সকলেই দৌড় শেষ করেছিল। ওই খুদেরা, যারা ছিল একেবারে সবার পিছনে। স্কুলের স্পোর্টসে এমনই হয়। বাকি সকলে সমাপ্তিরেখা পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু দু’এক জন তখনও দৌড়ে যাচ্ছে, দৌড় শেষ করছে। দর্শকের সারিতে তখন উচ্ছ্বসিত বাবা-মায়ের পাশেই মুখ কালো হয়ে যাওয়া বাবা-মায়েদের হতাশা— ‘কিছুই পারে না, অন্যরা কী ফোকাসড’ ইত্যাদি, ইত্যাদি।
অথচ সমাজমাধ্যমে একটি বিদেশি বাচ্চা মেয়ের ফুটবল ছেড়ে মাঠের মধ্যে নাচের ছবি পোস্ট করে দেখুন, ‘লাইক’-এর বন্যা বয়ে যাবে। কিন্তু সেই মানুষটিই তাঁর সন্তানের ক্ষেত্রে, ‘কেন ফার্স্ট হলি না, ও পারে, তুই পারিস না কেন,’ করে বাচ্চাকে মানসিক ভাবে অসুস্থ করে তুলছে। না, অসুখটা নতুন নয়। অসুখটা সে দিন থেকেই ঢুকেছে, যখন আজ থেকে অন্তত ৩৫ বছর আগে মা-বাবারা ট্রামে-বাসে এক সঙ্গে যাওয়ার সময় বলতে শুরু করলেন, ‘আমার পরীক্ষা তো ২ ডিসেম্বর, আপনার কবে?’ সন্তানের পরীক্ষার প্রস্তুতির সঙ্গে অভিভাবকের প্রস্তুতি, পরিশ্রম অনেকটাই থাকে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার সন্তানের পরীক্ষা ‘আমার পরীক্ষা’ হয়ে গেলে আমার আশা-আকাঙ্ক্ষা, আমার হতাশা আরও পাকে পাকে জড়িয়ে ফেলে তাকে।
বলতেই পারেন, এমন না হলে সন্তান প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারবে না। কথাটা ঠিক। ব্যবস্থাটাই এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে — তৈরি করা হয়েছে আমাদেরই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদতে। শুধু কি স্কুল, গাদা গাদা টাকা ফি নেওয়া প্রি-স্কুল থেকে প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়া শুরু। প্রচুর তথ্য, অঙ্ক শিশুদের শিখতে বাধ্য করা, বয়সের তুলনায় অনেক বেশি কিছু চাপিয়ে দেওয়া। স্কুল, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা মুখে আনন্দপাঠের কথা বললেও বাস্তবে সবই পরীক্ষা, সবই বাধ্যতামূলক।
অথচ হারটাও তো শেখার কথা খেলার মাঠেই, হার মেনে নিতে শেখার জন্যই তো খেলার মাঠ, হারতে হবে, কাঁদতে হবে, ‘না’ শুনতে হবে, ধাক্কা খেয়ে, লাথি খেয়ে পড়ে যেতে হবে, আবার উঠে দাঁড়াতেও হবে। কিন্তু না! খেলা মানেও সেই প্রথম, দ্বিতীয় হওয়ার দৌড়। অথচ গত পাঁচ বছরে স্কুলের বড় বড় সব পরীক্ষায় প্রথম তিন জন পরবর্তী কালে কী হয়েছে? খোঁজ নিয়ে দেখবেন তো। শুধু গত পাঁচ বছর কেন? স্কুলের শেষ বেঞ্চিতে বসা ছেলে বা মেয়েটি পরবর্তী কালে প্রতিষ্ঠিত হয়নি কি? নিজের সহপাঠীদের দিকেই তাকিয়ে দেখুন।
কিন্তু না! সাফল্য থাকতেই হবে। তাই যে সব ছবি দেখে আমরা পিছিয়ে পড়াদের ছবি বলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি, সেই তারে জমিন পর বা থ্রি ইডিয়টস-এ শেষ পর্যন্ত সাফল্যই জয়ী হয়। ওই সব ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্ররা যদি জীবনে বলার মতো কিছুই করতে না পারত, কী হত? আমরা কি এত হাততালি দিতাম? প্রতিকূলতাকে জয় করা এক ব্যাপার, আর তা জয় করে প্রথম হতেই হবে— দুটোর মধ্যে ফারাক রয়েছে। সেটা আমরা ভুলে গিয়েছি। ভাবুন তো যে স্কট-রাজা রবার্ট ব্রুসের টিকে থাকার লড়াইকে, ৬ বার পরাজিত হওয়ার পর জিতে ফেরার লড়াইকে আমরা এত মূল্য দিই, সেই ব্রুস প্রতিযোগিতাপরিবারে থাকলে কী দশা হত! আর তুলনাটা যদি করতেই হয়, তা হলে প্রয়োজন তুলনাটা নিজের সঙ্গে করা, অন্যের নয়, আমি নিজেকে নিজে কতটা ছাপিয়ে যেতে পারি। সুভদ্রা উর্মিলা মজুমদারের একটি ছোট গল্প ছিল অনেকটা এই রকম। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র (মহিলা) এই তুলনার অসুখে ভুগতেন। ওর বাড়িতে এই ফুলদানি, এই পেন্টিং, এই গহনা ইত্যাদি তুলনা এবং তাকে ছাপিয়ে যেতে যেতে মহিলা এক দিন দেখলেন পাশের বাড়ি থেকে গান ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন, সেই গান তো অর্থ দিয়ে, প্রভাব দিয়ে তিনি আয়ত্তে আনতে পারবেন না। সেই কণ্ঠ, সেই সুর তো তাঁর নেই।
কিন্তু প্রথম হওয়ার অন্ধ আকাঙ্ক্ষা মুছে দিতে চাইছে আমাদের শেষে থাকার বাস্তবতাকে। অথচ ইংরেজিতে ‘লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং’-এর ব্যাখ্যা মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে বা অন্যত্র শেষ মানুষটির লড়াই, অন্যেরা পরাজিত বা মৃত, কিন্তু শেষ মানুষটি লড়ে যাচ্ছে। হয়তো সে রক্তাক্ত, কিন্তু লড়ছে, রণক্ষেত্র ছাড়েনি। সেই লড়াইটাই হয়তো বাঁচিয়ে দেবে অন্যদের, হয়তো বা দেশকে। বা ‘লাস্ট পোস্ট স্ট্যান্ডিং’। যুদ্ধক্ষেত্রের শেষ ঘাঁটি তখনও দাঁড়িয়ে। তার সেনাদের লড়ে যাওয়া ঠেকিয়ে দেয় শত্রুর বিজয় অথবা নিরঙ্কুশ দখল। জন্ম নেয় আরও প্রতিরোধ।
আর ফুটবলে গোলপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি? প্রতিরোধের শেষ কথা তিনি আর তাঁকে দিয়েই শুরু পরবর্তী আক্রমণ। ইদানীং সমাজমাধ্যমে বহুলপ্রচারিত কাহিনিটা তেমনই এক জনকে নিয়ে। ১৯৩৭ সালে ২৫ ডিসেম্বর গভীর কুয়াশা নেমেছিল ইংল্যান্ডের স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে। ফুটবল ম্যাচটি যে সেই কারণে কখন বন্ধ হয়ে যায়, বুঝতেই পারেননি চার্লটন অ্যাথলেটিকের গোলকিপার স্যাম বার্ট্রাম। তিনি গোলপোস্ট আগলে দাঁড়িয়েই ছিলেন, শেষ এক জন পুলিশ এসে কুয়াশায় তাঁকে খুঁজে পান এবং জানান ম্যাচ ১৫ মিনিট আগেই থেমে গিয়েছে। কুয়াশায় সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবু মাঠ ছাড়েননি দলের শেষ প্রহরী। ক্রিকেটে ‘নাইটওয়াচম্যান’-কে অনেকটা সেই ভূমিকাতেই দেখি না? দিনের খেলা প্রায় শেষ হওয়ার মুখে, ব্যাটিং টিমের উইকেট পড়লে পাঠানো হয় দলের শেষের দিকের অর্ডারে থাকা এক জনকে। শেষ বেলায় দুর্গরক্ষা আর কী। অথচ এই ভূমিকায় মাঠে নেমে দাপটে শতরান করেছেন পাকিস্তানের নাসিম উল গনি, অস্ট্রেলিয়ার জেসন গিলেসপি, টোনি মান, ভারতের সৈয়দ কিরমানি, দক্ষিণ আফ্রিকার মার্ক বাউচার। বাউচার দু’বার শতবার করেছিলেন আর গিলেসপি তো দ্বিশতরান করেছিলেন।
ছায়াছবির পোস্টারে বা টাইটল কার্ডের শেষে কিন্তু ‘এবং’ বলে নাম থাকে ছবির শ্রেষ্ঠ তারকারই।
তা হলে? শেষে তো শেষ নয়। শুরু। পুরনো বছরের মতো।
আসলে দেখতে চাইলে, দেখতে পারলে অন্য ভাবে দেখাই যায়। শেষে যে দৌড়ে আসে, জড়িয়ে ধরতে হয় তাকেও।
শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতাটি: ‘নালিশ’-এর কিছু অংশ পড়া যাক। ট্রেন খুবই দেরিতে আসছে। তাড়াহুড়ো করে প্ল্যাটফর্মে ঢোকা যাত্রী বিরক্ত। স্টেশনমাস্টারের ঘরে গিয়ে নালিশ জানানোর খাতা টেনে লিখছেন, ‘কেন যে ট্রেনেরা রোজ দেরী করে আসে, ক্ষতি হয়।’ পর ক্ষণেই মনে হয়, শুধু এই? শুধু ক্ষতি হয় লিখলেন, অথচ মনে কত ক্ষোভ— রেল কর্তৃপক্ষ, সমাজ, রাজনীতি, বিধাতা সব কিছুর বিরুদ্ধে।
‘অথচ কলম খুললে হিংসা চলে যায়। মনে হয়
ক্ষতি যা হবার তা - তো হয়ে গেছে, ক্ষতি হল খুব,
নষ্ট সময়ের স্তূপ ভেঙ্গে তবু শব্দ আসে তার,
একেবারে না-আসার চেয়ে সে কি ভালো নয় !
বিশাল খাতাটা পড়ে থাকে—
দেরি করে যে এসেছে, ইচ্ছে করে ভালোবাসি তাকে।’
‘দেরি করে যে এসেছে, ইচ্ছে করে ভালবাসি তাকে’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy