানুষকে এবোলা-বিধি বিরোধী করে তুলেছিল।
ইতিহাস বলছে, নীতি নির্ধারকদের ছ’মাসের উপর লেগেছিল এটা বুঝতে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে না পারলে এই যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। বিধি এক কিন্তু তা পালনে মানুষকে সঙ্গী করার নীতিও যে আলাদা, এটা বোঝা জরুরি ছিল।
কারণ, সবাই এক ভাবে বোঝে না। কেউ বাড়ি থেকে কাজ করতে পারেন। কিন্তু অন্য এক জনকে পেটের ভাত রোজগারের জন্য বাইরে পা রাখতেই হবে। ফলে কোভিড থেকে বাঁচতে এই দু’জনের কোভিডবিধি একই রকম হবে না। এটা একটা সহজ উদাহরণ। জীবনযাপনের গতিবিদ্যায় এ আসলে আরও জটিল হয়ে ওঠে। ঢুকে পড়ে ধর্ম ও জীবিকার শর্তের মতো নানান জটিলতা। আর তাই বিধি এক থাকলেও তা পালনের নীতিও এই শর্তসাপেক্ষে আলাদা হতে পারে।
সেখানেই আসে নৃতত্ত্ব ভাবনা। এবোলার সময় মাঠে নেমেছিলেন নৃতাত্ত্বিকেরা। জীবনযাপনের প্রতিটি নির্ধারক, যেমন ধর্ম বা পেশা অথবা নৃতাত্ত্বিক বাকি নির্ধারক, ধরে শুরু হয়েছিল পালননীতি তৈরির কাজ। প্রতিটি গোষ্ঠীর জন্য আলাদাভাবে পালননীতি তৈরি ও প্রসারের কৌশল।
আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার বা বিশ্বব্যাঙ্কের মতো নীতিনির্ধারণ আলোচক ও পরামর্শদাতা সংস্থাগুলি এখন তাই কোভিড নিয়ন্ত্রণেও এবোলা থেকে শিক্ষা খুঁজতে শুরু করেছে। নীতি স্তরে অবশেষে শুরু হয়েছে সেই আলোচনা, যা বলছে মানুষকে এড়িয়ে মানুষ বাঁচানো যাবে না। আরোপ নয়, গ্রহণযোগ্যতাই হল আসল। শুধু চিকিৎসক নন। রাজনৈতিক নেতা নন। বিধির কথা মানুষের মর্মে ঢোকাতে সঙ্গে থাক মানুষ-বোঝা মানুষ। শেখা যাক ‘এবোলা যুদ্ধ’ থেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy