কারও ক্রিসমাস, কারও সর্বনাশ! তবে, কলকাতা সাক্ষী দেবে— যাঁদের ক্রিসমাস, সর্বনাশ তাঁদেরও হল। ঠিক যে সময়ে আমাদের অফিস-কাছারি এমনকি স্কুলও খুলছিল, জীবন প্রায় স্বাভাবিক দেখাতে শুরু করেছিল, তখনই আবার ঘরে ফিরে যেতে হল। শুধু ক্রিসমাসের আনন্দ-উৎসবের জন্যই এতটা বাড়াবাড়ি কি না, সে আলোচনা থাক। আমরা বরং এই বেলা কিছু হিসাব করে রাখতে পারি। এই বিপর্যয়কে স্বীকার করে নিয়ে এই অন্ধকার অতিমারিকালে ঘরে বসে ভেবে দেখতে পারি যে, ঠিক কতটা বদলে গিয়েছে আমাদের জীবন; কী কী হারিয়েছি, আর কতটা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
আতঙ্ককে নিয়ন্ত্রণ না করলে তা ক্রমাগত বেড়েই চলে এবং এক সময় প্রায় কল্পনানির্ভর হয়ে দাঁড়ায়। ভেবে দেখলে, এই অতিমারির প্রথম এবং মৌলিক অবদান হল করোনার আতঙ্ক, যা এ ভাবেই বেড়েছে আর গ্রাস করেছে জীবনের স্বাভাবিকতা এবং মূল্যবোধ। আতঙ্কিত অবস্থায় মানুষ এমন এমন কিছু করার ছাড়পত্র পায়, যা অন্য সময় ভাবতেই পারে না। মুখোশ-দস্তানা-জীবাণুনাশক কণ্টকিত জীবনে তেমনই কেউ অসুস্থ প্রতিবেশীর দরজায় তালা লাগিয়েছে, কেউ পরমাত্মীয়কে ফেলে পালিয়েছে, ডাক্তার-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি থেকে তাড়াবার চেষ্টা করেছে! সে সব ভেবে তাদেরও নিশ্চয়ই লজ্জা হয়। কিন্তু এ সবই মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়ের উদাহরণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বাড়াবাড়ি আতঙ্ক কিন্তু সাবধানতা নয়, বরং কিছুটা বিলাসিতাই বলা যায়, যার সীমা নির্দিষ্ট হয় নিজের জীবনযাত্রা ও প্রয়োজনের মাপে। যেমন, জানলা খুলে প্রতিবেশীর মুখদর্শন করতেও যিনি ভয় পেয়েছেন, তাঁকেও কিন্তু দোকান-বাজার ডাক্তারখানা সর্বত্রই যেতে হয়েছে।
মোটের উপর ‘ওয়র্ক ফ্রম হোম’ আর ‘হোম ডেলিভারি’-র পরিষেবা যাঁরা ভোগ করেন, ভয়ে কাঁটা হয়ে হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকার বিলাসিতা তাঁদেরই জন্য। কিন্তু নানা পরিষেবা যাঁরা দেন, তাঁদের আতঙ্কিত হলে চলে না— চলেনি এ বারও। যেমন, ডাক্তার-পুলিশ-প্রশাসন থেকে শুরু করে আনাজওয়ালা-মাছওয়ালা, ডেলিভারি বয়। সুবিধাভোগী আর বঞ্চিতদের মধ্যে ভাগাভাগি আমাদের সমাজে ছিলই। করোনাকালে সেই সরল নকশায় ‘ডিজিটাল’ আর ‘নন-ডিজিটাল’ এই নতুন মাত্রা জুড়ে চিত্রটা আরও জটিল! তীব্র আতঙ্কের পর্যায়টা পেরিয়ে গেলেও আরও বহু দিন আমাদের অনেকটা সময় ব্যয় হবে নিরাপত্তার চিন্তায়। সাহস করে কারও বাড়ি যেতে বা কাউকে বাড়িতে ডাকতে পারব না। নিজের বাধাটুকু কাটিয়ে উঠলেও যাঁর বাড়ি যাব বা যাঁকে ডাকব, তিনি চাইবেন কি না, এই সংশয় চলবে বহু দিন। এমনিতেই নাগরিক জীবনে আমরা ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছি, তার উপর অতিমারি-উদ্ভূত আতঙ্ক সামাজিক জীবনের স্বাভাবিকতার ধারণাটাকেই বদলে দিয়েছে। নিরন্তর বিশেষ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছি সহকর্মীকে, সহযাত্রীকে, গাড়ির চালককে, পরিচারিকাকে। সবটাই হয়তো অর্থহীন নয়, তবে নিরাপত্তার গণ্ডি শক্তিশালী করতে গিয়ে আমরা যে সম্পর্কের বাঁধন ক্রমাগত শিথিল করে ফেলছি, সেও কম ক্ষতি নয়। আজ বা কাল, এর থেকে বেরোতেই হবে— সে কথা মনে রাখা দরকার।
আতঙ্কের অপর পিঠেই থাকে চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, যার প্রকাশ দেখা গিয়েছে বুর্জ খলিফা থেকে বড়দিন বা বর্ষবরণ উপলক্ষে পার্ক স্ট্রিটের হল্লা, সর্বত্র। সে জন্য অতিমারিকে দুষে লাভ নেই। অতিমারিতে মানুষ গরিব হয়েছেন বিশ্ব জুড়ে। বহু শিল্প বন্ধ হয়েছে, মানুষের চাকরি গিয়েছে, বহু মানুষ পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন, বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়ে অনাথ হয়েছে অনেক শিশু। এক-একটি জীবনের সাপেক্ষে এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে এ কথা ভুলে যাওয়ারও নয়। উঠে দাঁড়াবার সময়, এদের কথা আমাদের মনে রাখতেই হবে।
আমরা জানতাম যে, শিক্ষা শিশুর মৌলিক অধিকার। জানতাম, স্কুল বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েরা বড় কষ্টে আছে। আশা ছিল, স্কুল খুললে ছাত্ররা নিয়মিত স্কুলে যাবে ফের। অতিমারিতে স্কুল বন্ধ হয়েছে সবচেয়ে আগে, খুলেছে সবার শেষে। দেড় বছর বন্ধ থাকা স্কুলের দরজা গত দেড় মাসে যখন একটু ফাঁক হয়েছে, দেখা গিয়েছে শিশুরা তাদের মৌলিক অধিকার প্রয়োগে আর আগ্রহী নয়। গ্রামের দিকের বিভিন্ন সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে দু’বছরে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা লাফ দিয়ে কমেছে। ছেলেগুলো মাঠের কাজে বা দোকানের কাজে লেগে গিয়েছে। ১৮ বছরের নিম্নসীমার আইনকে গোল্লায় পাঠিয়ে মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। অনেকে মা-ও হয়ে গিয়েছে। যে মেয়ের ঘাড়ে সংসারের জোয়াল চেপে বসেছে, তাকে মুক্ত করে আনা; আর যে ছেলে সংসারে দুটো পয়সা আনছে, তাকে কাজ ছাড়িয়ে স্কুলে আনা— দুই-ই সমান কঠিন। অর্থাৎ, বালক-বালিকারা বাদই পড়ে যাবে স্কুলে ফেরার দল থেকে। শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মীদের দাবি, সব শিক্ষার্থীকেই স্কুলে ফেরাতে হবে। বিশেষ পরিকল্পনা বা নীতি নির্ধারণ ছাড়া সেটা কতটা সম্ভব, অনুমান করা চলে।
যে শিক্ষার্থীরা খাতায়-কলমে স্কুল ছাড়েনি, তাদের অবস্থাও তথৈবচ। করোনার আক্রমণ শুরুর সময় যে যে ক্লাসে পড়ছিল, এত দিনে তার চেয়ে দুটো ক্লাস এগোনোর কথা। কিন্তু একটা বিশাল সংখ্যক ছাত্র এখনও প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। তাদের অভিভাবকরা জানেন না সন্তান কোন ক্লাসে পড়ে। ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্ত থাকেন— যা শেখার, ঠিক শিখবে। এটা অপরাধ নয়, অপারগতা। শিক্ষক-শিক্ষিকা-ক্লাসের পড়াশোনা, মিড-ডে মিল সব কিছু মিলে স্কুল নামক বিরাট অস্তিত্বটা ছাত্রদের জীবন থেকে গোটাগুটি তুলে নিলে তাদের শিক্ষার কিছু বাকি থাকে না। স্কুলের সঙ্গে সংস্রবহীন এই দু’বছরে তারা এমনি এমনি কিছুই শিখে যায়নি, বরং আগেকার শেখাটুকুও ভুলে গিয়েছে। নানা রকম মাধ্যম ও বোর্ডের কাটাকুটিতে আমাদের স্কুল এবং ছাত্রছাত্রীরা এমনিতেই নানা খোপে বিভক্ত। তার উপর আন্তর্জাল এবং স্মার্টফোন যাদের আছে এবং যাদের নেই— অর্থাৎ যারা অনলাইন ক্লাস করতে পেরেছে আর পারেনি— তারা আর এক জায়গায় নেই। দ্বিতীয় পর্যায়ের ছাত্ররা শুধু ক্লাসে উঠেছে, কিন্তু শেখার সুযোগ পায়নি। নিয়মিত অনলাইন ক্লাস যারা করেছে, তারাও স্কুলের আকর্ষণ হারিয়ে বাড়িতে বসে ‘ইচ্ছেমতো’ ক্লাস আর পরীক্ষাতেই যেন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এই চূড়ান্ত অসমসত্ত্ব ছাত্রগোষ্ঠী নিয়ে আমাদের স্কুলের পড়াশোনা নতুন করে শুরু করতে হবে। স্কুল যেমন কাউকে আটকে রেখে তার বছর নষ্ট করাতে পারে না, তেমনই শুধু পাশ করিয়ে দিলেই স্কুলের কাজ মিটে যায় না। কী করে এই দু’বছরের না-শেখা পাঠ অন্তত কিছুটা তাদের দেওয়া যায়, যাতে তারা পরের পাঠগুলো গ্রহণ করতে পারে, বিশেষ পরিকল্পনা দরকার। সে বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির নানা মডেল রয়েছে; অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিছু পদ্ধতির কথা লিখেছেন। সে সব নিয়ে চিন্তাভাবনা দরকার। নচেৎ অতিমারির সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী ও ক্ষতিকর প্রভাব শিক্ষাজগতের উপরেই পড়বে, যা গোটা একটা প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে। এর মধ্যেই তৃতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় স্কুল আবার বন্ধ হয়ে গেল। বড়দিনের ছুটিতে যে বাচ্চাটি বাবার হাত ধরে চিড়িয়াখানা ঘুরেছে, স্কুল বন্ধ হল তারও। ওই যে প্রথমেই বললাম, যার ক্রিসমাস, তারও সর্বনাশ !
আবারও বলি, আজ হোক বা কাল, আমাদের দেখা হবেই অতিমারি শেষে। সেই ‘ওল্ড নর্মাল’-এ ফেরার পথে ক্ষতিগুলোকে চিনে নিতে হবে, তবেই আমরা কিছুটা হলেও ‘আগের অবস্থায়’ ফিরতে পারব। শহরাঞ্চলের আলোকবৃত্তের মধ্যে বসে আমাদের নজর বেশি দূর যায় না; বেশির ভাগ সামাজিক ক্ষতিকে চিনতে পারি অনেক দেরিতে। যেমন, স্কুল বন্ধ থাকা আর খুলে যাওয়ার মাঝে সর্বস্তরেই যে এতটা বদল হয়ে যেতে পারে, তা ভাবনাতেও আসেনি। কিন্তু অতিমারি যেমন আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, তেমনই দিয়েছেও অনেক কিছু। আমরা দেখেছি, মানুষ কী ভাবে সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা মানুষের জন্য লড়ে যাচ্ছে। শহর এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুটে যাচ্ছে, হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে অসুস্থকে, চাঁদা তুলে রান্নাঘর খুলে অভুক্ত, অসুস্থকে খাওয়াচ্ছে। কেউ কাউকে বলে দেয়নি, মানুষ নিজেই নিজেকে জাগিয়েছে, আরও দশ জন তাকে সঙ্গ দিয়েছে। এত সাহস, এত প্রাণশক্তিও যে আমাদেরই মধ্যে লুকিয়ে ছিল, তা-ও কি জানতাম এই বিপদে না পড়লে! ব্যক্তিগত সতর্কতার পাশাপাশি এই সচেতনতা আমাদের মধ্যেও আসা চাই। যাবতীয় উদ্যোগ ও পরিকল্পনা সরকারের তরফে শুরু হলেই ভাল, কিন্তু নাগরিক সমাজেরও কিছু দায়িত্ব আছে। প্রয়োজনে সরকারের কাছে দাবি পেশ করতেও হবে নাগরিকদেরই।
এখনও জানি না, এই অন্ধকার সময় আরও কত দিন! কিন্তু এটা সত্যি যে, করোনা সেই দিনই সত্যি করে বিদায় নেবে, যে দিন এই করোনাকালের প্রভাবকে আমরা পেরিয়ে যেতে পারব।
সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy